avertisements 2

ঢাকায় আনার পথেই অনেক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু ঘটছে

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ জুলাই,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:৪৮ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪

Text

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ৯ বছরের শিশু রাব্বি রহমানকে শনিবার সন্ধ্যায় ভর্তি করা হয় রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার নানা হেলাল উদ্দিন জানান, বরিশালের একটি সরকারি হাসপাতালে তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বৃহস্পতিবার সকালে তাকে ঢাকায় রেফার করা হয়। তবে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকায় আনতে দুই দিন দেরি হয়েছে। এ দীর্ঘ সময় চিকিৎসাবিহীন থাকায় তার শারীরিক জটিলতা দেখা দিয়েছে।

মাতুয়াইল শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইসিএমএইচ) চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ কিশোরী লাইলীকে কুমিল্লা সদর হাসপাতাল থেকে গত শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। তবে সেখানে ভর্তি হতে না পেরে তার ঠাঁই মিলেছে আইসিএমএইচের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে।

শুধু রাব্বি কিংবা লাইলী নয়, সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে প্রতিদিন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক জটিল রোগী সুচিকিৎসার জন্য ঢাকায় ছুটে আসছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব রোগী দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়ায় শারীরিক জটিলতা আরও বাড়ছে। কারও কারও পথেই মৃত্যু ঘটছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, জটিলতা অনুযায়ী চিকিৎসা মিলছে না জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে। মূলত সেখানকার চিকিৎসকদের এ বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণেই এমনটি হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জরুরি চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা। ফলে রোগীর অবস্থা কিছুটা জটিল হলেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিশেষায়িত কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

২০১৯ সালের চেয়েও এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে রোগতত্ত্ববিদরা জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে। এ বছর নতুন নতুন জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তবে সেখানকার চিকিৎসকরা রোগটি চিকিৎসায় অনভিজ্ঞ। ঢাকার বাইরে যেসব এলাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি, মূলত ওই সব এলাকায় রোগটির যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত জটিল রোগীর চিকিৎসা দেওয়া না গেলে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে।

চট্টগ্রাম, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও খুলনা অঞ্চলের পাঁচটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং একাধিক জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট বেশি। ফলে রোগীদের বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেই চিকিৎসার জন্য আসতে হচ্ছে। তবে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে অনেক রোগী ও পরিবারের সদস্যরা সেখানকার চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তখন তারা ছুটছেন ঢাকার উদ্দেশে। আবার জেলা পর্যায়ের অনেক চিকিৎসক এ ধরনের জটিল রোগীর চিকিৎসা করার ঝুঁকি ও দায় নিতে চাইছেন না। তাই নানা সংকটের অজুহাত তুলে এসব রোগীকে দ্রুত বিভাগীয় পর্যায়ের হাসপাতাল কিংবা ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য রেফার করছেন।

তবে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের দাবি, তারা দায় এড়াতে রোগী ঢাকায় রেফার করছেন না। বরং ডেঙ্গু আক্রান্ত জটিল রোগীরা যাতে ঢাকায় গিয়ে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন এজন্যই তারা এ কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব বিভাগের কোনো হাসপাতালে গুরুতর রোগীদের প্লাটিলেট সেল সেপারেটর মেশিন বা প্লাটিলেট আলাদা করার যন্ত্র নেই সেখানকার রোগীকে চিকিৎসকরা দ্রুত ঢাকায় পাঠাচ্ছেন।

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের রক্তের প্লাটিলেট সর্বনিম্ন ৩০ হাজার থাকা প্রয়োজন। এর নিচে নামলেই রক্ত দিতে হয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, প্লাটিলেট আলাদা করার যন্ত্র নেই বরিশালে। তাই যাদের প্লাটিলেট পরিবর্তন করাতে হয়, তাদের ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ছয়টি সদর হাসপাতাল এবং পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও প্লাটিলেট সেল সেপারেটর মেশিন নেই। সে ক্ষেত্রে বিভাগের কোনো হাসপাতালেই গুরুতর ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার মতো পুরো সক্ষমতা নেই।

