avertisements 2

বাড়ি বাড়ি পুলিশ পাঠাচ্ছে দুদক

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২১ আগস্ট,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:২৮ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪

Text

এবার বিভিন্নজনের বাড়ি বাড়ি পুলিশ পাঠাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। যাদের বাড়ি পুলিশ যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। থানায় নেই কোনো মামলাও। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশের খোঁজ করা ব্যক্তিদের তালিকা থেকে বাদ পড়ছেনা বিধবা,বিবাহযোগ্যা মেয়ে, দরিদ্র পরিবারের গৃহিনী, দরিদ্র কৃষিজীবী এমনকি দিন মজুর। পোশাকধারী এসব পুলিশ সদস্য বিভিন্নজনের বাড়িতে হানা দেয়ার পর মানবশূন্য হয়ে পড়েছে গ্রাম। পুলিশ আতঙ্কে অনেকে আশ্রয় নিয়েছে নিকটস্থ ভিন্ন থানা এলাকায় অবস্থিত আত্মীয়-স্বজনের গ্রামে। দৌড়া-দৌড়ি লেগে গেছে। ত্রাস সৃষ্টি হচ্ছে গোটা এলাকায়। তবে দুদক সচিব মো: মাহবুব হোসেন বিষয়টি অস্বীকার করে আজ (সোমবার) বিকেলে এ প্রতিবেদককে বলেন, দুদক কারও বাড়িতে কোনো পুলিশ পাঠায় নি। এমনটি হতে পারে না। তবে অভিযোগকারীকে প্রতিকার প্রদানের উদ্দেশ্যে পুলিশ যেতে পারে।

অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য মতে, দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধানের নামে বিভিন্ন ব্যক্তির বাড়ি বাড়ি পুলিশ পাঠাচ্ছে। এ যাবৎ অন্তত: ১৪ জনের বাড়ি হানা দিয়েছে পুলিশ। বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে পুলিশ যাদেরকে খোঁজ করেছে তারা হলেন, কুষ্টিয়ার কুমারখালি থানাধীন দহকোলা গ্রামের মজিবুর রহমান রহমানের পুত্র মো: নূরুল আলম, রাজবাড়ি জেলাধীন পাংশা থানার জীবননালা গ্রামের মরহুম মুন্সি মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীনের বিধবা স্ত্রী মোছা: রহিমা আক্তার, একই জেলার পাঁচটিকরি গ্রামের আব্দুল গফুর মন্ডলের স্ত্রী আসমা বেগম, বাহাদুরপুর গ্রামের ওমেদ আলী বিশ্বাসের পুত্র মো: আইয়ুব আলী, হাটগ্রাম গ্রামের সরাফত আলীর স্ত্রী আলেয়া বেগম, পাত্তিকাই গ্রামের ওয়াজেদ স্ত্রী হাসিনা বেগম, একই থানার তালিজৌ গ্রামের এবি খালেক শেখ’র পুত্র মো: কামরুল হাসান, পাত্তিকাই গ্রামের আব্দুল জলিল মন্ডলের পুত্র মো: রাজ্জাক ম-ল, গৌরনগর পশ্চিমপাড়া গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের স্ত্রী সুফিয়া বেগম, মধ্যপাড়া তেলিঝাউ গ্রামের হারেজ শেখের পুত্র শুক্কুর আলী শেখ, পাংশা থানার বাজেয়াপ্ত বিজলি গ্রামের নজর বাড়ৈর পুত্র অসিত কুমার বাড়ৈ, উরাকান্দা গ্রামের মো: আব্দুল প্রামাণিকের স্ত্রী ময়ুর জাহান নেসা, উত্তরকুমারী গ্রামের মহসিন আলীর কন্যা ফুলমতি বেগম, রাজবাড়ী সদর থানাধীন কাচরাকান্দা গ্রামের মো: জিন্নাত মন্ডলের স্ত্রী মোসা: রেশমা বেগম। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কুষ্টিয়া, কুমারখালি থানা পুলিশ রাজবাড়ী সদর থানা পুলিশ এবং পাংশা থানা পুলিশ বিভিন্ন সময় তাদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ করে। এর ফলে গোটা এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতার আতঙ্ক এবং পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচতে অনেক মানুষ আত্মগোপনে চলে গেছেন। গ্রামছাড়া হয়েছেন অনেকে। কিন্তু কি কারণে পুলিশ তাদের খুঁজছে এটি তারা নিজেরাই জানেন না। তবে পুলিশী হয়রানির শিকার একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, ‘হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি:’র নামক একটি প্রতিষ্ঠানে ইন্স্যুরেন্সের পলিসি করেছিলেন তারা। পলিসি ম্যাচিউড হওয়ার পরও ভুক্তভোগীরা তাদের ‘ক্লেইম’র টাকা পাচ্ছিলেন না। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জেলা ও জোনাল অফিসগুলোতে ধর্না দিয়েও তারা তাদের পাওনা পাচ্ছিলেন না। উপরন্তু দুর্ব্যবহারসহ নানাবিধ হয়রানি করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে তারা প্রতিকার চেয়ে তারা গতবছর দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করেছিলেন। অভিযোগ করেও তারা কোনো প্রতিকার পাননি। বরং কোনো ধরণের ব্যবস্থা না নিয়েই অভিযোগ থেকে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি প্রদান কিংবা বাছাই পর্ব থেকে অভিযোগটি গায়েব করে দেয়া হয়। ফলে পাওনা টাকা হাতে পাওয়ার পরিবর্তে এখন বাড়ি বাড়ি পুলিশ আসছে। অভিযোগকারীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। এতে পরিবারে ভীতি সঞ্চারের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদারও হানি হচ্ছে।

