মহাসড়কে গভীর রাতে আচমকা ছিনতাই : আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ এপ্রিল,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:২৪ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
মহাসড়কে আবারও পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাই বা ডাকাতির শঙ্কায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ছিনতাইকারীদের টার্গেট গার্মেন্ট পণ্যবোঝাই যানবাহন। এসব যানবাহন ছিনতাই হলে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি যেমন নষ্ট হয়, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার আয় থেকে বঞ্চিত হয় দেশ। পেশাদার ছিনতাইকারী বা ডাকাতরা এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এছাড়া পরিকল্পিতভাবে এসব অপরাধীদের ব্যবহার করে একটি চক্র দেশকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে পারে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এমন তথ্যের সূত্র ধরে মহাসড়কে পণ্যবোঝাই মালামাল আনা নেওয়ার কাজে নিয়োজিত কার্গো সার্ভিসের তালিকা করেছে হাইওয়ে পুলিশ। পণ্যবোঝাই কার্গোভ্যানকে নির্ধারিত জায়গা ছাড়া থামতে দেওয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে ১১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। এর মধ্যে অপরাধপ্রবণ স্পটের সংখ্যা শতাধিক। এসব স্পটে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তারপরেও ডাকাতি ও ছিনতাইকারী এবং চোরাকারবারিদের রোধ করা কঠিন হতে পারে। তারা নতুন কৌশল নিয়ে অপরাধ করার চেষ্টা করছে। মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত থাকা ছোট ছোট লিংক রোড দিয়ে ছিনতাইকারীরা এসে আচমকা ছিনতাই করে পালিয়ে যায়। বিশেষ করে গভীর রাতে এসব ঘটনা বেশি ঘটে। এজন্য প্রতিটি লিংক রোডে পাহারা বসানোর পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতদিন লিংক রোডের সুযোগকে কাজে লাগাত অপরাধীরা। সম্প্রতি সেই তৎপরতা কমে গেছে। অপরাধপ্রবণ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করায় অপরাধীরা নতুন নতুন জায়গা বেছে নেয়ার চেষ্টা করছে।
সূত্রটি বলছে, অপরাধীরা রাতের আঁধারে রাস্তায় গাছ ফেলে মহাসড়কে ব্যারিকেড দিয়ে পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাই করত। ডাকাতি বা ছিনতাই হওয়ার খবর পাওয়ার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই অপরাধীরা মালামাল বোঝাই যানবাহন নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হতো।
গত প্রায় ৫ বছরে মহাসড়কে ঘটে যাওয়া ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনাগুলোর নতুন করে তদন্ত করছে হাইওয়ে পুলিশ। বেশ কয়েকটি মামলার তদন্তে দেখা গেছে, এসব ছিনতাইয়ের সঙ্গে পণ্যবাহী যানবাহনের চালক, হেলপার ও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা জড়িত। তাদের শনাক্ত করা হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাতে বা দিনে নিরাপত্তা টহল দেয়ার জন্য হাইওয়ে পুলিশের বেশিরভাগ থানায় প্রয়োজনীয় গতিসম্পন্ন যানবাহন নেই। ফলে অপরাধীদের দ্রুত গতির যানবাহনকে ধাওয়া করেও অনেক সময়ই তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। সারা দেশে মহাসড়কে বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী গ্রুপ সক্রিয়। ছিনতাইকারী গ্রুপগুলোর প্রধান টার্গেট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। সেইসঙ্গে তাদের টার্গেট গার্মেন্ট পণ্যবোঝাই যানবাহন। দ্বিতীয় টার্গেট নিত্যপণ্যবাহী যানবাহন। এর বাইরে তেল, চিনি, লবণ, চাল, ডাল, আটা, সার, কাপড় ও মসল্লা বোঝাই যানবাহনও তারা ছিনতাই করে থাকে।
সূত্রটি বলছে, ছিনতাইকারী বা ডাকাতদের প্রতিটি গ্রুপে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য থাকে। অপরাধী দলে থাকে দক্ষ চালক, হেলপার, শ্রমিক ও যানবাহন মেরামত করার কারিগর। ছিনতাইকারীরা খালি ট্রাক নিয়ে টার্গেটকৃত মালামাল বোঝাই যানবাহনটিকে প্রথমে টার্গেট করে পিছু নেয়। ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত অধিকাংশ যানবাহনের নম্বর প্লেটই ভুয়া। ছিনতাইকারীরা খালি ট্রাকটি আচমকা মালামাল বোঝাই যানবাহনটির সামনে নিয়ে ব্যারিকেড দেয়। এতে মালামাল বোঝাই যানবাহন দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেতে থামাতে বাধ্য হয়।
এ সময় অপরাধীরা ধারালো অস্ত্রের মুখে বা নেশা জাতীয় বা অজ্ঞান করার ওষুধ নাকের কাছে ধরে মালামাল বোঝাই ট্রাকের সবাইকে অজ্ঞান করে ফেলে। কোনো কোনো সময় প্রয়োজন হলে মালামাল বোঝাই যানবাহনের চালক ও হেলপারসহ সবাইকে হত্যা করে বা হাত-পা বেঁধে নির্জন জায়গায় ফেলে যায়। আবার যানবাহন থেকে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মালামাল বোঝাই যানবাহন নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার রেকর্ড আছে এসব অপরাধীদের।
