‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ অভিনব প্রতারণার নতুন অস্ত্র!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ মে,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:১৯ এএম, ২২ মার্চ,শনিবার,২০২৫

ছবি: সংগৃহীত
তাহমিনা বেগম (ছদ্মনাম) কিছুদিন আগে ‘অদ্ভূত’ এক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। বাজার থেকে বাড়িতে ফেরার সময় হঠাৎ তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন অপরিচিত এক নারী। তার প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেই নারী জানতে চান কোনো একটি ঠিকানা। এরপরই সামনে আসে আরেক যুবক। মাত্র দুই থেকে তিন মিনিট কথার পরই কী যেন হয়ে যায় তাহমিনার।
তাহমিনা বলেন, ‘ব্যাপারটা অদ্ভূত এবং ভয়ংকর। লোকটা আমার কাছে জানতে চায় এলাকায় পরিচিত কোনো গরীব কিংবা এতিম কেউ আছে কি না। সে তাকে সাহায্য করবে। এরকম একটা গরীব পরিবার ছিল আমার বাড়ির কাছে। তাই আমি বিস্তারিত জানতে চাই। ওদের সঙ্গে কথা বলি কয়েক মিনিট। এরপরই কী যেন হয়ে গেলো, আমার আর বুদ্ধি কাজ করছিলো না।’
একপর্যায়ে তাহমিনা বেগম অপরিচিত ওই নারী ও যুবকের কথা মতো তার কানের দুল, গলার চেইন এবং সঙ্গে থাকা কয়েকহাজার নগদ টাকা তুলে দেন। তাহমিনা জানান, ‘ওরা বললো আন্টি আপনার গয়না আর টাকাগুলো ব্যাগে রাখেন। নইলে হারিয়ে যেতে পারে। আমি ঠিক সেটাই করলাম। আমার মাথায় আসলো না যে কেন আমি এগুলো খুলবো, কেন হারিয়ে যাবে বা কেন ব্যাগে রাখবো? তারপর ছেলেটা বললো আমার সঙ্গে আসেন। আমি তখন ব্যাগটা মেয়েটার কাছে দিয়ে ছেলেটার পেছনে হাঁটতে শুরু করি।
কিছুদূর হাঁটার পরই তাহমিনা বেগমের সম্বিত ফিরে আসে। কিন্তু তখন ছেলেটাকে আর দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। ফেরত এসে মেয়েটাকেও আর পাননি। সেদিনের সেই ঘটনায় তার সোয়া ভরি স্বর্ণের চেইন, কানের দুল, নগদ টাকা এবং মোবাইল খুইয়ে আসেন তিনি। তাহমিনা বলেন, ‘আমি এখনও বুঝতে পারি না কীভাবে কী হয়ে গেলো। ওরা আমাকে কিছুই করেনি। শুধু কাছাকাছি ছিল এবং মেয়েটা মুখের সামনে হাত নেড়ে একটা ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলো।’
তাহমিনা বেগম যে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকেই এমন ঘটনার শিকার হচ্ছেন। এর পেছনে কারণ হিসেবে উঠে আসছে স্কোপোলামিন নামে একটি ড্রাগের কথা।
জানা যায়, এটা তরল কিংবা পাউডার দুই ধরনেই পাওয়া যায়। অপরাধের ক্ষেত্রে এই ড্রাগ কাগজ, কাপড়, হাত এমনকি মোবাইলের স্ক্রিনে লাগিয়েও এর ঘ্রাণ দিয়ে কিছু সময়ের জন্যযে কারো মানসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে আসলেই কি এমন কোনো ড্রাগ আছে? আর থাকলেও এটা বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে কি না সেটাই বা কতটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে?
আরও পড়ুন: সরকারি হাসপাতালের অনুমোদনহীন ক্যান্টিন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্মেসির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ
স্কোপোলামিন ব্যবহার
