লাখের নীচে গরু নেই, মিলছে না হিসাব
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ জুন,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:৪৫ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা-ইজারাদার কারও হিসাব মিলছে না। ক্রেতাদের অভিযোগ, গো-খাদ্যের দাম, শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহণ ভাড়াসহ আনুষাঙ্গিক খরচ বাড়ার অজুহাতে গরু-মহিষ-ছাগলের আকাশচুম্বী দাম হাঁকছেন গৃহস্থ ও বেপারীরা। ৮০ হাজার টাকার গরু তারা এক লাখ টাকার কমে বিক্রি করতে চাইছে না। তবে বিক্রেতাদের দাবি, ক্রেতারা যে দামে পশু কিনতে চাইছেন তাতে তাদের লাভ দূরে থাক, আসল চালান (বিনিয়োগকৃত মূলধন) খোয়াতে হবে। বাজার ঘুরে দেখা লাখের নীচে কোনো গরু নেই। এতে অনেকে শঙ্কায় পড়ে গিয়েছেন।
এদিকে হাট ইজারাদাররা বলছেন, রোববার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেচাকেনা শুরু হলেও ক্রেতা-বিক্রেতার দরদামে বড় ফারাক থাকায় ঢাকার হাটগুলো এখনো জমে উঠছে না। অথচ সামনে মঙ্গল-বুধ আর মাত্র দু’দিন কোরবানির পশু বেচাকেনা চলবে। এ গতিতে বেচাকেনা চললে হাট ইজারার নেওয়ার জন্য বিনিয়োগকৃত টাকা তোলাও কঠিন হবে।
ক্রেতারা জানান, বেপারী ও গৃহস্থরা দরকষাকষি করে যেখানে এসে ঠেকছেন, ওই দামে গরু কিনলে হাসিলসহ অন্যান্য খরচ দিয়ে প্রতি কেজি মাংসের দাম এক হাজার থেকে ১১শ’ টাকা পড়বে। অথচ বর্তমান বাজারে ৮শ’ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ কোরবানির গরুতে কেজি প্রতি ২ থেকে ৩শ’ টাকা গচ্চা যাবে। এ হিসাবে ৩ মণ ওজনের গরুতে ২ হাজার ৪শ’ টাকা থেকে ৩ হাজার ৬শ’ টাকা লোকসান হবে। অর্থনৈতিক মন্দার এ বাজারে যা মেনে নেওয়া মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের জন্যই কঠিন।
যাত্রাবাড়ী দনিয়া কলেজ সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গায় জমে ওঠা হাটে সোমবার দুপুরে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মাতুয়াইলের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোসাদ্দেক আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিবছরের মতো ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায় গরু কেনার জন্য হাটে এসেছেন। কিন্তু সকাল থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টা ঘুরেও পছন্দমতো কোনো গরু খুঁজে পাচ্ছেন না।
বেপারীরা দরদারি করে যে গরুর দাম ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকায় এসে ঠেকছেন, তাতে কোনো অবস্থাতেই দুই মণ মাংস হবে না। তবে এর চেয়ে বড় গরুর দাম কিছুটা কম। অথচ তা কিনে এককভাবে কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য তার নেই। তাই শেষ পর্যন্ত কী করবেন তার হিসাব মেলাতে পারছেন না।
মোসাদ্দেক আলী জানান, বাসায় ফিরে গিয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে সন্ধ্যার পর আবার হাটে আসবেন। ছোট গরুর দামে না পোষালে আত্মীয়-স্বজন কাউকে সঙ্গে নিয়ে ভাগে মাঝারি সাইজের গরু কোরবানি দিবেন।
