অক্টোবরে রাজপথ কার?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:০৯ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভিসানীতি’ কার্যকরের উত্তাপে দেশের রাজনীতির বাতাস এখন প্রচ- গরম। এর মধ্যে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার জানিয়েছেন প্রথম দফা ভিসা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হলেও প্রয়োজনে আরো নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস পার্লামেন্টে ‘অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনস’ দলের এমপি আবিগালি বয়েড গত ২১ সেপ্টেম্বর সুষ্ঠু নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তি, র্যাব ও ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে ম্যাগনিটস্কি স্টাইল স্যাংশনের দাবি জানিয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে আগামী ৩৫ দিন রাজপথ ‘পাহারা’ দেবে। বিএনপি অক্টোবরে সরকার পতনের দাবিতে ‘ঢাকা অচল’ করার ঘোষণার পর দলটি এই সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করে। অন্যদিকে আন্দোলনরত বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে অক্টোবরে তারা ‘অল আউট’ কর্মসূতিতে নামবে। বড় দল দু’টির নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের নেতারা যে আক্রমণাত্মক ভাষায় কথাবার্তা বলছেন তাতে করে বিশেষজ্ঞদের ধারণা আগামী অক্টোবর মাসে রাজপথে রাজনীতি ভয়ঙ্কর রুপ নেবে এবং কোনো একটা ফয়সালা হবে। গতকালও দুই সমাবেশে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কত মায়ের বুক খালি করে, কতজনকে স্বামী হারা, বাবা হারা করে বিএনপি এখন নিজেই কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বাংলাদেশ কান্নার দরিয়া হয়ে যাবে তবুও পিতৃহত্যা, মাতৃহত্যার প্রতিশোধ আমরা নেব। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার স্বেচ্ছাচারী দুলুমবাজ রাজার সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, প্রতাপশালী এই আওয়ামী লীগ সরকারের মতো হীরক রাজা ইচ্ছামতো দেশ চালাত, যেমন খুশি তেমন। শেষে মানুষ বিদ্রোহ করলো। বিদ্রোহ করে মানুষ রাজার একটা স্ট্যাচু বানিয়েছিল। স্ট্যাচুতে একটা দড়ি লাগিয়ে মানুষ বললো, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান’। এই দড়ি ধরে টান মেরে বর্তমানে দেশের এই অবৈধ রাজাকে খানখান করা হবে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ভোটের অধিকার হারিয়েছেন। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিগত দুই বছর ওয়াশিংটনে আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র সম্মেলনে’ বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি। দেশটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করতে ‘ভিনানীতি’ ঘোষণা করেছে। সেই ভিসানীতির আলোচনা এখন আকাশ-বাতাসে ভাসছে। অন্ধকার রাতে ভীতি সন্ত্রস্ত হয়ে রাস্তায় চলার সময় ভয় পেলে যেমন মানুষ বড় গলায় গান করে; সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী এমপিরা সেইভাবে ‘ভিসানীতি’ ভয় করিনা জাতীয় কথাবার্তা বলছে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। প্রকাশে ‘ভিসানীতি’ ভয় করি না বললেও ভিতরে ভিতরে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তবে আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানের রয়েছে। দল দু’টি এখন রাজপথে পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। মূলত আগামী ১ নভেম্বর থেকে নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে। সংবিধান অনুসারে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে (১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ সময়ে যে সরকার থাকবে, তা নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে পরিচিত। ফলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে।
আওয়ামী লীগ অবশ্য দাবি করছে তারা কোন পাল্টা কর্মসূচি দেয়নি বরং তাদের কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো জনমনে ‘ভীতি দূর করে নির্বাচনের আবহ’ তৈরি করা। সরকারের পদত্যাগের যে দাবি বিএনপি করছে তাতে কোন আপোষ তারা করবে না এমন অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে ‘নির্বাচন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের বক্তব্যকে ধর্তব্যেই’ আনতে রাজী নয় তারা। আওয়ামী লীগের আপোষ না করা অন্যদিকে বিএনপির সরকারের পদত্যাগ ছাড়া নির্বাচন নয়- এমন মুখোমুখি পরিস্থিতির মধ্যে দেশব্যাপী পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন উভয় দল আরো বেগবান করছে। এনিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলছেন, উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনে ব্যর্থ হলে অক্টোবরে নভেম্বরে কেউ না চাইলেও মনে হচ্ছে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকবে না। পরিস্থিতি সহিংস হোক আর না হোক- আবারো একটি একতরফা নির্বাচনের পরিস্থিতির আশংকাও করছেন অনেকেই; যা কারো কাম্য নয়।
