avertisements 2

লাশ ফেলে 'ভাই লীগ' অসহায় আ'লীগ

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ নভেম্বর, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:১১ এএম, ২৩ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৪

Text

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের চেয়ে শক্তিশালী 'ভাই লীগ' বলে কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য করেন খোদ নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। তথ্যানুসন্ধানে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সবই নিয়ন্ত্রিত হয় এই ভাই লীগ দ্বারা। কে কোন ভাইয়ের অনুসারী সে অনুযায়ী কেন্দ্র থেকেও গঠন করা হয় কমিটি। বণ্টন করা হয় পদ। তাই জিইয়ে থাকে কোন্দল। এখানে দুই নেতার অনুসারীরা প্রকাশ্যে লিপ্ত মারামারিতে। এক পক্ষ ফেলে অপর পক্ষের লাশ। আওয়ামী লীগ এসব দেখলেও ভাই লীগের দাপটে অসহায় তারা।'

এই গুরুতর মন্তব্যের উৎস হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই মনে করেন উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন দলের মধ্যে পরস্পরবিরোধী 'ভাই লীগের' পৃষ্ঠপোষক। তবে ইতোপূর্বেও জানতে চাইলে ওই দুই নেতা কখনও স্বীকার করেননি যে তারা দলের মধ্যে উপদল করেন। অথচ বহু বছর ধরে বহু সংঘাত, মারামারি ও খুনোখুনিতে মামলা দায়েরের ঘটনায় তাদের উপদলীয় চেহারা বা গ্রুপিং দৃশ্যগোচর হয়েছে।

নওফেল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। নাছির নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। এই দুই নেতার অনুসারীরা সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে ও শনিবার সকালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়ালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে মেডিকেল দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহাদি জে আকিব। তার মাথার খুলি ভেঙে টুকরো বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সে স্থানে মগজ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে খোলার কয়েকদিনের মধ্যেই ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আবার বন্ধ হয়ে গেল।

চট্টগ্রামের গ্রুপিং নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিব্রতবোধ করেন। সমকালকে তিনি বলেন, 'এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। যা বলতে হয় দলীয় ফোরামে বলব। চট্টগ্রামের কোন্দলের ব্যাপারে সেখানকার নেতাদের জিজ্ঞেস করুন।'

তবে আগে চট্টগ্রামে এসে একাধিকবার গ্রুপিং রাজনীতির সমালোচনা করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গ্রুপিংয়ে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদেরও সতর্ক করেছিলেন তিনি। ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, 'মশারির ভেতর মশারি টাঙাবেন না। দলকে উপদলে পরিণত করবেন না। নিজেদের বাহিনী তৈরি করবেন না। নেত্রীর কাছে সব খবর আছে।'

নগর আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, 'ভাই লীগের দাপটে চট্টগ্রামে অসহায় আওয়ামী লীগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা নিত্য দিনের চিত্র।' নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বলেন, 'মারামারি হানাহানির পর মামলা হয়। সেই মামলায় যাদের আসামি করা হয় তারা সবাই ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের নেতাকর্মী। ফলে অনেক কর্মীকে পালিয়ে বেড়াতে হয় বলে সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ছে এভাবে।'

হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়া মেডিকেল শিক্ষার্থী মাহাদি জে আকিবের বাবা মো. ফারুক বলেন, 'আমার ছেলে নষ্ট রাজনীতির শিকার হয়েছে। আজ মৃত্যুপথযাত্রী সে। অথচ ডাক্তার হওয়ার জন্যই তাকে মেডিকেলে পাঠিয়েছিলাম।'

অনেক মৃত্যু :শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ নয়, নগরের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সক্রিয় আছে নাছির ও নওফেল গ্রুপ। অন্তর্কোন্দলের কারণে এরই মধ্যে প্রাণ গেছে অনেক মেধাবী ছাত্রের। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনকে ঘিরে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি নগরের পাঠানটুলীতে আওয়ামী লীগ নেতা আজগর আলী বাবুল, ১৫ জানুয়ারি দেওয়ান বাজারে ওমরগনি এমইএস কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী আশিকুর রহমান রোহিত, ২০১৯ সালে পাহাড়তলীতে ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দীন সোহেল, ৩১ ডিসেম্বর বায়েজিদের শেরশাহ এলাকায় হকার্স লীগ নেতা মো. রিপন, ২০১৮ সালে চট্টেশ্বরীতে ছাত্রলীগ কর্মী আবু জাফর অনিক, ২৭ এপ্রিল নগরের ডিসি রোডে যুবলীগ নেতা ফরিদুল ইসলাম অন্তর্কোন্দলের বলি হয়ে প্রাণ হারান।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কর্মীদের এসব অন্তর্কোন্দল এবং নগরের দুই বড় নেতার অনুসারীতে বিভক্ত হয়ে পড়ার সর্বপরিজ্ঞাত কারণ হচ্ছে চাঁদাবাজির জন্য বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে আধিপত্য কায়েম ও তা বজায় রাখা। এ নিয়ে রক্তের হোলি খেলা চলছে যুগের পর যুগ ধরে। তাই তো ২০১৬ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রাণ হারান ছাত্রলীগ কর্মী নাসিম আহমেদ সোহেল। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী তাপস সরকার। ২০১৫ সালে বায়েজিদে খুন হন যুবলীগ নেতা মেহেদি হাসান বাদল। ২০১৩ সালে সিআরবি এলাকায় প্রাণ হারান সাজু পালিত ও শিশু আরমান। গত বছরে সদরঘাটে নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে খুন করে প্রতিপক্ষ গ্রুপ।