কমলাপুর পশুর হাটে একই ধরনের হতাশা প্রকাশ করেন বীমা কর্মকর্তা শফিকুল আলম। তিনি জানান, দু’দিনে আফতাব নগর ও মেরাদিয়াসহ ঢাকার ৪টি হাট ঘুরেছেন। প্রতিটি হাটেই কোরবানিযোগ্য পশু কানায় কানায় পূর্ণ। এখনো ট্রাকে ট্রাকে গরু ঢাকায় ঢুকছে। অথচ সবখানেই বিক্রেতারা গবাদি পশুর আকাশচুম্বী দাম হাঁকছেন। গত বছরের চেয়ে এবার গরুর দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি চাইছেন। এত চড়া দরে গরু কিনে কোরবানি দেওয়া মধ্যবিত্তদের জন্য সত্যিই দুষ্কর বলে মনে করেন তিনি।
শফিকুলের অভিযোগ, দাম যেন অযৌক্তিকভাবে না বেড়ে যায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর তা নজরদারির আশ্বাস দিলেও তাদের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। এমনকি হাটে তাদের উপস্থিতিও নেই। চড়া দরে গবাদি পশু বিক্রি করার ফাঁদ এঁটে খামারি ও গৃহস্থরা উল্টো মহাবিপদে পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তার ধারণা, গলাকাটা দামে আশায় বিক্রেতারা এখন গবাদি পশু বিক্রি করছে না। নির্ধারিত বাজেটে পছন্দের গরু না মেলায় ক্রেতারাও অনেকে ভিন্নভাবে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন। অনেকে এককভাবে কোরবানির আশা বাদ দিয়ে ৫/৭ জনে মিলে কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এতে বিপুল সংখ্যক গরু ঢাকার হাট থেকে খামারি ও গৃহস্থদের নিজ নিজ জেলায় ফেরত নিয়ে যেতে হবে। ফলে মোটা অঙ্কের পরিবহণ খরচ গচ্চা যাবে। পাশাপাশি এসব গবাদি পশু পরে তাদের কম দামে কসাইয়ের কাছে বেচতে হবে। কিংবা আরও এক বছর লালন-পালন করতে হবে।
মেরাদিয়া হাটে মাঝারি ও বড় সাইজের মিলিয়ে ২১টি গরু নিয়ে আসা কুষ্টিয়ার খামারি জুলহাস মিয়া জানান, রোববার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হাট শুরুর পর এখন পর্যন্ত মাত্র ৩টি বিক্রি করতে পেরেছেন। বাকি গরু মঙ্গলবারের মধ্যে বিক্রি হবে কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তার ভাষ্য, হাটে বিপুল সংখ্যক গরু-মহিষ-ছাগলসহ বিভিন্ন পশু এসেছে। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাটে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে। তবে বিক্রি এখনো জমে ওঠেনি। কবে হাট জমবে, কীভাবে এত পশু বিক্রি হবে- এ হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি।
খামারি জুলহাস মিয়ার ভাষ্য, কেউ লোকসান দিয়ে গরু-ছাগল বেচবে না। আবার ক্রেতারাও চাইবে উপযুক্ত দামে তা কিনতে। কিন্তু এবার শুরু থেকেই দু’পক্ষের দরদামে বড় ধরনের ফারাক রয়ে গেছে।
রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি মাঠের ইজারাদার সোলায়মান সেলিম বলেন, রোববারের তুলনায় সোমবার সকাল থেকে বেচাকেনা খানিকটা বেড়েছে। তবে অন্য বছর এ সময় যে সংখ্যক কোরবানির পশু বিক্রি হয় সে তুলনায় বেচা-বিক্রি যথেষ্ট মন্দ। তার ভাষ্য, মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পড়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামর্থ্য অনেক কমেছে। অন্যদিকে লালন-পালন খরচ বাড়ায় গবাদি পশুর দাম বেড়েছে। এই দু’য়ের সমন্বয় খুবই কঠিন। তাই মঙ্গল-বুধবার বেচাকেনা বাড়লেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে তা বুঝে উঠতে পারছেন না।