নারায়ণগঞ্জে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বেসরকারি বিশ্ববদ্যিালয়ের শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেই হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছিলো। পরে আরো একজনকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে একজনের কাছে প্রথমবারের মতো স্কোপোলামিন পাওয়ার কথা জানায় পুলিশ। বোতলের ভেতর সাদা পাউডার আকারে কয়েক গ্রাম স্কোপোলামিনসহ আরো কয়েক ধরনের মাদক জব্দ করা হয়। পরে আদালতের আদেশ নিয়ে সিআইডি’র ল্যাবে টেস্ট করার পর সেখানে স্কোপোলামিন শনাক্ত হয়।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, শুরুতে এ স্কোপোলামিন সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না তাদের। রাসায়নিক পরীক্ষার যে রিপোর্টটা আমরা পেয়েছি সেই রিপোর্টে কিন্তু স্কোপোলামিন, পটাশিয়াম সায়ানাইড ও ক্লোরোফর্ম শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে স্কোপোলামিন ছিল আমাদের কাছে একেবারেই নতুন। এ নাম, এর ব্যবহার, কোন কোন ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগানো হতে পারে সেটা আমরা জানতাম না। পরে এটা নিয়ে স্টাডি করে আমরা জানতে পারি যে, এটাকে আসলে 'ডেভিলস ব্রেথ' বা 'শয়তানের নিঃশ্বাস' বলে অনেকে।’
গোলাম মোস্তফা জানান, তারা এখনও পর্যন্ত তদন্তে যেটা পেয়েছেন সেটা হচ্ছে এই ড্রাগ কুরিয়ারের মাধ্যমে এবং বিভিন্নভাবে চোরাকারবারিরা দেশে আনছে।
স্কোপোলামিন মূলত একটি সিনথেটিক ড্রাগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন পরবর্তী রোগীর জন্য ওষুধে এর ব্যবহার আছে। তবে এটা প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নয়। বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এটা তরল এবং পাউডার দুই রূপেই পাওয়া যায়। তবে এর গুরুত্বপূর্ণ বা মূল উপাদান আসে ধুতরা ফল থেকে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, ‘আমাদের দেশে একসময় মানুষকে পাগল করে দেয়ার জন্য দুধের মধ্যে ধুতরা বেটে খাইয়ে দেয়া হতো। ধুতরা ফুল কিন্তু একটা বিষ। ওই ধুতরা থেকে উপাদান নিয়ে সিনথেটিক্যালি এটা বানানো হয়েছে। মেক্সিকোর যে মাদক চক্র আছে, তারা এই মাদকটা বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধ হিসেবে স্কোপোলামিনের ব্যবহার এখনও আছে। এটা এবং এর মতো আরো বেশ কিছু ওষুধ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়। এটা সত্য। স্কোপোলামিন প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোয়েন্দা জ্ঞিাসাবাদের ক্ষেত্রে ‘ট্রুথ সেরাম’ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ এটা যদি ইনজেক্ট করে দেয়া হয় তাহলে সে সত্য কথা বলতে শুরু করে। কারণ, তার মগজের ওপর নিজস্ব যে নিয়ন্ত্রণ সেটা চলে যায়। সে তখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, অন্যের কথা শুনতে থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যখন আপনি কথা বলানোর জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ট্রুথ সেরাম। যখন আপনি পাউডার ফর্মে নিঃশ্বাসের জন্য ব্যবহার করছেন তখন এটা ‘ডেভিলস ব্রেথ’। আর যখন এটা বমি অথবা মোশন সিকনেসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন তখন এটা আসলে মেডিসিন হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি
আরও পড়ুন
এই বিভাগের আরো খবর

মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডব্লিউএইচওতে চাকরি, পুতুলের বিরুদ্ধে মামলা

বুকে পাথর চাপা দিয়ে ড. ইউনূসকে মেনে নিয়েছিলেন সেনাপ্রধান : আসিফ মাহমুদ

দিল্লি নয়, ঢাকা থেকেই বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে অস্ট্রেলিয়া

বাংলাদেশ বিষয়ে তুলসি গ্যাবার্ডের বক্তব্য নিয়ে যেভাবে বিভ্রান্তি ছড়ালো সংবাদমাধ্যম