নির্বাচন কমিশন বলছে তারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভিসানীতি’ নিষেধাজ্ঞা সাইড লাইনে রেখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে কোন প্রক্রিয়ার সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তা অক্টোবর মাসেই পরিস্কার হয়ে যাবে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, অক্টোবর বিশ্ব রাজনীতিতে তৎপর্যপূর্ণ মাস। ১৯১৭ সালের ‘অক্টোবর বিপ্লবে’ রুশ সা¤্রাজ্যের পতনের মাধ্যমে বলশেভিকদের বিজয় হয় এবং দ্বিতীয় নিকোলাস ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওই বিপ্লব অক্টোবর শুরু হলেও তার পরিসমাপ্তি ঘটে ৭ ও ৮ নভেম্বর। বাংলাদেশের জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ক্ষমতাসীনদের জুলুম-নির্যাতন রুশ বিপ্লবের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও মুখোমুখি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা একে অপরকে ঘায়েল করতে যে ‘কথার বোমা’ ছুঁড়ে দিচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে অক্টোবর মাস দেশের রাজনীতিতে ‘ভয়ঙ্কর মাস’ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
টার্গেট ৪৫ দিন : গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকবে কি না, গণতান্ত্রিক অধিকার থাকবে কি না, জনগণ তার প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে কি না সবকিছু নির্ভর করছে আগামী কয়েকটা দিনের ওপর।’ জানা যায়, অক্টোবরে বিএনপি সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে। সেজন্য ৪৫ দিনের একটি চূড়ান্ত পরিণতির ‘টার্গেট’ নিয়েছে দলটি। এটার নাম দেয়া হচ্ছে ‘অলআউট’ কর্মসূচি। ১৮ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। নভেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আন্দোলনের চূড়ান্ত ফল পেতে চায় দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। বিএনপির একাধিক নেতা জানান, এক দফা দাবি আদায়ে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই লাগাতার অলআউট আন্দোলন নামবে বিএনপি। সব কর্মসূচি হবে রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। সমমনা দলগুলো যুগপৎভাবে রাজপথে থাকবে। সভা-সমাবেশের মধ্য দিয়ে এ চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। আর মধ্য অক্টোবর থেকে ঘেরাওয়ের কর্মসূচিতে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন, সচিবালয়, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘেরাওয়ের সঙ্গে তখন টানা অবস্থান কর্মসূচিতে যেতে পারে বিএনপি।
আলটিমেটাম ৩৬ দিন : বিএনপিকে ৩৬ দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রাজধানীর উত্তরার আজমপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘শান্তি ও উন্নয়ন’ সমাবেশে বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে বিএনপিকে (তার ভাষায়) অপরাজনীতি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে বিএনপি যদি ‘সংশোধন’ না হয়, তাহলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের অপরাজনীতির কালো হাত ভেঙে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, বিএনপি প্রথমে অক্টোবরে রাজধানী ঢাকা অচল করে সরকার পতনের চেষ্টা চালাবে। এই কর্মসূচি ঠেকাতে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এমনকি অঘোষিতভাবে বিএনপি হঠাৎ করে রাস্তায় নেমে যেতে পারে, এমনটাও বিবেচনায় রেখেছে ক্ষমতাসীন দল। সে ধরনের পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ের নোটিশে রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। বিএনপিকে ঠেকানোর পাশাপাশি মাঠ ছাড়বে না আওয়ামী লীগ। দলটির নেতাদের মতে, অক্টোবরে ঢাকার কর্মসূচিগুলো কী ধরনের হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে সভা-সমাবেশের কর্মসূচি বেশি থাকবে। বিএনপির যে ধরনের কর্মসূচি দেবে, তা প্রতিহত করার পাল্টা কর্মসূচি থাকবে আওয়ামী লীগের। দলটির একাধিক নেতা জানান, বিএনপি যদি খালি হাতে সমাবেশ করে, আওয়ামী লীগও খালি হাতে সমাবেশ করবে। বিএনপি ঘেরাও কিংবা অবরোধ জাতীয় কর্মসূচি দিলে তা আক্রমণাত্মক হতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটাসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েই নামবে। মুক্তিযোদ্ধা, পরিবহন শ্রমিক, সংস্কৃতিসেবীসহ পেশাজীবীদেরও মাঠে নামানো হবে। বিএনপিকে প্রতিহতের পাশাপাশি রাজধানীর প্রতিটি আসন ধরে ধরে সমাবেশের পরিকল্পনা করছে।
গাজীপুরের টঙ্গীতে এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৩৬ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছি বিএনপিকে। এই ৩৬ দিন বিএনপিকে দাঁড়াতে দেব না। সব জায়গা বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের দখলে থাকবে, শেখ হাসিনার কর্মীদের দখলে থাকবে। অক্টোবরে নাকি সবশেষ। বিএনপির কী হবে অক্টোবরে? ১৫টা অক্টোবর দেখলাম আগামীতেও দেখবো।
নারায়ণগঞ্জে বিএনপির সমাবেশে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, এ স্বৈরাচারী সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দেশ চালাচ্ছে। গণতন্ত্রকে হরণ করেছে। এ গণতন্ত্রকে আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাংলাদেশের ভেতরে নয়, দেশের বাইরের মুক্তিকামী বিশ্বের প্রতিটি মানুষ এটা টের পেয়ে গেছে। আগামী মাসেই গণতন্ত্র ফিরে আসবে।