বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে দৌড়ঝাঁপ কূটনীতিকদের
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ আগস্ট,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:০৯ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রয়েছে। এজন্য তারা বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনসহ সকল অংশীজনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে। কীভাবে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায় এটিই তাদের লক্ষ্য বলে নিজেরাই বলছে। তবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না। সবচেয়ে বেশি দৌড়ঝাঁপ করছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। তিনি প্রায় প্রতিদিনই কারও না কারও সঙ্গে বৈঠক করছেন।
নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুসারে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে হিসেবে নির্বাচনের সময় বাকি পাঁচ মাসেরও কম। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি অনড় অবস্থানে। আওয়ামী লীগ চায় সংবিধান অনুসারে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন। আর বিদেশীরা চায় যেভাবেই হোক সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানামুখী চাপে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে সকল চাপ উপেক্ষা করে তারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের সার্বিক ব্যবস্থা চূড়ান্ত করছেন। এজন্য ইসি এখন কর্মব্যস্ত সময় পার করছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বছরখানেক আগে থেকেই বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে চিঠি চালাচালিসহ বিভিন্নভাবে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ কামনা করে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে সরকারকে চাপে রাখতে বিএনপি তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি জোরদার করতে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে তাগিদ দিতে থাকে। তারা এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সহযোগিতাও কামনা করে। নির্বাচন কমিশন থেকে তাদের সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কার্পণ্য করা হবে না। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয় সংবিধান অনুসারে বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সকল অংশীজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও যখন দেখতে পায় সরকার ও রাজপথে বিরোধী দল পরস্পরকে আস্থায় আনতে সংলাপ বা সমঝোতার চেষ্টা না করে অনড় অবস্থান বজায় রেখে সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সে রকম পরিস্থিতিতে ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করে। এতে বলা হয় যাদের কারণে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ব্যাহত হবে তাদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ভিসা দেওয়া হবে না। এই ভিসানীতির পর বিএনপি নেতারা উল্লাস প্রকাশ করতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই ভিসানীতি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি যারাই করবে সরকার হোক আর বিরোধী দল হোক অথবা প্রশাসনের কেউ হোক সবার বেলায় এটা প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যাখ্যার পর বিএনপিও ভিসানীতি নিয়ে আর তেমন মাতামাতি করছে না।
ভিসানীতি ঘোষণার পরও সরকার ও রাজপথে বিরোধী দল অনড় অবস্থান থেকে সরে আসছে না দেখে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন উদ্যমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠককালে তারা একটা কথাই জোর দিয়ে বলেন, তাদের দেশ বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। তবে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা একবারও উচ্চারণ করেননি। যতবারই তাদের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছে নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে দেখতে চান ততবারই তারা বলেছেন, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে তারা বারবারই বলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থেই তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চান।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে অতিসম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি তৎপর রয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। ১ আগস্ট আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। পরদিন বুধবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৫ দেশের কূটনীতিকরা গুলশানের একটি হোটেলে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেন। তার পরদিন বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনী পরিবেশ দেখতে অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যবেক্ষক টিম বাংলাদেশে আসবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করে। এর আগে ৮ জুন সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তখন তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। সেই নির্বাচনে কে বিজয়ী হবে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা নেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ চার দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল। তারা আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও চার নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তারা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অসাংবিধানিক ও অবৈধ। নির্বাচন কমিশন সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত, তারা স্বাধীন। তাই সংবিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন করতে পারে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, বিদেশী কূটনীতিকরা সকল রাজনৈতিক দলকে আস্থায় এনে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এজন্য তারা বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করেছেন। তবে বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের বাইরে গিয়ে তারা কিছু করবেন না। পর্দার অন্তরালে তাদের কি কৌশল রয়েছে না জানালেও তারা সবসময়ই বলছে, কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে তারা কাজ করছেন না। তারা কাজ করছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, অক্টোবরের শেষদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এ নির্বাচনে অংশ নিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট, জাতীয় পার্টিসহ বেশ ক’টি দল প্রস্তুতি জোরদার করছে। এই দলগুলো প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বললেও ভেতরে ভেতরে বিএনপিও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এজন্য ৩০০ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। এ তালিকায় একই আসনে একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম থাকলেও তফসিল ঘোষণার পর প্রার্থী চূড়ান্ত করবে যদি নির্বাচনে যায়।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিক ও বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে আসা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণের আগে পশ্চিমা দেশগুলো আগে বিএনপির প্রতি কিছুটা নমনীয় থাকলেও পরে তাদের ধারণা পাল্টে যায়। এখন তারা মনে করছে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী অবস্থানে নিরপেক্ষ থেকে প্রশাসনকে দায়িত্বশীল করার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়। নির্বাচন কমিশনও তাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে। বর্তমান সরকারের ভালো চান এমন দেশী-বিদেশী মহল বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন করতে যা যা প্রয়োজন তা করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তাগিদ দিচ্ছে। এ কারণে সরকার এখন বিএনপিসহ রাজপথে বিরোধী দলগুলোকে অবাধে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে। আবার বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নির্বাচনের পক্ষে যারা কাজ করছেন, তাদের পরামর্শে বিএনপি এখন রাজপথের কঠোর আন্দোলনের অবস্থান থেকে সরে কিছুটা নমনীয় হয়েছে।
সূত্র মতে, বিএনপি আশা করেছিল রাজপথে আন্দোলন জোরদার করার পর বিদেশীরা তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন জানাবে। কিন্তু প্রায় সাত মাসের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিক আন্দোলনের পরও বিদেশীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা উচ্চারণ না করে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন। আবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার কথা বলছেন। নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি আপাতত হার্ডলাইনে না গিয়ে গতানুগতিক কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।