স্থানীয় থানা পুলিশের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগীদেরকে করা নোটিশ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নোটিশটি দেয়া হয়েছে দুদকের স্মারকের প্রেক্ষিতে। পাংশা মডেল থানার এএসআই (নি:) মো: শরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অসিত কুমার বাড়ৈকে করা নোটিশে (স্মারক নং ০০.০১.০০০০.৪১১.০১.০০৩.২০২৩.২৮৮১১ (৭), তারিখ : ০৭/০৮/২০২৩ খ্রি:) বলা হয়, উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, প্রাপ্ত অভিযোগের অনুসন্ধানকালে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনে আগামি ২২/০৮/২০২৩ খ্রি: সকাল ১০.৩০ ঘটিকার সময় জনাব মো: ইয়াছির আরাফাত ,উপ-পরিচালক , দুর্নীতি দমন কমিশন ,প্রধান কার্যাল,ঢাকা মহোদয়ের কার্যালয়ে হাজির থাকার জন্য অনুরোধ করা হইল।

এদিকে দুদকের একটি সূত্র জানায়, গ্রাহকদের ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও লোপাটের অভিযোগে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স’র চেয়ারম্যান,পরিচালকসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। হাইকোর্টের একটি নির্দেশনার প্রেক্ষিতে কমিশন এ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে একটি রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি মো: নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের ডিভিশন বেঞ্চ গত ২৯ মার্চ এ নির্দেশ দেন। ২ মাসের মধ্যে অনুসন্ধান সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। রিটে অর্থ সচিব, ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলিটরি অথোরিটির চেয়ারম্যান, দুনীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ প্রতিষ্ঠানটির ১৪ পরিচালককে বিবাদী করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে কমিশন উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) ইয়াসির আরাফতকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়। অনুসন্ধানটি চলছে দুদক পরিচালক (উপ-সচিব) কাজী সায়েমুজ্জামানের তদারকীতে।

সূত্রটি জানায়, অভিযোগ তফসিলভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময় দুদকের অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটি (যাবাক) ‘পীক অ্যান্ড চ্যুজ’র ভিত্তিতে অনুসন্ধানের সুপারিশ করে। এর ফলে অনেক সময় তফসিলভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতি ও আত্মসাতের অভিযোগেরও কোনো প্রকার অনুসন্ধান হয় না। ভুক্তভোগীলা দুদকে কোনো প্রতিকার না পেয়ে বাধ্য হয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শত কোটি টাকারও বেশি আত্মসাতের অভিযোগ তেমনই একটি।

