আশ্বিনে শ্রাবণের বৃষ্টি!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৩৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
এবার আশ্বিনের বৃষ্টি আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিকেও হার মানিয়েছে। এ বছর বর্ষায় বৃষ্টি কম হয়েছে। অথচ অসময়ে চলছে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি। এই বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েছেন রাজধানীবাসী। রাজধানীর অনেক এলাকায় সড়কে হাঁটু পানি জমেছে। এতে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। অনেকে সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারেননি। জলবায়ুর পরিবর্তন ও মৌসুমি বায়ুর দিক পরিবর্তনের ফলে এখন বৃষ্টি হচ্ছে। আশ্বিনের এই বৃষ্টি অস্বাভাবিক। এই বৃষ্টি কৃষির ক্ষতি করছে। অতিবৃষ্টির ফলে বিশেষ করে উঠতি আলু, পেঁয়াজ, সবজি, ভুটা. গম ও আগাম শীতকালীন সবজি এবং আমন ধানের ক্ষতি হবে। অতি বৃষ্টির ফলে জলাবদ্ধতা ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ বিপদে পড়ছেন।
সকাল থেকেই আকাশ থাকে উজ্জ্বল ঝলমলে অপূর্ব রোদের হাতছানি। দুপুর পর্যন্ত চলে রোদের খেলা। এরপর গুমোট হতে থাকে আকাশ। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই ঢাকায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে অঝোর ধারায়। হঠাৎ বৃষ্টিতে জবুথবু রাজধানীর মানুষ। এরপর বৃষ্টি আকাশে লুকিয়ে পড়ে। আবার সন্ধ্যার পর ভারি বৃষ্টিপাত নামে। আবহাওয়ার এমন আচরণ যেন নিয়মিত হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে আবহাওয়ার এমন খামখেয়ালি দেখছে ঢাকার মানুষ। সাধারণত মৌসুমি বায়ুর বিদায় বেলায় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পায়। এবারও তাই হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগর থেকে আসা লঘুচাপের প্রভাবেও বাড়ছে বৃষ্টি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দেশের মানুষ। গত কয়েক বছর ধরে ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে অসময়ের বৃষ্টি হচ্ছে দেশে। অথচ এ বছর আষাঢ়-শ্রাবণেও বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি। ৪২ বছরের মধ্যে দেশে ৫৭ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি, জীবন ও প্রকৃতিতে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেল (আইপিসিসি) বলছে, শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিপুল কার্বন নিঃসরণের ফলে বৈরী হয়ে উঠছে আবহাওয়া। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মমতার শিকার বাংলাদেশ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, চলতি মাসজুড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ার কারণে দিনের তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে। চলতি মাসের মধ্যে মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকা থেকে বিদায় নিতে পারে। মৌসুমি বায়ুর বিদায় বেলায় সাধারণত বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। এবারও তাই হয়েছে। এ ছাড়া লঘুচাপের প্রভাবেও বৃদ্ধি পেয়েছে।
আশ্বিনের বেরসিক এই বৃষ্টিতে রাজধানীতে গত বৃহস্পতিবার চলতি বছরের মধ্যে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টির রেকর্ড হয়েছে। রাতে ৬ ঘণ্টায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। টানা বৃষ্টির পর রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায়। অনেক রাস্তা তলিয়ে গিয়ে যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃষ্টিতে রাজধানীর সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, বংশাল, নাজিরাবাজার, মুকিমবাজার, গোপীবাগ, খিলগাঁও, শান্তিনগর, নয়াপল্টন, রাজারবাগ, দক্ষিণখান, উত্তরা, রামপুরা, নাখালপাড়া, হাতিরঝিল, মধুবাগ, আদাবর, সাতরাস্তা, কাওলা, মগবাজার, মিরপুর, পান্থপথ, গ্রিনরোড, কমলাপুর, পুরান ঢাকার বংশাল, মুহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, নাজিমুদ্দিন রোড, ধানমণ্ডি, মিরপুর ১৩ সহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। এর পরের দিন শুক্রবার দুপুরে সরজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিউমার্কেট এলাকা ও এর আশপাশসহ মার্কেটের ভেতরে পানি জমে আছে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও বেশি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুল হক বিশ্বাস বলেন, আবহাওয়া ক্রমেই বৈরী আচরণ করছে। সময়ে বৃষ্টির দেখা মিলে না, অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি চলছে। আশ্বিনের প্রথম হঠাৎই বৃষ্টির আক্রমণ শুরু হয়। থেমে থেমে হালকা বৃষ্টি। প্রথমে মনে হচ্ছিল ইলশেগুঁড়ি, টিপ টিপ বৃষ্টিই চলবে। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে তার রূপ বদলেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে সে হালকা বৃষ্টি রূপ নিয়েছে ভারি বর্ষণে।
আশ্বিনের সন্ধ্যায় ঢাকায় নামল শ্রাবণের বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে পড়া বর্ষণে তলিয়ে যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তা। বৃষ্টিতে জলমগ্ন মিরপুরে সড়কের পাশে বিদ্যুৎতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, এতে দীর্ঘযানজট হয়। দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। অফিস ফেরত মানুষ অফিস থেকে বের হয়েই বৃষ্টির দুর্ভোগে পড়েন। এরমধ্যে অতিরিক্ত বর্ষণ এবং জলাবদ্ধতার কারণে পুরো শহরে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। বিমানবন্দর সড়ক, তেজগাঁও থেকে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর, মালিবাগ থেকে খিলক্ষেত, মিরপুর-১০ থেকে বিজয় সরণি, মিরপুর কালসী রোড, কারওয়ান বাজার হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় যানজটের মাত্রা। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের যানজটের প্রভাব পড়ে মিরপুর ইসিবি চত্বর পর্যন্ত। কাজীপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকায় যানজট ছিল ভয়াবহ। বৃষ্টিতে ভিজে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের যানজট পরিস্থিতি সামাল দিতে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। কাকলী থেকে মগবাজার পর্যন্ত যানজট ছিল অসহনীয়। এতে কর্মমুখী মানুষ পড়েন বিপাকে। যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে যাত্রীদের।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত শুক্রবার দেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে নীলফামারীর ডিমলায়। সেখানে ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরেছে। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি পড়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, কয়েক বছর ধরে রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় অসময়ের (আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ) মাসে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। গত বছর ২৫ অক্টোবর রাজধানীতে একদিনে ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া বিজ্ঞানে সাধারণত অতি ভারী বৃষ্টি দিনের বেলা হয়ে থাকে। ঢাকায় বৃহস্পতিবারের বৃষ্টি শুরু হয় সন্ধ্যার পর। গত বছর ২৫ অক্টোবর রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টায় ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। সেটিও ছিল দিনের বেলায়।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শস্য উৎপাদন পঞ্জিকা বৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্ষার নতুন পানিতে আমন ও আউশ রোপণ করেন কৃষক। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বজ্রপাত শুরু হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোতে মা-মাছ গিয়ে ডিম পাড়ে। এ সময় পাট জাগ দিতেও প্রয়োজন হয় পানির। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। সময়ে দেখা না মিললেও অসময়ে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। জলবায়ুর প্রভাব পড়ছে কৃষি ও জনজীবনে। আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই।