avertisements 2

অনিশ্চয়তা না স্বস্তি স্বাগত ২০২৪

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ জানুয়ারী,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:৪৭ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪

Text

প্রকৃতিতে এখন শীত। শহুরে জীবনে শীতের এই প্রকোপ ততটা নয়। কিন্তু গ্রাম আচ্ছন্ন ঘন কুয়াশায়, রিক্ততা নিয়ে ঝেঁকে বসেছে কনকনে হিম। পল থেরাক্সের ভাষায়- ‘শীত হল পুনরুদ্ধার এবং প্রস্তুতির একটি ঋতু।’ ঔপন্যাসিক এলিজাবেথ বোয়েন আবার বলেছেন, ‘শরৎ খুব ভোরে আসে, কিন্তু শীতের দিন শেষে বসন্ত আসে।’ প্রকৃতি নয়, জনজীবনে সত্যিকারের বসন্ত কী আসলেই আসবে? রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, সাধের সাথে সাধ্যের ঘাটতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে চলেছে। এক দিকে চলছে জ্বালাও পোড়াও, হামলা, গ্রেফতার অন্য দিকে নির্বাচনের ঘনঘটা। তার ওপরে বাজারে গেলে জনজীবনে উঠছে হাপিত্যেশ। ব্যবসায় মন্দাভাব, ডলার সঙ্কট। দূষিত এই নগরীতে চলছে সাধারণ মানুষের টিকে থাকার সংগ্রাম। এমনি এক সময়ে ইংরেজি ক্যালেন্ডারে এসেছে পরিবর্তন। স্বাগত-২০২৪। নতুন এই বছরে কী আতশবাজির মতো বর্ণিল আনন্দ ফিরে আসবে? মিলবে কী স্বস্তি? না অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপেই কাটবে সময়?

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হতে পারে : রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০২৩ ছিল ঘটনাবহুল। নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে, উত্থান-পতনের ঘটনাও ঘটেছে। ২০২৩ সাল জুড়ে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচিতে সরগরম ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। বছর শেষে বিএনপি সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে লাগাতার আন্দোলন শুরু করে। এর মধ্যেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

গেল বছরের শুরু থেকেই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা তৎপরতা ছিল। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের বৈঠক হয়। সে বৈঠকে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের তাগাদা দেয় আমেরিকা। অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, ‘বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সেজন্য আমরা তো অবশ্যই, সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে।’ মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি নিয়েও জোর গুরুত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মূলত ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের কারণে এবারের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দারুণ উদ্বেগ ছিল।

ওই মাসেই জাতীয় সংসদে শেখ হাসিনা এক বক্তব্যে আমেরিকার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আমেরিকা বাংলাদেশের ক্ষমতায় পরিবর্তন আনতে চায়’। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় সরকারের শীর্ষ মহল থেকে। ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো-বা তাকে ক্ষমতায় চায় না বলেই র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গত ১৪ বছর ধরেই শুধুমাত্র দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে, তাই আমরা উন্নতি করতে পারছি।’

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতায় সরকারের মধ্যে গেল বছরে চরম অস্বস্তি ছিল। বছরজুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন নেতা, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন, সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের সাথে নির্বাচন নিয়ে পিটার হাস বৈঠক করেন। তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপি দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এমন ভূমিকা দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে পারবে। মার্কিন তৎপরতার এমন সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ভারতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে অনুরোধ করেছি’ এমন মন্তব্য করে তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়েন। জুলাইয়ে ইইউর প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকা সফর করে। এরপর তারা ঘোষণা করে, নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকনির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে প্রায় তিন সপ্তাহের সফর শেষ করে পাঁচ দফা সুপারিশ করে। সেখানে সংলাপের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নানামুখী তৎপরতার প্রেক্ষাপটে বহুদিন অনেকটা নীরব থাকার পর ভারত নভেম্বর মাস থেকে সক্রিয় অবস্থান জানাতে শুরু করে। নভেম্বরে দিল্লিতে ভারতের সাথে আমেরিকার মন্ত্রিপর্যায়ের যে বৈঠক হয়, সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দেয়। এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। একটি বন্ধু এবং সঙ্গী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান জানাই আমরা। বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে রাশিয়া ও চীনের পক্ষ থেকেও বিবৃতি দেয়া হয়।

এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ তৎপরতা দেখা গেছে নভেম্বর মাসে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘পূর্বশর্ত ছাড়া’ সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে ১৩ নভেম্বর একটি চিঠি পাঠান। কিন্তু এ আহ্বানের পরও সংলাপে বসার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কোনো কর্ণপাত করেনি। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের জন্য মে মাসে নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। এই নীতির আওতায় কোনো বাংলাদেশী যদি দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা চেষ্টা করেন, তাহলে তাকে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই নীতির আওতায় পড়বেন বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশী কর্মকর্তা, সরকার-সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা। ভিসানীতি ঘোষণার চার মাস পরে সেপ্টেম্বরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশী কিছু নাগরিকের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রক্রিয়া শুরুর কথা জানায়। তবে এতে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।

সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি নিয়ে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকে বিএনপি। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল দলটি। বিএনপির সমাবেশের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ। বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন কর্মসূচি নামে এ সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপির সমাবেশ শেষ হয় উভয় পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ব্যাপক সংঘর্ষ ও সঙ্ঘাতের মধ্যে দিয়ে। সেদিন হামলা হয় প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবনে, পুলিশ লাইনস হাসপাতালে পোড়ানো হয় কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স। এ ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যসহ দুইজন নিহত হন। ওই নিহত ব্যক্তিকে নিজেদের কর্মী দাবি করে বিএনপি। মহাসমাবেশে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী-লীগ নেতাকর্মীরা হামলা করেছে অভিযোগ করে সাড়ে তিন বছর পরে হরতাল আহ্বান করে বিএনপি। এতে জামায়াতে ইসলামীও সমর্থন দেয়। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সারা দেশে শান্তি সমাবেশ ও মিছিল করার কথা জানায় আওয়ামী লীগ।

সমাবেশের পরের কয়েক দিনেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়। গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে যায় বেশির ভাগ বিএনপি নেতাকর্মীরা। বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সারা দেশে প্রায় ৬০০ মামলায় ২২ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ৪৪ হাজারের বেশি।

২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্যকাশে আরো কালো মেঘ ভর করার আশঙ্কা রয়েছে। বিরোধী দলগুলোর কোনো দাবি দাওয়া আমলে না নিয়ে ছয় দিন পরেই হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। যে নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপিসহ আরো প্রায় ৬৫টি রাজনৈতিক দল। নির্বাচনে যারা অংশ নিচ্ছে তারা সবাই আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী। কেউ দলের প্রতীকে, কেউ অন্য প্রতীকে কেউবা আওয়ামী লীগের সমর্থনে নির্বাচন করছে। নির্বাচনের দিন ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিএনপি নির্বাচন রুখে দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। নির্বাচন ঠেকাতে না পারলেও নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি সঙ্কটজনক হতে পারে বলে কেউ কেউ শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কারো কারো মতে, নির্বাচনের পরে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে সরব থাকা পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচনের পর তাদের অবস্থান কঠোর করতে পারে। যা দেশের অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে।

তবে আওয়ামী লীগ সরকার চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে যদি সবকিছু সামলে শাসনকার্য আগের মতোই নিরবচ্ছিন্ন রাখতে পারে তাহলে বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি নতুন এই বছরে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। মামলার ঘানি টানতেই টানতেই তাদের বছরের পর বছর পার হয়ে যেতে পারে। সরকারের হুঁশিয়ারি অনুযায়ী, দল হিসেবেও টিকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হতে পারে বিএনপিকে।

বাড়তে পারে অর্থনৈতিক সঙ্কট : ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ গরিব মানুষকে বেশি ভুগিয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ ২০ শতাংশের ওপরে। এর মানে একটি গরিব পরিবারের খরচ এক-পঞ্চমাংশ বেড়ে গেছে। কারো কারো ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি। কারণ চাল, ডাল, চিনি, আটা-ময়দা, শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম, পেঁয়াজসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। এগুলো কিনতেই স্বল্প আয়ের মানুষের আয়ের বেশির ভাগ চলে যায়। বছরজুড়েই বাজারে গিয়ে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামই কমবেশি বেড়েছে। বাজার খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। টানা ৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। এত দীর্ঘ সময় ধরে দেশে এমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি গত এক দশকে দেখা যায়নি। বছর শেষে এসেও মূল্যস্ফীতির আঁচে নাকাল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ ২০২৩ সালকে হয়তো জীবনযাপনের জন্য বিভীষিকাময় বছর হিসেবেই মনে রাখবেন।

চলতি বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে ব্রয়লার মুরগির মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। এক মাসেই ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে যায়। মার্চে গিয়ে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজির দাম সর্বোচ্চ ২৮০ টাকা পর্যন্ত ওঠে, যা জানুয়ারিতে ছিল ১৪০ টাকার আশপাশে। গত সেপ্টেম্বর থেকে দেশে আলুর বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। আর বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এসে পেঁয়াজের বাজারেও আগুন লাগে। দেশী পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ ছাড়া দফায় দফায় ডিম, কাঁচামরিচ ও চিনির মতো পণ্যের দাম বেড়েও নতুন রেকর্ড হয়েছে। সব মিলিয়ে বছরজুড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে। গত এক বছরে দাম দ্বিগুণ বা এর বেশি বেড়েছে দেশী ও আমদানি করা পেঁয়াজ ও রসুনের। আলুর দাম তো আরো বেশি চড়েছে। বছরের শুরুতে আলুর দাম যা ছিল, এখন তার চেয়ে তিন গুণ বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি উঠেছে বা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যেমন- চিনি, আদা, শুকনা মরিচ, ব্রয়লার মুরগি, জিরা ইত্যাদি। সরকার দামের লাগাম টানতে একপর্যায়ে পাঁচটি নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয়। পণ্যগুলো হচ্ছে- ডিম, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, চিনি ও আলু। কিন্তু বাজারে সয়াবিন তেল ছাড়া আর কোনো পণ্যের বেঁধে দেয়া দাম কার্যকর হয়নি।

বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকারকে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে উত্তরণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিতে পারলে রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রফতানি আয় ছাড়াও রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে যে ভয়াবহ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে উত্তরণ কঠিন হওয়ার আশঙ্কা আছে অনেকের মধ্যে।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং আহসান এইচ মনসুর দুজনেই গণমাধ্যমকে বলছেন, অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাটাই হবে নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু নির্বাচনের নৈতিক মানদণ্ডে দুর্বল একটি সরকারের পক্ষে তা সহজ হবে না।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখন যেহেতু আর বিশেষ কোনো নীতি সংস্কার হবে না, তাই নির্বাচনের পর দ্রব্যমূল্য, মুদ্রা বিনিময় হার ও ব্যাংক ঋণের সুদের হারে মনোযোগ দিতে হবে। আর খেয়াল রাখতে হবে ব্যাংক বা কোন খাতে যেন কাঠামোগত সঙ্কট না হয়। আবার বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয়।
উন্নয়ন ছাপিয়ে জনজীবনে অস্বস্তি কী শেষ হবে?

দেশকে উন্নতির দ্বারপ্রান্তে নিতে একের পর এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছে বর্তমান সরকার। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে নেয়া হয়েছে মেগা প্রকল্প। ২০২৩ সালে চালু হয়েছে পদ্মা রেল সংযোগ, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ, আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ রেলপথ, খুলনা-মংলা রেলপথ ও উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল। বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল। চীনের ঋণে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ চলছে। এই রেলপথ গেছে পদ্মা সেতু হয়ে। গত ১০ অক্টোবর পদ্মা রেল সংযোগের ৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা অংশ উদ্বোধন করেন সরকারপ্রধান। যাত্রীবাহী ট্রেন চলছে গত ১ ডিসেম্বর থেকে।

প্রশ্ন উঠেছে, উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে যাওয়া দেশের সাথে যাত্রী হিসেবে তার সাধারণ নাগরিকরা আছে কি? এই উন্নয়ন চিত্র কি সবার জন্য একই রকম? উন্নয়ন সত্ত্বেও জনজীবনে তেমন স্বস্তি নেই।

বিশ্বের সাত প্রধান তৈরী পোশাক উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি এখনো সবচেয়ে কম। বেশির ভাগ পোশাক শ্রমিকই তিন বেলা ভরপেট খাবার সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে। শোষিত হচ্ছে অনেক উচ্চ শ্রেণীর চাকরিজীবীও। কৃত্রিম হাসির আড়ালে তাদের মাঝেও রয়েছে বিদগ্ধ যন্ত্রণা। চাকরি হারানোর শঙ্কায় তাদের স্বাভাবিক পারিশ্রমিকটাই আদায় করতে পারছে না তারা। উল্টো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় তাদেরও প্রকৃত আয় কমছে। সাধারণ মানুষ মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। বাসাবাড়িতে খেতে বসে, আড্ডা, বিশ্রাম, টয়লেট সবকিছুতে বিধিবাম এই মশা। মাইলের পর মাইল বিদ্যুতের খুঁটি বসিয়ে শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮ ঘণ্টারও কম সময় বিদ্যুৎ থাকে।

বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দ্রব্যমূল্য দিন দিন ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলমূলে বিষ, মানুষ যা খায় তা-ই যেন ভেজাল। সড়কে নিরাপত্তা নেই, অগণিত প্রাণ ঝরছে অহর্নিশ। দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে সাধারণ মানুষের সেবার দ্বারগুলো রুদ্ধ হয়ে আছে। মেয়েরা নির্ভয়ে ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। গুম, খুন-ধর্ষণের বিচার পাচ্ছে না মানুষ।

নাগরিক জীবনের এমন দুর্বিষহ অবস্থা থেকে ২০২৪ সালেও যে পরিত্রাণ মিলবে, এমন কোনো লক্ষণ নেই। বরং তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে আরো গুরুতর হতে পারে। তবুও নতুনকে বরণ করে নেয়ার প্রবণতা মানুষের সহজাত। কেটে যাক সব অনিশ্চয়তা, ফিরে আসুক সুসময়। শুভ হোক নতুন বছর।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2