সূত্রটি বলছে, মহাসড়কে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ে জড়িতরা এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের পিছু নেওয়া পুলিশকে পর্যন্ত গাড়ির নীচে পিষ্টে পালিয়ে যায়। অবস্থা সুবিধাজনক না হলে ছিনতাইকারীরা সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে ছিনতাই করা যানবাহন থেকে মালামাল নিজেদের যানবাহনে তুলে পালিয়ে যায়। খালি যানবাহন রাস্তার মাঝ বরাবর রেখে যায়। যাতে রাস্তায় যানজট হয়। যানবাহন সরিয়ে তাদের পিছু নিতে নিতে অপরাধীরা অনেক দূর বা নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে পারে।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, অপরাধীদের যানবাহন ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে চলে। সে তুলনায় হাইওয়ে পুলিশের যানবাহন কম গতিসম্পন্ন। মহাসড়কের অপরাধীরা ঘন ঘন ছিনতাই বা ডাকাতির স্পট পরিবর্তন করে। এজন্য ছিনতাই বা ডাকাতরা মহাসড়কের কখন কোথায় ডাকাতি বা ছিনতাই করবে তা আগ থেকে জানা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
দায়িত্বশীল একটি উচ্চ পর্যায়ের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোদমে গার্মেন্টস সেক্টর চালু হচ্ছে। এ সময় গার্মেন্টপণ্য দেশের বিভিন্ন রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত এলাকা থেকে বিদেশে পাঠানো হবে। এছাড়া সমুদ্র বন্দর দিয়েও বিদেশে গার্মেন্টপণ্য রপ্তানি করা হয়। অনেক সময় গার্মেন্ট মালিক ঠিকঠাক মতো সব মালামাল কার্গো ভিলেজ কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু কার্গো বিমানে তোলার সময় কার্টুন থেকে কিছু কিছু করে মালামাল সরিয়ে ফেলে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্টরা। বিমানটি বিদেশে পৌঁছার পর ক্রেতা পুরো মালামাল বুঝে পান না। এতে ক্রেতা বিক্রেতার উপর আস্থা হারান। তিনি আর ভবিষ্যতে গার্মেন্টস মালিককে আর কোনো পণ্যের জন্য অর্ডার করেন না। এতে দেশ এবং ওই ব্যবসায়ীর ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়।
হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস অ্যান্ড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) শ্যামল কুমার মুখার্জী যায়যায়দিনকে বলেন, মহাসড়কে ডাকাতি, ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধীদের গ্রেপ্তারে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ঈদ পরবর্তী গার্মেন্টপণ্য রপ্তানি হবে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে অনেক সময়ই গার্মেন্টপণ্য ছিনতাই হয়ে যায়। প্রায়ই এমন অভিযোগ আসে হাইওয়ে পুলিশের কাছে। গার্মেন্টপণ্য ছিনতাই বা ডাকাতি হলে মালিকপক্ষ নির্ধারিত সময়ে বিদেশে মালামাল পাঠাতে পারেন না। এতে করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দুর্নাম হয়।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। যাতে ছিনতাই বা ডাকাতির বিষয়টি সম্পর্কে জানা যায়। মহাসড়কে পণ্যবোঝাই যানবাহন যাতে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারে, এজন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে মালিকপক্ষকে যেকোনো ধরনের আশঙ্কা থাকলে বা নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলে তা হাইওয়ে পুলিশকে জানাতে বলা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ পণ্য আনা-নেয়ার বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মোতাবেক হাইওয়েতে মহাসড়কে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। মহাসড়কে পণ্য বোঝাই যানবাহন ছিনতাই ছাড়াও অবৈধ মালামাল আনা-নেয়ার বিষয়টিও তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
এদিকে, গত ৫ এপ্রিল ইজিবাইক দিয়ে ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে দিনাজপুর জেলার পাবর্তীপুর থানাধীন রাবেয়ার মোড় থেকে দুই বাবু ও আব্দুস সালাম নামের তরুণ দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে হাইওয়ে পুলিশ। তারা মহাসড়কে ছিনতাই করত। গত ১৪ এপ্রিল পাবনা জেলার পাকশী হাইওয়ে এলাকা থেকে ধনিয়া, সরিষা, হলুদ, রসুন ও ভুসি বোঝাই ১৭ বস্তা মসল্লাসহ ট্রাক ছিনতাইকালে পাকশী হাইওয়ে পুলিশ উজ্জ্বল হোসেন ও বাপ্পী ইসলাম নামের দুই সহোদর ভাইকে গ্রেপ্তার করে। তারা মহাসড়কের পেশাদার ডাকাত চক্রের সদস্য।
হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাইওয়ে পুলিশ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয়। এমনকি হাইওয়ে পুলিশ জেলা পুলিশ ও র্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। হাইওয়েতে ছিনতাই বা ডাকাতির অধিকাংশ ঘটনার সঙ্গে কার্গোভ্যানের চালক বা হেলপার এমনকি মালিকপক্ষও অনেক সময় জড়িত থাকে।
এজন্য পণ্য আনা নেয়ার কাজে ব্যবহৃত কাগোভ্যানের তালিকা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব কার্গোভ্যানকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নির্ধারিত জায়গা ছাড়া চালক বা হেলপারের পছন্দমতো কোনো জায়গায় থামতে দেওয়া হয় না। কার্গোভ্যানের মালিক, শ্রমিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এ সংক্রান্ত বৈঠক করা হয়েছে। একই সঙ্গে গুরুত্ব বিবেচনা করে অনেক জায়গায় কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো ও টহল জোরদার করেছি। আশা করছি, মহাসড়কে পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাই বা ডাকাতদের কবলে পড়বে না।
মহাসড়কের পণ্যবাহী যানবাহন ছিনতাই বা ডাকাতির বিষয়ে র্যাবের গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নগুলো কাজ করছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে র্যাবের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যেই র্যাব বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।