avertisements 2

ঘরে ঘরে জ্বর, তার ২৫ ভাগ ডেঙ্গু

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ আগস্ট,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৪৮ পিএম, ৫ মে,রবিবার,২০২৪

Text

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে জ্বর ছড়িয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, সর্দিকাশি, বমি হওয়া, গলা ব্যথা, ডায়রিয়া, চোখ লাল হওয়া ও পেটে ব্যথার মতো উপসর্গ। এতে ডেঙ্গু সন্দেহে হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে পরীক্ষার জন্য ভিড় করছে আক্রান্ত ব্যক্তিরা।

পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগই মৌসুমি জ্বর।

তবে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ রোগীর ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। 
গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া চিকিৎসকদের চেম্বার ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলোতে জ্বর নিয়ে আসা রোগীর ভিড় বেড়েছে।

রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বর হলেই ডেঙ্গু আতঙ্কে পরীক্ষা করাতে আসছে তারা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, তিন থেকে সাত দিন জ্বর-সর্দি-কাশির তীব্রতা থাকছে। পরীক্ষায় কিছু মানুষের ডেঙ্গু ধরা পড়লেও বেশির ভাগই ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। একসঙ্গে পরিবারের একাধিক সদস্যও জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছে।

এতে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার কথা বলছেন তাঁরা।
শিশু হাসপাতালে প্রতি সাতজনে একজনের ডেঙ্গু

৯ বছরের ফারিয়া জাহানের দুই দিন ধরে টানা জ্বর। বারবার বমি করছে। কিছু খেতে পারছে না। গত বুধবার দুপুরে রাজধানীর শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে শিশুটিকে বারবার কাঁদতে দেখা যায়।

শিশুটির মা রোজিনা আক্তার তাকে বলছিলেন, ‘ডাক্তার বলেছেন তোমার কিছু হয়নি। বেশি করে খেলে আবার সুস্থ হয়ে যাবে।’
রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকার বাসিন্দা রোজিনা জানান, তিনি নিজেও কয়েক দিন আগে জ্বরে ভুগেছেন। তাঁর ছেলের পর এখন মেয়ে ও স্বামীর জ্বর হয়েছে। কারো জ্বর ১০০ ডিগ্রির নিচে নামছে না। ‘তিনি বলেন, খুব ভয়ে ছিলাম, আল্লাহর রহমতে ডেঙ্গু পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছে। এখন জ্বরের ওষুধ দিয়েছে।’

হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর স্বজনদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। ক্লান্তিতে অনেকে মেঝেতে বসে পড়েছে। কেউ আবার অসুস্থ শিশুকে নিয়ে হাঁটছে। বহির্বিভাগের ১৩৫ নম্বর কক্ষে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগেরই জ্বর, মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া।

বহির্বিভাগের চিকিৎসক ডা. প্রশান্ত পাল বলেন, ‘এখানে গড়ে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ জন চিকিৎসা নিচ্ছে। এর মধ্যে ৪০০ জন মেডিসিনের রোগী। বেশির ভাগেরই ডেঙ্গুর মতো বিভিন্ন উপসর্গ। আমরা তাদের ডেঙ্গু পরীক্ষা দিচ্ছি। নেগেটিভ আসা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। যারা গুরুতর, তাদের আমরা ভর্তি করছি। বেশি করে তরল খাবার আর পানি পানের পরামর্শ দিচ্ছি।’

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাদের দেশে জ্বরের মৌসুম সব সময় থাকে। বিশেষ করে শীত আসার আগে জ্বরের রোগী বাড়ে। শীত চলে গেলে আবার বাড়ে। মাঝখানে জ্বরের রোগী কম থাকে। আবার হঠাৎ গরম পড়লে জ্বরের রোগী বাড়ে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সময়ও বাড়ে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আগে মনে করতাম সর্দি-কাশি হলে ডেঙ্গু হয় না, কিন্তু এখন ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। নিউমোনিয়ার নিয়েও রোগী আছে। এ জন্য পরীক্ষা ছাড়া সাধারণত জ্বরের কারণ বোঝা খুব কঠিন। ডেঙ্গু হলে প্রচণ্ড জ্বর হয়। ১০৩ ডিগ্রি হতে পারে। এর সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকে। চোখের ভেতর ব্যথা হয়। এসব উপসর্গ দেখে সহজে বোঝা যায় রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। আমাদের হাসপাতালে প্রতি ১০০ জনে ১৩ থেকে ১৫ জনের ডেঙ্গু পজিটিভ পাচ্ছি। অর্থাৎ প্রায় সাতজনে একজনের ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে।’

ঢাকা মেডিক্যালে প্রতি চারজনে  একজনের ডেঙ্গু

তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন মোহাম্মদ আবু জাফর। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা এই রোগী জানান, তাঁর দুই নাতির প্রথমে জ্বর হয়। এরপর তিনি জ্বরে আক্রান্ত।

নাজিরা বাজারের এই বাসিন্দা  বলেন, ‘বাসার সবার একে একে জ্বর হয়েছে। ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে খেয়ে অন্যরা ভালো হলেও আমার জ্বর কমছে না। তাই আজ এখানে এসেছি। ডাক্তার ডেঙ্গু টেস্ট দিয়েছেন।’

গতকাল বৃহস্পতিবার হাসপাতালটির বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি রোগী। সকাল ১১টার দিকে টিকিট কাউন্টার থেকে জানা যায়, এর মধ্যে ৩০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।

আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. সাহেদ আবদুল্লাহ বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রোগী অনেক বেড়েছে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ৮০০ রোগীর মধ্যে ৩০০-এর বেশি জ্বর নিয়ে এসেছে। প্রতি চারজনে একজনের ডেঙ্গু পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। যাদের নেগেটিভ আসছে, উপসর্গ বুঝে চিকিৎসা-ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।

মিটফোর্ডে রোগীর চাপ বেশি

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিডফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশিদ-উন-নবী  বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছে। এই সময় ভাইরাল ফিভার অনেক বেশি থাকে। এর সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। জ্বর হলেই আতঙ্ক কাজ করছে ডেঙ্গু কি না। তাই তারা বাসায় না থেকে হাসপাতালে আসছে।

তিনি বলেন, ‘জরুরি ও বহির্বিভাগ মিলিয়ে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার রোগী আসছে। এর মধ্যে এক হাজার ২০০ জন প্রতিদিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয়। এসব রোগীর বেশির ভাগের জ্বর। পরীক্ষায় প্রতি চারজনে একজনের বেশি ডেঙ্গু পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। দুপুরে রোগীর এত চাপ থাকে যে সামাল দেওয়া যায় না। তবু আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

বেসরকারি হাসপাতালে  দীর্ঘ অপেক্ষা

বেসরকারি হাসপাতাল ও  রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে আসা রোগীর চাপ বেড়েছে। গতকাল রাজধানীর ধানমণ্ডি ইবনে সিনা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘ অপেক্ষায় রয়েছে রোগী ও স্বজনরা।

রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা হিরণ কবিরাজ বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছিলাম। আজ (বৃহস্পতিবার) এসেছি রিপোর্ট নিতে। কিন্তু ভিড় বেশি হওয়ায় অনেক সময় লাগছে।’

একই চিত্র দেখা গেছে ধানমণ্ডির পপুলার ডায়াগনস্টিক ও আনোয়ার খান মডার্ন ডায়াগনস্টিকে।

আনোয়ার খান মডার্নে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে আসা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপে যাওয়া যায় না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এখানে এসেছি যাতে ভোগান্তি কম হয়। কিন্তু এখানেও সেই অপেক্ষা। এখনো পরীক্ষা করা যায়নি।’

হাসপাতাল সূত্র জানায়, জ্বর নিয়ে পরীক্ষা করাতে আসা প্রতি ছয়জনে একজনের ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে।

হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. এস এম হুমায়ুন কবীর বলেন, রোগী কয়েক গুণ বেড়েছে। ডেঙ্গু পরীক্ষার আগ্রহও বেড়েছে মানুষের। অনেকে জ্বর নিয়ে আসছে, কিন্তু পরীক্ষায় নেগেটিভ আসছে। প্রতিদিন জরুরি ও বহির্বিভাগ মিলিয়ে ৪০০ রোগীর বেশি চিকিৎসা নিচ্ছে। সব মিলিয়ে রোগীর চাপ অনেক বেড়েছে।

চট্টগ্রামে মৌসুমি জ্বর

চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক নূপুর দেব জানান, নগরের জামালখান এলাকার পাঁচ বছরের শিশু অগ্র বড়ুয়ার জ্বর আসার পরদিন হঠাৎ খিঁচুনি শুরু হয়। তাকে মেহেদিবাগ এলাকার বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।

তিন দিন ধরে জ্বর না কমায় শ্রীপালি নামের ১১ বছরের এক শিশুকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার বাবা। সেখানে তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।

গতকাল দুপুরে চমেক হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের চিকিৎসক-কর্মকর্তারা জানান, শুধু শিশু-কিশোর নয়, কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ জন ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে আসছে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের ডেঙ্গু পজিটিভ হয়েছে। অন্যরা মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত। তারা বেশির ভাগ শিশু ও বয়স্ক।

নগরের অন্যতম রোগ নির্ণয় কেন্দ্র শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পুলক পারিয়াল গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বরের বিভিন্ন পরীক্ষা আগের চেয়ে বেড়েছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে তিন শতাধিক। এর মধ্যে ৫ থেকে ৭ শতাংশ ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে। অন্যরা সাধারণ জ্বরে আক্রান্ত।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, সীতাকুণ্ডের বিআইটিআইডিসহ নগর ও জেলার আরো বিভিন্ন হাসপাতাল ও রোগ নিণয় কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক দিন ধরে প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে জ্বরের বিভিন্ন পরীক্ষা বেড়ে গেছে।

চমেকের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, শিশুরা ডেঙ্গুর চেয়ে জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। শিশু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অনেকে জ্বরে আক্রান্ত। এত দিন প্রচণ্ড গরম ছিল। এখন আবার বৃষ্টি হচ্ছে। গরম-ঠাণ্ডায় শিশুদের জ্বর বেশি হচ্ছে। শুধু হাসপাতালে নয়, চিকিৎসকদের চেম্বারে আসা বেশির ভাগই জ্বরের রোগী।

সাত মাসেই ভাঙল মৃত্যুর রেকর্ড

দেশে গত এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরো ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৮৩। দেশে এর আগে কেবল ২০২২ সালে সর্বোচ্চ ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। চলতি বছর রোগী বাড়তে থাকার সাত মাসের মধ্যে মৃতের সংখ্যা আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৫৮৯ জন রোগী। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৭১৬।

গত এক দিনে যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের এক হাজার ৪৮৮ জনই ঢাকার বাইরের। ঢাকায় ভর্তি হয়েছে এক হাজার ১০১ জন। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৯ হাজার ২১০ জন ভর্তি আছে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2