avertisements 2

রাজনীতির ফাঁদে পোশাক শিল্প!

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:১৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪

Text

বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো গত ২৯ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ৭ দফায় ১৪ দিন হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করে। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজপথে জোরালো পিকেটিং না থাকলেও আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে বিপুলসংখ্যক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ফলে ওই ২৩ দিনের মধ্যে মাত্র ৯ দিন আন্তঃজেলা পণ্য স্বাভাবিক গতিতে পরিবহণ করা গেছে। এতে গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা তাদের তৈরি পোশাক সিডিউল অনুযায়ী বন্দরে পাঠাতে পারেননি। হরতাল-অবরোধের কারণে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত কাঁচামালও বন্দর থেকে সময়মত কারখানায় আনা সম্ভব হয়নি।

গার্মেন্ট মালিকরা জানান, গত তিন সপ্তাহে তাদের তৈরি পোশাকের রপ্তানির সিডিউল পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেছে। সময়মত শিপমেন্ট করতে না পারায় তাদের অনেককে দ্বিগুণ খরচ দিয়ে তৈরি পণ্য ‘এয়ার ফ্রেইট’ করতে হয়েছে। গার্মেন্টসের জন্য বিদেশ থেকে আনা কাঁচামাল সময়মত কারখানায় পৌঁছাতে না পারায় ‘প্রোডাকশন সিডিউল’ ভেঙে পড়েছে। এতে কোনো কোনো গার্মেন্ট মালিকের তৈরি পণ্যের অর্ডার বাতিল হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, মজুরি নিয়ে টানা কয়েক সপ্তাহ শ্রমিক আন্দোলনের কারণে এমনিতেই উৎপাদন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ওপর চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র নেতাদের অভিযোগ, শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে অসন্তোষ ও আন্দোলনের নেপথ্যে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উসকানি ছিল। এ কারণে শ্রমিকদের নতুন করে উপযুক্ত মজুরি নির্ধারণ করার পরও এ নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। অনেকে এখনও এ নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে।

এদিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধপূর্ণ অবস্থানে রাজপথ যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তাতে আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যভাগের আগে পরিবহণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে কিনা- তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। গার্মেন্ট মালিকরা জানান, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকা হরতাল-অবরোধে আমদানি ও রপ্তানিজাত পণ্য পরিবহণ এ কর্মসূচির আওতার বাইরে রাখা না হলে তাদের ব্যবসায় বড় ধস নামবে। যা দেশের বর্তমান নাজুক অর্থনৈতিক কাঠামোতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অন্যদিকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের ধারাবাহিক চাপ উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীন সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় ভিসানীতি ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার বড় ধাক্কাও পোশাক খাতে লাগতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিকারক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তারা এ নিয়ে চরম আতঙ্কে রয়েছেন।

এমনই এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এ প্রসঙ্গে যায়যায়দিনকে বলেন, সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘শ্রম অধিকার লঙ্ঘনকারীদের’ বিরুদ্ধে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, ভিসা বিধিনিষেধসহ শাস্তিমূলক পদক্ষেপের যে নির্দেশনা জারি করেছেন এর নেপথ্যে মূলত রাজনীতি। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বিএনপিসহ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ এবং সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক ভোট অনুষ্ঠানের জন্য তাদের ‘প্রেসক্রিপশন’ না মানায় যুক্তরাষ্ট্র ‘শ্রমিক অধিকার রক্ষার’ এ হাতিয়ার ব্যবহার করছে। পরাশক্তির এ দেশটি এর আগেও একই কৌশল ভিন্ন দেশের উপর প্রয়োগ করেছে বলে জানান ওই শিল্পপতি।

তাঁর ভাষ্য, শ্রমিক অধিকারের মাপকাঠিতে দেখলে বাংলাদেশের ভয়ের কোনো কারণ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শঙ্কিত হয়ে ওঠার মতো অনেক কারণ রয়েছে। কোনো দেশ বা কোনো ব্যক্তির উদ্দেশ্য বা পদক্ষেপ আগে থেকে বোঝা মুশকিল। ভূরাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপড়েনের মধ্যে রয়েছে। একে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিতে পারে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে।

গার্মেন্ট শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, পশ্চিমা ক্রেতা ও শ্রমিক সংগঠনের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সুপারিশের ভিত্তিতে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকের নিরাপত্তা উন্নয়নে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ঘোষণা তাদের মধ্যে উদ্বেগের সঞ্চার করেছে। কারণ সব কারখানার পরিস্থিতি সমান নয়। এর মধ্যে গুটিকয়েক কারখানার পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করে গোটা পোশাক খাতের ওপর কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে বড় ধরনের বিপর্যয় হয়ে দেখা দেবে।

মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটিইএক্সএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্ববাজার থেকে ৯ হাজার ৯৯৩ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলারের পোশাক আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৯৭৪ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারের পোশাক। এ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা মোট পোশাকের ৯ দশমিক ৭ শতাংশের জোগান দেয় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শ্রম অধিকার নিয়ে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র যে নির্দেশনা জারি করেছে এর নেপথ্যে আসলে রাজনীতি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকেই বিভিন্নভাবে তারা কাজে লাগাতে চাইছে। শ্রমিক নেতা নামধারী কেউ কেউ পোশাক খাতকে অশান্ত করার জন্য নানা রকম ষড়যন্ত্র করছে।

তিনি আরও বলেন, শ্রম অধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের পোশাক খাতে যে সামান্য দুর্বলতা রয়েছে, সে ধরনের দুর্বলতা চীন, ভিয়েতনাম, ভারত প্রত্যেকটা দেশেই আছে। তবে এখন কেউ বা কোনো দেশ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু করে, সেটি ভিন্ন বিষয়।

তৈরি পোশাক রপ্তানির শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতি নিয়ে গার্মেন্ট শিল্পমালিকরা খুবই চিন্তিত। এখন পর্যন্ত বিষয়টি যতটুকু বোঝা গেছে তাতে মনে হচ্ছে, এ নীতি ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয়ভাবেও আরোপের সুযোগ রয়েছে। তাই এখনই বিষয়টিকে কূটনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা জরুরি।

একক দেশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের পোশাক রপ্তানির বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে ৪ হাজার ৫৭০ কোটি ৯১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৯০৫ কোটি ৯৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ হিসাবে মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।

এদিকে দেশের গার্মেন্ট মালিকরা শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্দেশনার পেছনে রাজনৈতিক যোগসূত্র থাকার দাবি করলেও শ্রমিক নেতারা ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের ভাষ্য, এ নিয়ে উদ্বেগের কথা বলে গার্মেন্ট মালিকরা মূলত সরকারের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে। তাদের উদ্বেগ হওয়া দরকার নতুন আইনে যাতে তাদের কারখানার শ্রমিকদের শ্রম অধিকারের কীভাবে উন্নত করা যায়। কীভাবে কত দ্রুত শ্রম অধিকারগুলো কারখানায় দিতে পারে তার জন্য তাদের উদ্যোগী হতে হবে।

শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার কিংবা পোশাক মালিকদের দিক থেকে যতই বলা হোক, দেশে শ্রমিকদের কথা বলার অধিকার আছে, শ্রম পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে- কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। আর যখন কোনো দেশে কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার বিষয়ে দুর্বলতা থাকে, তখনই সেখানে বাইরের কেউ এসে কথা বলার সুযোগ পান। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে নিজেদের দুর্বলতা নিজেদেরই দূর করা জরুরি। অথচ দেশের গার্মেন্ট মালিকরা সেদিকে নজর না দিয়ে এ ইস্যুটিকে রাজনীতির কাঁধে চাপিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ডক্টর গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে শ্রমিকদের যে মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশন আইএলও-ও প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আপত্তি করেছে। সুতরাং শ্রমিকদের বেতন পুনর্বিবেচনা করা দরকার। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলনে অনেক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। অনেকের নামে মামলা হয়েছে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও শ্রমিকদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন। তাতে একটি বিষয় পরিষ্কার হবে যে, শ্রমিক কল্যাণে কাজ হচ্ছে। যদি এ বিষয়গুলোকে হালকাভাবে নেওয়া হয় তবে রপ্তানি খাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন আইন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

তবে এই গবেষক আশাবাদী, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, চাকরি ও জীবনমানের বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরিতে শ্রম মন্ত্রণালয় যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার বাস্তবায়ন হলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন আইন কোনো সমস্যার সৃষ্টি করবে না।

যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকেই এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তারা মনে করেন, নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করেছে, তাতে দেশে শ্রম পরিস্থিতির যতই উন্নতি হোক না কেন তাদের কৌশলী চাপ অব্যাহত থাকবে। রাজনীতির এ ফাঁদে পড়ে গার্মেন্ট শিল্পে চরম মন্দা দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2