গ্রামাঞ্চলের মানুষও ব্যাপকহারে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৭:৫২ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
গত ১৯ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম থাকলেও এদিনের পর থেকে তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করে। গত ২০ জুলাই ঢাকায় ৮৪৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ৯১০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। অর্থাৎ ওইদিন ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে মাত্র ৬৫ জন রোগী বেশি ছিল। অথচ ২৮ আগস্ট ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ৯১৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৪১৩ জন। এ হিসাবে প্রায় ৪০ দিনের ব্যবধানে ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে রোগী বেড়েছে ৪৯৫ জন। এছাড়া চলতি বছরের জুনের আগ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে আক্রান্ত রোগীর হার ছিল মাত্র ৩১.৮৪ শতাংশ। যা বেড়ে আগস্ট মাসের শেষভাগে এসে দাঁড়িয়েছে ৬০.৬১ শতাংশে। অথচ গত বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর হিসাবে ঢাকার বাইরে এ হার ছিল মাত্র ৩৭.১২ শতাংশ।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার বাইরে শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীই বাড়েনি, মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। যদিও ঢাকার তুলনায় এখনো মৃত্যুর হার যথেষ্ট কম। তবে চিকিৎসকদের আশঙ্কা, ঢাকার বাইরে যেভাবে জ্যামিতিক হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে সেখানে সহসাই মৃত্যুর সংখ্যা ও হার দুই-ই বাড়তে পারে। বিশেষ করে যেসব জেলা শহর, উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা ব্যবস্থা সংকট রয়েছে, সেখানে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু সংখ্যা কম দেখা গেলেও তা প্রকৃত চিত্র নয় বলে মনে করেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তাদের ভাষ্য, ঢাকা মহানগরীতে বিপুলসংখ্যক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা দ্রুত চিকিৎসা নিতে পারছে। তবে ঢাকার বাইরে পর্যাপ্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও উন্নত চিকিৎসা সেবা না থাকায় ডেঙ্গুর জটিল রোগীরা দ্রুত ঢাকায় ছুটে আসছেন। সেখানে তাদের অনেকে মারা যাচ্ছে।
মৃতের এ সংখ্যা ঢাকার তালিকার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কিছু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। যা সেখানকার মৃত্যু তালিকার বাইরে থাকছে। ঢাকার হাসপাতালে মারা যাওয়া রোগীদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার অবস্থান বিশ্লেষণ করা হলে এদের একটি বড় অংশ ঢাকার বাইরের পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তারা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নেওয়ার বেশকিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। তারা জানান, ঢাকা মহানগরীতে মশা মারার নামকাওয়াস্তে কিছু ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামাঞ্চলসহ উপজেলা ও বেশিরভাগ জেলা শহরে তা নেই। ফলে সেখানে মশা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। ঢাকার বাইরে এখন বিভিন্ন এলাকায় অনেক নির্মাণ কাজ হওয়ায় রিজার্ভার ট্যাংকিসহ নানা স্থানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকার সুযোগ রয়েছে। এসব জায়গায় এডিস মশা সহজে জন্মাতে পারে। তাই মশা নিয়ন্ত্রণ করাই এখন বড় ব্যাপার। ঢাকার মতো ঢাকার বাইরেও আগামী নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন কীটতত্ত্ববিদরা।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ নেওয়ার কারণ সম্পর্কে বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডাক্তার নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় মশা মারার ব্যবস্থা থাকলেও গ্রামে তা নেই। নগরায়ণের কারণেও এই মশা শহর থেকে গ্রামে চলে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে আক্রান্ত এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। কারণ সেখানকার হাসপাতালগুলো সেভাবে প্রস্তুত নেই। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় রোগীরা বেশি ঢাকামুখী হচ্ছেন। এই জনস্বাস্থ্যবিদ জেলা ও বিভাগীয় শহরের বড় বড় হাসপাতালগুলোকে আরও সক্ষম করে তোলার পরামর্শ দেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডক্টর কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত এই কয়েকটি বিষয়কে সিমুলেশন মডেলের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মনে হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার বে-নজির আহমেদ বলেন, জেলা ও মফস্বল শহরগুলোতেও অপরিকল্পিত নগরায়ণ বাড়ছে, এটি একটি কারণ। গ্রামাঞ্চলেও নানা ধরনের যানবাহন ব্যবহার হয়। এসব যানবাহনের পুরনো টায়ার যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হচ্ছে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ এখন এত নিবিড়, ঢাকা থেকে একটা বাস কোনো না কোনো জেলা শহরে যাচ্ছে। এই বাসের সঙ্গে এডিস মশা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এডিস মশা স্থায়ী হয়ে উঠছে। বংশ বিস্তার উপযোগী পরিবেশ পেয়ে প্রজনন করছে। শহরের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সঙ্গে করে ভাইরাস নিয়ে যাচ্ছে; আবার গ্রাম থেকেও শহরে আসছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ঢাকার বাইরে রোগী বাড়তে থাকায় বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ঢাকার বাইরের এলাকাগুলো ভাইরাসের জন্য অবারিত ক্ষেত্রে পরিণত হয়ে উঠছে। নভেম্বর পর্যন্ত এ অবস্থা থাকতে পারে। পরিস্থিতি আগামীতে আরও কতটা ভয়ংকর হবে তা এখনই অনুমান করা অসম্ভব।
দেশের খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, পরিস্থিতি যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। রোগী বাড়লে মৃত্যুও বাড়তে পারে। মশা নিয়ন্ত্রণ করাই এখন বড় ব্যাপার।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে শিশুদের ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার কম। ঢাকায় শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুর ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ৯ শতাংশ হলেও ঢাকার বাইরে তা মাত্র ৪ শতাংশ। ৬ থেকে ১০ বছর বয়সি শিশুর আক্রান্তের হার ঢাকায় ৮ শতাংশ, ঢাকার বাইরে ৪ শতাংশ। ঢাকায় ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সি ৮ শতাংশ শিশুর ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও ঢাকার বাইরে এ হার ৭ শতাংশ। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দুই জায়গাতেই ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সি নারী-পুরুষ সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও এ হারেও যথেষ্ট হেরফের রয়েছে। ঢাকায় এ হার ১৪ শতাংশ, ঢাকার বাইরে ১৭ শতাংশ।
অন্যদিকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরে আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ৭ হাজার ৬৪১ জন বেশি হলেও ডেঙ্গু শনাক্ত নারীর সংখ্যা ১ হাজার ৪৫৩ জন কম। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত সবাই সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এছাড়া নারী ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে যাওয়ার প্রবণতা কম। সে কারণেই ঢাকার বাইরে নারী ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কম দেখা যেতে পারে।
রোগতত্ত্ববিদদের ভাষ্য, গ্রামাঞ্চলের মানুষ কোনো মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তা এখনো পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। অথচ এটি জরুরি। কেননা ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশা থেকে। এডিস দুই ধরনের- এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস। এডিস ইজিপ্টাই থাকে মূলত শহরে। অন্যদিকে এডিস অ্যালবোপিক্টাস সক্রিয় থাকে গ্রামাঞ্চলে। এরা গাছের কোটরে, কলাগাছের বাকলের মধ্যে বা কচুপাতায় থাকা সামান্য পানিতে ডিম পাড়ে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, ২০১৯ সালে কুষ্টিয়া ও যশোরের একাধিক গ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল। তখন আইইডিসিআর’র পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে যে ওই সব গ্রামে ডেঙ্গু ছড়িয়েছিল এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামের মশা।
মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, এ বছর ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ কোন ধরনের মশায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, তা জানা নেই। শহরের মানুষকে পানি জমিয়ে রাখতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু গ্রামের মানুষের পানি না জমিয়ে উপায় থাকে না। এ অবস্থায় ডেঙ্গু মোকাবিলায় গ্রামের মানুষের জন্য সুস্পষ্ট বার্তা দিতে হবে। তাদের করণীয় সম্পর্কেও সচেতন করা জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব আহমেদুল কবীর বলেন, ডেঙ্গুর একাধিক ধরনে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গুর যেসব লক্ষণ বা উপসর্গ এ বছর দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার ঝুঁকি আছে।
কীটতত্ত্ববিদরা জানান, মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ’ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা এর বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বলা যায়। আর হাউজ ইনডেক্স পাঁচের বেশি হলে তাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বিবেচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
গত জুলাই ও আগস্টে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, পিরোজপুর ও পটুয়াখালীর কয়েকটি এলাকায় জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে সবগুলো এলাকাতেই মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
জরিপের তথ্য বলছে, গাজীপুরে যেসব মশা পাওয়া গেছে তার মধ্যে ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ এডিস ‘অ্যালবোপিক্টাস’ এবং ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ এডিস ইজিপ্টাই মশা। এজিপ্টাই হলো- এমন একটি মশা যা ডেঙ্গু জ্বর, চিকুনগুনিয়াসহ অন্যান্য রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে এডিস অ্যালবোপিক্টাসও কম যায় না।