এদিকে ঢাকার একাধিক সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলো থেকে আসা রোগীদের যে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে তা পরিমাণে অতিরিক্ত। স্যালাইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাত্রা ও সময় ব্যাপ্তির সমন্বয় হয়নি। একই সঙ্গে কোনো রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেট লাগলে তাকে প্লাটিলেটই দিতে হবে। রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে দিতে হয়। জেলা পর্যায়ে এসব সুবিধার অভাব রয়েছে। আবার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে চিকিৎসকরা ডেঙ্গু রোগীকে রক্ত দিচ্ছেন। ফলে রোগীর শরীরে আরও জটিলতা দেখা দিয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিরায় যে স্যালাইন দেওয়া হয় সেটাই হলো আইভি ফ্লুইড। এটি দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাপ ও বিধি রয়েছে। অতিরিক্ত স্যালাইন দেওয়া হলে সেটা হৃদযন্ত্র, কিডনি, ফুসফুসসহ দেহের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করতে পারে। এতে রোগীর অবস্থা হয় সংকটাপন্ন। আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রক্তে প্লাটিলেট কমে যায়। এতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে প্লাটিলেট কমে গেলেও তা ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে আপনা-আপনিই ঠিক হয়ে যায়। অথচ উপজেলা ও জেলার চিকিৎসকরা এসব রোগীর দেহে রক্ত পুশ করছেন, যা রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডাক্তার বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘জরুরি বা যে কোনো রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। জেলা হাসপাতাল থেকে আবার পাঠানো হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে উপজেলা হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগের সেবা পরিপূর্ণভাবে চলছে না। একই সঙ্গে জরুরি সেবাও সন্তোষজনক নয়। ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে পদক্রমের চিকিৎসক প্রয়োজন সেসবও এখানে নেই। আবাসিক চিকিৎসক, মেডিকেল অফিসার যারাই থাকেন তারা নবীন। ফলে তাদের অভিজ্ঞতাও কম।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর জটিলতাকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। প্রয়োজন হয় বিভিন্ন চিকিৎসা সুবিধাও। তবে এসবের ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতার ঘাটতি চিকিৎসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে দুপুরের পর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা হয় না। অনেক প্রতিষ্ঠানে প্যাথলজিস্টও নেই। অনেক ক্ষেত্রে জেলা-উপজেলায় রোগীর রক্তচাপ, নাড়ি পরীক্ষার বাইরে জরুরি চিকিৎসায় যেন আর কিছুই করার থাকে না।’

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য নিয়মিতভাবেই চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে বাড়ানো হয়েছে চিকিৎসা সুবিধা। একই সঙ্গে ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনও প্রকাশ করেছে সরকার। সে অনুযায়ীই চিকিৎসা দিচ্ছে সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দাবি, শুধু ডেঙ্গুর জন্যই জেলা পর্যায়ের মানুষজন ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসছে, এমনটি সঠিক নয়। যে কোনো রোগের জন্যই তারা ঢাকায় আসছেন। হাতের কাছে সঠিক চিকিৎসা থাকার পরও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার মানুষ ঢাকায় এসে ভিড় করেন।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন দাবি যে পুরোপুরি সত্য নয়, তা ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা অনেকটা একই সুরে জানান, অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য ঢাকার বাইরে থেকে যে হারে রোগী ছুটে আসে, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম চোখে পড়ার মতো। ডেঙ্গু রোগীর জটিলতা দেখা দেওয়া মাত্র চিকিৎসকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঢাকায় রেফার করেন। বিশেষ করে যেসব রোগীর আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) বা পিআইসিইউ (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) প্রয়োজন হয় তারা দ্রুত ঢাকায় ছুটে আসেন।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামানের বক্তব্যেও জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে বিপুল সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। তিনি জানান, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে সেটা ভালোভাবে সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট জনবল বা সুযোগ-সুবিধা নেই।

৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি রয়েছে ১ হাজারের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চিকিৎসক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনটি ডেডিকেটেড ওয়ার্ড ম্যানেজ করার জন্য যে বাড়তি চিকিৎসক, নার্স কাজ করছেন, যেটা র‌্যাশনিং করতে হচ্ছে। যে কারণে চিকিৎসা সেবা দিতে সবাই হিমশিম খাচ্ছে।

মুগদা হাসপাতালে ১ জুলাই থেকে ৮ জুলাই সকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ৭১৫ জন। মো. নিয়াতুজ্জামানের মতে, এই সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে এবং সেটা ‘বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে’। এটা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি।

এদিকে অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার কারণে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত জটিল রোগীদের বিভাগীয় শহর ও ঢাকায় রেফার করার কথা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন।

নড়াইল জেলা সদর হাসপাতালের একজন চিকিৎসক এ প্রতিবেদককে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত জটিল রোগীদের প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ, সেবা দিতে প্রয়োজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। একই সঙ্গে দরকার আধুনিক জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ব্যবস্থাপনা। তাই ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নড়াইল জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় খুলনা কিংবা যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কোনো কোনো রোগীকে ঢাকায়ও পাঠানো হয়।

ওই চিকিৎসকের ভাষ্য, অনেক সময় এসব রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ১০০ শয্যার এ হাসপাতালে সে সুবিধা নেই। বহু আধুনিক চিকিৎসা সুবিধাও নেই এখানে। চিকিৎসক স্বল্পতাও রয়েছে। তাই দায়বদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তারা জটিল রোগীদের ঢাকায় রেফার করতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2