নৌপথে রাতের নীরব ঘাতক বাল্কহেড
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৮ অক্টোবর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৪৩ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৫

বুড়িগঙ্গাসহ নৌপথে সন্ধ্যার পর থেকে বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানছে না অবৈধ বাল্কহেড চালক ও মালিকরা। বালুবাহী এসব নৌযান বেপরোয়াভাবে চলাচল করায় নৌপথে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, ঘটছে প্রাণহানি। অনেক ক্ষেত্রে এসব বাল্কহেডে সিগন্যাল বাতিও থাকে না।
আবার চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় আলো নিভিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে। এতে খেয়া দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পারাপার হওয়া যাত্রীদের আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। ফলে নৌপথে রাতে নীরব ঘাতক হয়ে উঠছে বাল্কহেড।
অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো স্থানে নৌ পুলিশ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বাল্কহেড রাতের বেলা চলাচল করছে। এতে বখরা দিতে হয় সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিআইডব্লিউটিএ, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, নৌ পুলিশ এবং নৌযান মালিকদের অবহেলার কারণে নৌপথ এখনো নিরাপদ হয়ে ওঠেনি। বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে টনক নড়ে না কারও।
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার খিদিরপাড়া ইউনিয়নের ডহরী তালতলা এলাকায় গত ৫ আগস্ট রাতে বাল্কহেডের ধাক্কায় একটি ট্রলার ডুবে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, পদ্মা নদী থেকে ফেরার পথে রাত হয়ে যাওয়ায় ট্রলার চালক আলো জ্বালিয়ে দেখছিলেন একটু পরপর। তবে যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে আর আলো জ্বালাননি তিনি। এ সময় উল্টো দিক থেকে আসা বাল্কহেডেরও কোনো লাইট ছিল না।
তাই সেদিক থেকেও কোনো আলো দেখা যায়নি। মুহূর্তেই বিকট শব্দে ট্রলারটি কাত হয়ে ডুবে যায়। এ ঘটনায় ৮ জন নিহত হন। এর আগে গত ১৬ জুলাই রাত সাড়ে ৮টার দিকে কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে সদরঘাটের কাছে শ্যামবাজারের লালকুঠি ঘাটে আসার পথে বাল্কহেডের ধাক্কায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যায় একটি ওয়াটার বাস। এতে মারা যান ৩ জন। বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা) মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, বাল্কহেড রাতের বেলায় চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ। এর রুট পারমিট বিআইডব্লিউটিএ দেয় না। এর তদারকি করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। তারা বাল্কহেডের সার্ভে ও ফিটনেস সনদ দেয়। আমরা বিভিন্ন সময়ে রাতের বেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি। সম্প্রতি সদরঘাটে দুটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে।
এ ছাড়া নৌ পুলিশ কাজ করছে। আমরা বাল্কহেড মালিক-চালক সমিতির নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেছি। তাদের বারবার বলা হয়েছে, বাল্কহেড রাতের বেলায় চলাচলের উপযোগী নয়। তারপরও অবাধে এগুলো চলাচল করছে। তিনি আরও বলেন, বালুবাহী বাল্কহেড ও ট্রলারের বিরুদ্ধে মেরিন কোর্ট আইনে মামলা করা হবে। রাতে যাতে বাল্কহেড চলতে না পারে, সেজন্য অভিযান জোরদার করা হচ্ছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট অফিসারদের চিঠি পাঠানো হয়েছে।
বালুবোঝাই বাল্কহেডে কোনো আলোর ব্যবস্থা থাকে না। মাত্র এক থেকে দেড় ফুট উপরিভাগে থাকলেও এ নৌযানের বেশিরভাগই থাকে পানির নিচে। কখনো কখনো বাল্কহেডের ওপর দিয়ে পানি বয়ে যেতে দেখা যায়। তাই এটি রাতের বেলায় চলাচলের উপযোগী নয়। এ ছাড়া অধিকাংশ বালুবাহী নৌযানের অনুমোদিত নকশা, বার্ষিক ফিটনেস সনদ (সার্ভে) ও নিবন্ধন নেই। দেশে ৪ হাজার ৭০০টি বাল্কহেডের নিবন্ধন থাকলেও চলছে প্রায় ১১ হাজার। বেশিরভাগ বাল্কহেডের মাস্টার অদক্ষ।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে ৩৬টি নৌ-দুর্ঘটনার অর্ধেকের বেশি হয়েছে বাল্কহেডের কারণে। এদিকে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত দেশে ৪৯টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন, আহত ৭ জন এবং নিখোঁজ ১২ জন। শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত ছয় মাসে নৌপথে ৫৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৭ জন। আহত হয়েছেন ৫০ জন, নিখোঁজ রয়েছেন ৩৪ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের জীবিত খুঁজে পাওয়ার নজির নেই। এই হিসেবে ছয় মাসে নিহতের সংখ্যা হবে ৯১ জন।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জানুয়ারিতে পাঁচটি নৌ দুর্ঘটনায় ৮ জন নিহত, ৫ জন আহত ও ৬ জন নিখোঁজ হয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ১৩টি নৌ দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত, ২৪ জন আহত ও ১৪ জন নিখোঁজ হন। মার্চে সাতটি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৯ ও ৫। এ মাসে নৌ দুর্ঘটনায় কেউ নিখোঁজ হননি। এপ্রিলে ৯টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হয়েছেন। আহত ও নিখোঁজের সংখ্যা যথাক্রমে ৬ ও ৩। মে মাসে সাতটি দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহত, ৩ জন আহত ও ৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন। জুন মাসে নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৩টি। এতে নিহত, আহত ও নিখোঁজ হয়েছেন যথাক্রমে ১০, ৭ ও ৮ জন।
