করোনায় বাবা-মাকে হারিয়ে চিকিৎসক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ জুলাই,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:২৫ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করতেন ডা. জাকি উদ্দিন। করোনা মহামারিতে তিনি অনেক মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। কিন্তু ছয় মাসের ব্যবধানে করোনায় নিজের মা-বাবাকে হারিয়ে ডাক্তারি পেশার ওপর ক্ষুব্ধ তিনি। এ অবস্থায় ‘ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দেয়া উচিত’ বলে গত বুধবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এই চিকিৎসক।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মরহুম বাবা ও মায়ের জন্য দোয়া করবেন। কোভিড রোস্টারে নাইট ডিউটিতে ছিলাম। আব্বুর অবস্থা খারাপ শুনে ডিউটি থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসলাম। কিন্তু আটকাতে পারলাম না। জ্ঞান থাকা অবস্থায় বলতেছিল, বড় বাবু ব্যবস্থা করবে। আমি আব্বু-আম্মুর খুব সুন্দর ব্যবস্থা করে দিছি। একদম এতিম হয়ে গেছি ছয় মাসের ভেতর। কোভিড দিয়ে মেরে ফেলছি। নো প্যারেন্টস ডিজার্ভ অ্যা চাইল্ড লাইক মি, হু কিলস দেয়ার প্যারেন্টস উইদইন সিক্স মানথস (কোনো বাবা-মায়ের যেন আমার মতো সন্তান না থাকে, যে তার বাবা-মাকে ছয় মাসের মধ্যে মেরে ফেলেছে)। আই থিঙ্ক আই শেল নট কন্টিনিউ দিজ প্রফেশন এনিমোর (আমার আর এই পেশায় থাকা উচিত না বলে মনে করি)।’
জাান গেছে, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা না থাকায় কুমিল্লার রেসকোর্সের বাসা থেকে হাসপাতালে আসা-যাওয়া করতেন ডা. জাকি উদ্দিন। ছয় মাসে আগে মা-বাবা ও ছোট বোনসহ করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাদেরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার মা ও চান্দিনা বড় গোবিন্দপুর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক জাহানারা নাসরিন (৫৬) মারা যান। তবে করোনা থেকে সুস্থ হলেও ডা. জাকিরের প্যারালাইজড বাবা সালাউদ্দিনের (৬৬) নানা উপসর্গ দেখা দেয়।
গত বুধবার রাতে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বোনের কাছে বাবার অসুস্থতার খবর শুনে দ্রুত বাসায় ছুঁটে যান ডা. জাকি। এরপর কুমিল্লার একটি হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর তার মৃত্যু হয়। ডা. জাকির ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দেওয়ার পর চিকিৎসকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে ৩৯তম বিসিএসের ৪০ জন চিকিৎসক, কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের ১২০ জন সহকারী অধ্যাপক ও হাসপাতালের সুপারভিশনে থাকা চিকিৎসকসহ ১৫০ জন কোভিড ইউনিটে সেবা প্রদান করছেন। পাশাপাশি রয়েছেন নার্স ও অন্যান্য স্টাফরা। সবমিলিয়ে প্রায় তিনশ জন কোভিড ইউনিটে সেবা দিচ্ছেন।
হাসপাতালটিতে করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গের রোগীদের চিকিৎসা সেবা শুরু হওয়ার পর চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য আলাদাভাবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখার জন্য কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ অফিস, কুমিল্লা ক্লাব ও আবাসিক হোটেল গোল্ডেন টাওয়ারে ব্যবস্থা করা হয়। কিছুদিন পর ঠিকাদারদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টাইনে ব্যবস্থা বাতিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া প্রণোদনার কথা উল্লেখ থাকলেও কুমিল্লার কোনও চিকিৎসকই প্রণোদনা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
বিএমএ কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক ডা. আতাউর রহমান জসিম বলেন, ‘কী বলবো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি! ছয় মাসের ব্যবধানে তরুণ ডাক্তারটি মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেলো। তার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে দায়িত্বরতদের জন্য কোয়ারেন্টাইন বা আবাসিক ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করছেন। কত টাকা এই দেশে অপচয় হয়! পুকুর কাটা, খিচুড়ি রান্না, কলাগাছ লাগানোসহ প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণ, কেনাকাটার লাগামহীন আকাশচুম্বী দাম, নাম জানা, নামসর্বস্ব প্রজেক্ট কত খাতেই তো অর্থ অপচয় হয়। এ ব্যাপারে তাদের জন্য কী উন্নত ব্যবস্থাপনা করা যায় না?’
ডা. আতিক নামে কোভিড ইউনিটের এক চিকিৎসক বলেন, ‘প্রণোদনা নেই, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। আবার সরকারি চাকরি করি বলে কিছু বলতেও পারব না। এ কেমন কথা? আমরা কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থাসহ সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।’
এ ঘটনায় শোক বার্তা দিয়েছে ৩৯ তম বিসিএস সমিতি। ডা. জাকির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি চিকিৎসকদের সকল প্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, ‘জাকিরের বাবা-মা হারানোর ঘটনা বেদনাদায়ক। এখানে কাজ করা সবাই বেশ ঝুঁকিতে আছেন। আমরা সরকারি চাকরিজীবী। মন্ত্রণালয় যেভাবে চাইছে সেভাবে কাজ করছি। কিছু পরিবর্তনের সামর্থ্য তো আমাদের নেই! আশা করি মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে ভাববে।’