ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৯ জুন,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:৪১ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলেও জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষভাগে এসে তা তীব্র গতি পেয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ জুন হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তির সংখ্যা এক লাফে বেড়ে ২শ’ ছাড়িয়ে যায়। ১৭ জুন এ সংখ্যা পৌনে ৫শ’ জনে এসে ঠেকে। ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তৎপরতা ও জনসচেতনতা না বাড়ালে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শনাক্তের চেয়ে প্রকৃত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অন্তত ১০ গুণ বেশি। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর পরিসংখ্যান চিত্রের এই বড় গরমিলের কারণে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা অস্পষ্ট। ফলে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ছে না। পাশাপাশি মশক নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বরাবরের মতো দায়সারা তৎপরতা দেখাচ্ছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেলে সবারই টনক নড়তো। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার মাত্র ৩৩টি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে। এই ৩৩টি হাসপাতালে রোগী কেবল ভর্তি হলেই তাদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কেউ ডেঙ্গু পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ার পর বাসায় বা অন্য কোনো হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেই তথ্য সংগ্রহ করে না। ফলে ঢাকায় যে আরও কয়েকশ’ হাসপাতাল আছে সেসব হাসপাতালের চিকিৎসা নেওয়া ও শনাক্ত হওয়া এবং যারা বাসায় চিকিৎসা নেন তারা গণনার বাইরে থেকে যান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আমরা ডেঙ্গু রোগীর যে তথ্য পাই তা সঠিক সংখ্যা নয়। কেবলমাত্র কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলেই আমরা তার তথ্য পাই। এর বাইরে কেউ ডেঙ্গু পজিটিভ হলে বা বাসায় চিকিৎসা নিলে সেই তথ্য আমরা পাই না। ধারণা করা হয়, দেশে প্রাপ্ত তথ্যের চেয়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ গুণ বেশি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন ডেঙ্গুর যে তথ্য সরবরাহ করা হয় এর বাইরেও দেশে ডেঙ্গু রোগী আছে কি না তা যাচাই করতে যায়যায়দিনের এ প্রতিবেদক রাজধানীর ৫টি হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন। সেগুলোর মধ্যে একটি বেসরকারি হাসপাতালে গত ২ দিনে ১৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু এই হাসপাতালের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্তর্ভুক্ত তালিকার মধ্যে নেই। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই হাসপাতালের সঙ্গে ডেঙ্গু বিষয়ে কোনো যোগাযোগও রাখে না। আরেকটি ক্লিনিকে গত ৭ দিনে যেসব রোগী ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছেন তাদের মধ্যে ৭ জনের পজিটিভ এসেছে। সেই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে ডেঙ্গুর ডেটা পাঠানো হয় সেই তালিকায় নেই।
সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত মাতুয়াইল শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইসিএমএইচ) যুগ্ম পরিচালক সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার হাসরাত জাহান রোববার দুপুরে এ প্রতিবেদককে জানান, ‘আমরা সারা বছর ডেঙ্গু পরীক্ষা করি। আমাদের এখানে নিয়মিতই রোগী ভর্তি হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ডেঙ্গু রোগী বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয় না।’
হাসপাতালের এই কর্মকর্তা জানান, তাদের হাসপাতালে অনেকেই ডেঙ্গু পরীক্ষায় পজিটিভ আসার পর বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা নেন। ১৮ জুন দুপুরে হাসপাতালটিতে ১৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর।
ডাক্তার হাসরাত জাহান বলেন, ‘হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই এতদিন শিশু বিভাগসহ বিভিন্ন ইউনিটে এদের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হলেও ১৯ জুন থেকে ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
অথচ ১৮ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর যে পরিসংখ্যান চিত্র দেওয়া হয়েছে সেখানে মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নামই নেই।
রামপুরার বেটার লাইফ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার নাফিসা আক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রতিষ্ঠানে অনেক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে কখনো তাদের কাছ থেকে রোগীর পরিসংখ্যান চাওয়া হয় না।
মালিবাগের একটি বেসরকারি হাসপাতালের গত এক সপ্তাহের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই ৭ দিনে সেখানে মোট ৮৫ জন ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩১ জনের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক জানান, কতজনের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে, সেই ডেটা চাওয়া হয় না। শুধু কতজন রোগী ভর্তি হন সেই তথ্য জানতে চাওয়া হয়। অনেকেই পজিটিভ হওয়ার পর বাসায় গিয়ে বা অন্য হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন।
যাত্রাবাড়ী ইবনে সিনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও গত এক সপ্তাহে বিপুলসংখ্যক রোগীর ডেঙ্গু পরীক্ষা করেছে বলে জানায়। তবে তাদের কতজনের রক্তে এ ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানতে চাওয়া হয়নি।
কীটতত্ত্ববিদ ডক্টর মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ার ফলে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ হবে। আমাদের দেশে কতজন রোগী আছেন তার সঠিক তথ্য আমরা পাই না। এই সংখ্যাটি অনেক বেশি হবে।’ এবারে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘দেশে বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই যেভাবে ডেঙ্গু জেঁকে বসেছে আগামী আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার সম্ভাবনাই বেশি।’ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনসহ নগরবাসীকে আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। সেই সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীদের ঠিকানা সংগ্রহ করে তাদের ঘরবাড়ি মশামুক্ত করারও পরামর্শ দেন এই কীটতত্ত্ববিদ।
তিনি বলেন, ‘ধারণা করা হয়, দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রাপ্ত তথ্যের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। এর কারণ, ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের জন্য এনএস-১ পরীক্ষায় কেউ পজিটিভ হলে সেই ডেটা গণনায় ধরা হয় না। শুধুমাত্র কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে গণনায় আনা হয়।’
এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘করোনার ক্ষেত্রে কেউ পজিটিভ হলে সেই তথ্য গণনায় ধরা হয় কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তা হয় না। সরকারের কাছে ঢাকার শুধু নির্দিষ্ট হাসপাতালে রোগী ভর্তির তথ্য আসে। এর বাইরে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হয়, সেই তথ্য সরকারের কাছে নেই। অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে চিকিৎসা নেন। সেই ডেটাও সরকারের কাছে নেই। কেউ এনএস-১ পজিটিভ হলেই যদি সেই তথ্য গণনায় আনা হয় তাহলেও ডেঙ্গুর তুলনামূলকভাবে সঠিক চিত্র পাওয়া যেত। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত।’
তার ভাষ্য, কয়েকটি কারণে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এ বছর আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়া। ফলে এডিস মশা বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকেই যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল তা নেওয়া হয়নি।
তৃতীয়ত, মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে তেমনভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি। কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবশ্যই তাকে সবসময় মশারির ভেতর থাকতে হবে। কিন্তু অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরেও মশারির ভেতর থাকেন না। এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলেই শুধু সে তথ্য সংগ্রহ করার কথা স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, ‘বাড়িতে কেউ চিকিৎসা নিলে সেই তথ্য আমাদের কাছে আসে না। এখানে প্রকৃত সংখ্যা না পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাছাড়া আমরা যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে তথ্য সংগ্রহ করি, এর বাইরে অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকে অনেক রোগী চিকিৎসা নেন। সুতরাং ডেঙ্গুর প্রকৃত তথ্য না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
কেউ এনএস-১ পজিটিভ হওয়ার পরও কেন তাকে গণনার মধ্যে আনা হয় না এবং অন্যান্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তথ্য গণনায় আনার জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না- তা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা শুধু ডেটা সংগ্রহের বিষয়টি দেখি। বাকি বিষয়গুলো দেখে সিডিসি। আমরা সিডিসিকে বলেছি, সব হাসপাতালের তথ্য আনতে চাই। তারা আমাদের জানিয়েছিলেন, একটি ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা কোন পর্যায়ে আছে তা আমার জানা নেই। কেউ এনএস-১ পজিটিভ হওয়ার পর সেটি গণনায় আসে কি না- সেটি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালই ভালো বলতে পারবে। তবে সেই সংখ্যাটি মিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’