ভাটারা (সাঈদ নগর) পশুর হাটের হাসিল গ্রহণকারী কর্মচারী মুক্তার হোসেন জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবছরই এ কাজ করেন। কিন্তু করোনার সময় ছাড়া আর কখনো বেচাকেনার এ দুরবস্থা দেখেননি। তিনি বলেন, গতবার যে গরু দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার সেটি ২ লাখ টাকায় কিনতে হচ্ছে। দুই লাখ টাকার গরু বিক্রি হচ্ছে আড়াই লাখ টাকায়। তবে এ হারে ছোট গরুর দাম আরও বাড়তি।
মেহেরপুর থেকে ১৩টি গরু নিয়ে গাবতলী পশুর হাটে এসেছেন বেপারী আতিয়ার রহমান। সব কটিই দেশি জাতের গরু। এর মধ্যে প্রায় ১০ মণ ওজনের শাহেন শাহর দাম হাঁকছেন সাড়ে চার লাখ টাকা। কাজের ফাঁকে আতিয়ার রহমান জানালেন, রোববার ভোরে তিনি হাটে নামেন। দু’টি ট্রাকের ভাড়া বাবদ তাকে গুনতে হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। সন্ধ্যা পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। তবে সব কটি গরুই বিক্রি হবে বলে তিনি আশাবাদী।
সরেজমিন ঢাকার ৫টি হাট ঘুরে দেখা গেছে, অনেকে হাটের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে গরু দেখছেন, দাম জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু কেনার লোক খুবই কম। তাদের কাছে মনে হচ্ছে দাম বেশি। তবে ক্রেতাদের সঙ্গে দ্বিমত করছেন না বিক্রেতারাও। তাদের ভাষ্য, গাড়ি ভাড়া বেড়েছে। বেড়েছে সব ধরনের পশুর খাদ্যের দাম। এ কারণে পশুর দামও এবার বাড়তি গুনতে হবে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা বাজারে বেশি থাকে। এই দুই ধরনের গরুর দামই বাড়তি।
এদিকে সোমবার সকাল থেকে কয়েক দফা বৃষ্টির কারণে ঢাকার হাটগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা আশানুরূপভাবে বাড়েনি। ফাঁকে ফাঁকে কিছু ক্রেতা হাটে ঢুঁ মারলেও বৃষ্টির ভোগান্তির কারণে তারা বেশিক্ষণ অবস্থান করেননি। বৃষ্টিতে বেপারীদের ভোগান্তিও বেড়েছে। বৃষ্টিতে ট্রাক থেকে গরু নামাতে হিমশিম খেতে হয় দূর-দূরান্ত থেকে আসা বেপারীদের।
দুপুরে সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন তার দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন মোহাম্মদপুরের বছিলা হাটে। বেশ কয়েকটি গরু তার পছন্দ হয়। কিন্তু দামে না মেলায় কিনতে পারেননি। মোশারফ বলেন, তারা তিন ভাই মিলে গরু কেনেন। গতবার মাঝারি আকারের গরু কিনেছিলেন ৯৮ হাজার টাকা দিয়ে। ওই একই ধরনের গরু এবার দেড় লাখ থেকে এক লাখ আশি হাজার টাকা দাম হাঁকছেন বেপারীরা।
এ হাটে আসা আরেক ক্রেতা মুদি দোকানি সুমন মিয়া বলেন, শুধু গরু না, ছাগলের দামও বেশি চাচ্ছেন বেপারীরা। ১০ থেকে ১১ কেজি মাংস হবে এ ধরনের খাসির দাম ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা হাঁকছেন তারা। সুমনের ভাষ্য, দুই হাজার টাকা কেজিতে খাসির মাংস কোনো পাগলেও কিনবে না। মঙ্গলবারও বিক্রেতারা এ রকম দাম চাইবেন। এরপর তারা দাম কমিয়ে আসল জায়গায় আসবেন। সে সময়ের জন্য সবারই ধৈর্য ধরা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
মোহাম্মদপুর থেকে গরু কিনতে এসেছেন শাহীনা বেগম। সঙ্গে তার বড় ভাই শহীদুল ইসলামও রয়েছেন। সকাল থেকে হাট ঘুরছেন তারা। দুপুরে একটি গরু পছন্দ হলে সেটি নিয়ে দরদাম করছিলেন। শাহীনা বেগম বলেন, যে সাইজের গরু গত বছর এক লাখ ১০ হাজার টাকা কিনেছেন, তার চেয়েও ছোট গরু এবার দেড় লাখ টাকা চাইছে বিক্রেতারা। লালন-পালন খরচ বৃদ্ধি পাওয়া দাম কিছুটা বাড়লেও এতটা বাড়বে না- মনে করেন এই গৃহিণী।