অশান্ত বিশ্ববিদ্যালয় :গ্রুপিং রাজনীতির শিকার হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশি ছাত্র হত্যার শিকার হয় ২০১০ সালে। ওই বছরে প্রাণ হারান রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের মহিউদ্দিন মাসুম, হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হারুনুর রশিদ ও মো. আসাদুজ্জামান। ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আরও ২ জন নিহত হন। ২০১৬ সালে নিজ বাসায় খুন হন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী। টেন্ডার বিরোধের জের ধরে নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীরাই তাকে খুন করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এক উপাচার্য বলেন, 'চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে দুই নেতার অনুসারীরা। কেন্দ্র এসব জানে। তারা কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে দুই নেতাকে খুশি করেই গঠন করে কমিটি। ফলে সারা বছরই লেগে থাকছে মারামারি, হানাহানি। পড়ছে একের পর এক লাশও।'

'ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ' ধাঁধা :চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নিষিদ্ধ ছিল ছাত্ররাজনীতি। তারপরও নাছির ও নওফেল গ্রুপ সেখানে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতো প্রকাশ্যে। একইভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরও প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম চলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। একাধিকবার ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরও মারামারি ও হানাহানি বন্ধ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৮ সালের ১০ নভেম্বর প্রথম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে ও ২০১৪ সালে আরও দুই দফা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েও দুই নেতার অনুসারীদের চাপে তা কার্যকর করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

দুই নেতার অবস্থান :চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রতিটি অঙ্গসংগঠনে নাছির-নওফেল গ্রুপ তৎপর থাকলেও দুই নেতার কেউই এই গ্রুপিংয়ের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি কখনোই। এ বিষয়ে কথা বলতে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে ফোন করলে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ বলে জানান। সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ফোন ধরেননি। করেননি।

তবে সর্বশেষ সিটি নির্বাচনের আগে অন্তর্কোন্দলের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, 'চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আমার কোনো গ্রুপ নেই। কোনো গ্রুপকে পৃষ্ঠপোষকতাও করছি না। অতি উৎসাহী হয়ে কেউ যদি নওফেল গ্রুপ পরিচয় দেয়, তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হোক।'
অভিন্ন মন্তব্য একাধিকবার করেছেন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও। গণমাধ্যমকে তিনিও বলেছিলেন, 'আমার নাম ব্যবহার করে কেউ যদি কোনো অপকর্ম করে তার দায়ভার তাকেই নিতে হবে। এখানে কোনো গ্রুপিং নেই। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ আছে।'

তবে পাল্টাপাল্টি মামলা :নাছির ও নওফেলের কেউ গ্রুপিংয়ের কথা স্বীকার না করলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা করেছে তাদের অনুসারীরা। নগরীর পাঁচলাইশ থানায় শনিবার রাতে নাছিরের অনুসারী ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন চমেকের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. তৌফিকুর রহমান। এই বাদী চমেক ক্যাম্পাসে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে নাছিরের অনুসারীরা এক দিন পর পাল্টা মামলা করেছে নওফেলপন্থিদের বিরুদ্ধে। রোববার রাতে চকবাজার থানায় তারাও ১৬ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করেন। এই মামলার বাদী চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান। তিনি ক্যাম্পাসে নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। চমেকের ঘটনায় আগে নাছিরপন্থি ৬১ ব্যাচের মাহফুজুল হক ও ৬২ ব্যাচের নাইমুল ইসলাম আহত হন। এটির প্রতিশোধ নিতে পরের দিন গুরুতর আহত করা হয় নওফেলপন্থি মাহাদি জে আকিবকে।
এর আগেও চমেকে একই ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা করেছে নাছির ও নওফেল গ্রুপ। মারামারির আরেক ঘটনায় ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল পাঁচলাইশ থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়। এতে নওফেলের অনুসারী পঞ্চম বর্ষের ছাত্র রিয়াজুল ইসলাম জয় বাদী হয়ে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। আসামিরা সবাই নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। একই ঘটনায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে পাল্টা আরেকটি মামলা করেন নাছিরের অনুসারী ডা. হাবিবুর রহমান। এখানে যাদের আসামি করা হয়েছে তারা সবাই নওফেলের অনুসারী।

ভাগাভাগি ও ভারসাম্য :চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠনের আগে কোন্দলের বিষয়টি মাথায় রাখে কেন্দ্র। উভয় গ্রুপকে খুশি করেই কমিটি গঠন করে তারা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে যত কমিটি হয়েছে তার শীর্ষ পদে একজন নওফেলের অনুসারী হলে অন্যজন ছিলেন নাছিরের অনুসারী। ২০১৯ সালে গঠিত বর্তমান কমিটির সভাপতি রেজাউল হক রুবেল নওফেলের অনুসারী। সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু হচ্ছেন আ জ ম নাছিরের অনুসারী। ২০১৫ সালে গঠিত কমিটির সভাপতি আলমগীর হোসেন টিপু ছিলেন আ জ ম নাছিরের অনুসারী। সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজন ছিলেন নওফেলের অনুসারী। ২০১১ সালে গঠিত কমিটিতে সভাপতি মামুনুল হক ছিলেন নওফেলের বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। সাধারণ সম্পাদক এমএ খালেদ চৌধুরী ছিলেন আ জ ম নাছিরের অনুসারী।

কেন্দ্র থেকে এভাবে দলে কোন্দলের অবসান না ঘটিয়ে ভাগাভাগি বা এক রকম 'ভারসাম্য' করে কমিটি গঠিত হওয়ায় চবিতে মারামারি, হানাহানি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। গত মাসেও চবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ একাধিকবার হামলা-পাল্টা হামলায় লিপ্ত হয়েছে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2