সংস্থাটির অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জানান, অভিযোগকারী নয়-দুদকের লক্ষ্য অভিযোগের বিষয়বস্তু। সে ক্ষেত্রে কে অভিযোগ করলেন, কেন অভিযোগ করলেন, কার বিরুদ্ধে কিংবা কাদের অভিযোগ সেটিও দুদকের বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য, অভিযোগ তফসিলভুক্ত কি না। সে ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে খুঁজে বের করা, তার বক্তব্য গ্রহণ মুখ্য বিষয় নয়। জরুরি হচ্ছে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা, তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ প্রমাণে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ, তার জবানবন্দী গ্রহণ বা জিজ্ঞাসাবাদ। কারণ, দুদকের অনুসন্ধান প্রমাণভিত্তিক। দেশে ‘হুইসেল ব্লোয়ার অ্যাক্ট’ (সাক্ষ্য আইন) কার্যকর নয়। ফলে দুর্নীতির ঘটনায় সাক্ষ্যদানকারী কিংবা অভিযোগকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। কারণে অভিযোগকারীর পরিচয়,সঠিকতা নিরূপণ অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার মূল কাজ নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সংস্থাটির কোনো কোনো কর্মকর্তা অনেক সময় অসদুদ্দেশে অভিযোগকারীকেই আগে সনাক্ত করার চেষ্টা চালান। তলবি নোটিশ দিয়ে দুদকে হাজির করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। চূড়ান্তভাবে কার্যত: বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, অভিযোগকারী দুর্নীতির অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে তিনি নিজেই মস্তবড় অপরাধ করে ফেলেছেন। তার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণের দায়ি চাপিয়ে দেয়া হয় অভিযুক্তের ওপর। পক্ষান্তরে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিত্তশালী, প্রভাবশালী ও সমাজের নামী-দামী হলে তার ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হয়ে উঠেন অধিকমাত্রায় দায়িত্বশীল। তার সম্মান বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায়। তাদেরকে দেয়া নোটিশের ভাষা, তাদের সঙ্গে আচার-ব্যবহারও হয় ভিন্ন রকম। অনেক সময় দুদকে হাজির না হয়েও আইনজীবীদের মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য পাঠিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। একই প্রতিষ্ঠানের এমন দ্বৈত আচরণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এটি বৈষম্যমূলক বলে মনে করছেন সংস্থাটির অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা। এদিকে পুলিশ দিয়ে দুদকের নোটিশ সার্ভ করাকে ‘নব উদ্ভাবিত পদ্ধতি’ বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো: মঈদুল ইসলাম। তিনি বলেন, নোটিশ জারির ক্ষেত্রে পুলিশের সহায়তা নেয়ার কোনো বিধান দুদকে নেই। শুধুমাত্র যেসব ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগের বিষয় আছে, যেখানে আসামি গ্রেফতারের বিষয় আছে সেসব ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা নেয়ার কথা বলা আছে। তিনি বলেন, নোটিশ সার্ভ করার জন্য দুদকের নিজস্ব ব্যবস্থাই রয়েছে। প্রতিটি জেলায় সমন্বিত জেলা কার্যালয় (সজেকা) রয়েছে। সেখানে কনস্টেবলরা রয়েছেন। তাদের মাধ্যমেই নোটিশ পৌঁছানো যেতে পারে। নোটিশ জারিতে পুলিশের সহায়তার ঘটনা পূর্বে ছিলো না। এটি যুক্তিসঙ্গত কিংবা ন্যায়সঙ্গতও নয়। নতুন করে এই প্রথা শুরু হলে এটিকে নব উদ্ভাবিত পদ্ধতি বলা যেতে পারে। সাবেক এই দুদক কর্মকর্তার মতে, পুলিশের সহায়তায় নোটিশ জারি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। যেহেতু অনুসন্ধানটি উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে শুরু হয়েছে সেহেতু ঘটনাটি আদালতের দৃষ্টিতে আনা যেতে পারে।

এদিকে দুদকের কোন্ আইন ও বিধান মতে নোটিশ প্রদানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে-জানতে চাওয়া হলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াসির আরাফাত (উপ-পরিচালক)কে কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন কেটে দেন। একই প্রশ্নে ফোন করা হয় অনুসন্ধানটির তদারক কর্মকর্তা পরিচালক (উপ-সচিব) কাজী সায়েমুজ্জামানকে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনি ফোন ধরেন নি। কল-ব্যাকও করেন নি।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2