রাতে জাহাজ চলে না জানিয়ে বাল্কহেড চালক সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ইচ্ছে করলেই জাহাজ এক জায়গায় ঢুকিয়ে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। যেমন মাওয়া থেকে ছেড়ে আসা একটি বাল্কহেড এখলাসপুর ঘাট ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারবে না। মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি ধর্মগঞ্জ এসে ঘাট দেবে। আবার মোহনপুর থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি মুন্সীগঞ্জের ঘাট ধরতে পারবে। অনেক সময় কোনো জাহাজ আসা-যাওয়ায় এক-দেড় ঘণ্টার তারতম্য ঘটতে পারে। এ কারণে একটু রাত হয়ে যায়। কিন্তু বাল্কহেড রাতে চলাচল করে না।
অথচ সরজমিনে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পোস্তগোলা থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত বালুবাহী বাল্কহেড চলতে দেখা গেছে। সন্ধ্যার পর থেকে চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় বাল্কহেড চালকরা আলো নিভিয়ে চলাচল করছেন। আর এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে পথে পথে নৌ ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা টহল দিয়ে এসব বাল্কহেড থেকে চাঁদা নিচ্ছে। বুড়িগঙ্গায় পোস্তগোলা থেকে বসিলা ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার খেয়া নৌকায় প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ পারাপার হয়ে থাকেন।
এর মধ্যে বেশির ভাগ শ্রমিক। তারা সদরঘাট, মিটফোর্ড ও বাদামতলী ছাড়াও পুরান ঢাকার বিভিন্ন কলকারখানায় কর্মরত। ভোর ৪টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত নৌকা পারাপারে খুব ভিড় থাকে। এছাড়া কেরানীগঞ্জ, আমিনবাজারে বসবাসকারী বাসিন্দারা দিনব্যাপী খেয়া দিয়ে এপার-ওপারে যাতায়াত করে থাকেন। নদীর ওপারের বাসিন্দারা সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্তও যাতায়াত করেন। এদিকে সন্ধ্যার পর বুড়িগঙ্গায় বাল্কহেড চলাচল করে। এতে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনা ঘটছে।
একাধিক বাল্কহেড চালক জানান, মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকা গাবতলীর আমিনবাজার পর্যন্ত নৌপুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। না দিলে অহেতুক হয়রানি করে। সবচেয়ে বেশি হয়রানি করছে সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ। যেসব স্পটে নৌপুলিশকে চাঁদা দিতে হয় তা হলো মুন্সীগঞ্জ, বক্তাবলি, পাগলা, পোস্তগোলা, সদরঘাট, বরিসুর ও বছিলা। পথে পথে বিভিন্ন হারে নৌ পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। নানা অজুহাতে নৌযান আটকিয়েও মোটা অংকের টাকা নিয়ে থাকে। বিআইডব্লিউটিএর লোকজন কাগজপত্র দেখার নামে মাসোহারা নেয়।
বুড়িগঙ্গায় খেয়াপারাপার শতাধিক মাঝি এ প্রতিবেদককে জানান, বুড়িগঙ্গায় হাজারের বেশি মাঝি ও নৌকা রয়েছে। চোখের সামনে দেখেও সহসা গতি কমায় না বাল্কহেড চালকরা। ওইসব নৌযানের ধাক্কায় প্রতিদিন দুই থেকে চারটি খেয়া নৌকা ডুবে যায়। প্রায়ই কেউ না কেউ মারা যায়। নৌপুলিশ এসব দেখেও না দেখার ভান করে। নৌপুলিশ ওইসব বাল্কহেড থেকে প্রাকাশ্যে টাকা নিচ্ছে।
নৌ পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, নৌপথ নিরাপদ রাখতে নৌ পুলিশ সব সময় কাজ করছে। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সম্প্রতি চাঁদপুরের মেঘনায় অভিযান চালিয়ে ২৮টি বালুবাহী বাল্কহেড ও ৩টি ড্রেজার জব্দ করেছে নৌ পুলিশ। এ ঘটনায় আটক করা হয়েছে ৬২ শ্রমিককে। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। নৌপথে বালুবাহী বাল্কহেডে নৌ পুলিশের চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যদি কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
এই বিভাগের আরো খবর

ডিবি হারুনের ভয়ভীতি দেখিয়ে ১৬ কোটি আত্মসাৎ, ব্যবসায়ীর মামলা

কুবি ছাত্রী সুমাইয়াকে ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা: আসামির স্বীকারোক্তি

আলোচিত সাদাপাথর লুটের ঘটনায় পদ হারানো সেই বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার

মা-মেয়েকে হত্যার অনুসন্ধান: আসামি সেই কবিরাজের বিরুদ্ধে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর
