গুরু পাপে লঘু শাস্তি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ জুলাই,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:৩১ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের ঘটনায় ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ পাঁচ শিক্ষার্থীকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
অন্তরা ইবির পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী (সেশন ২০১৭-১৮)। বহিষ্কৃত অন্যরা হলেন– চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের হালিমা আক্তার ঊর্মি (সেশন ২০২০-২১), আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ইসরাত জাহান মিম (সেশন ২০২০-২১), ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের তাবাসসুম ইসলাম (সেশন ২০২০-২১) এবং একই বিভাগের একই সেশনের মোয়াবিয়া জাহান। এর মধ্যে সানজিদা চৌধুরী ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি ছিলেন, অন্যরা সবাই ছাত্রলীগের কর্মী। এ ঘটনায় পাঁচজনকেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
গত ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ইবির দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরার নেতৃত্বে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে সাড়ে চার ঘণ্টা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এ সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, মারধর এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করে ভিডিও ধারণ করা হয়। ঘটনা বাইরে প্রকাশ করলে তাঁকে হত্যারও হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় সারাদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উচ্চ আদালতের নির্দেশে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে গতকাল শনিবার অভিযুক্ত সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তাঁর চার সহযোগীকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
কিন্তু ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির সভার এই সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ অনেকেই অবাক হয়েছেন। তারা বলেন, এটি ‘গুরু পাপে লঘু দণ্ড’ হয়েছে। কারণ, এর চেয়ে ছোট ঘটনায়ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু-তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
অভিযুক্তদের এই শাস্তিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন নির্যাতনের শিকার ফুলপরী খাতুন। জড়িতদের আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তা না হলে আমি মনে হয় এখানে পড়তে পারব না, আমার পড়াই হবে না। ওরা ফিরে এসে নিশ্চিত আমার সঙ্গে আবার কিছু করবে, প্রতিশোধ নেবে। আমাকে বাধ্য হয়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে।’ ফুলপরী সমকালকে বলেন, ‘তারা আমার ওপর যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে, সেজন্য তাদের এক বছরের শাস্তি যথাযথ নয়। আমি আতঙ্কিত।’
‘লঘু শাস্তি’র বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শাহাদৎ হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে এটি সর্বোচ্চ শাস্তি। এই সময়ে বহিষ্কৃতরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষাসহ কোনো কিছুতে অংশ নিতে পারবে না।’
নির্যাতনের ঘটনার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ফুলপরী লিখিত অভিযোগ দেন। ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে ১৫ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশনের আওতায় অভিযুক্তদের ওয়ারেন্ট চেয়ে রিট আবেদন করেন আইনজীবী গাজী মো. মহসীন। এর পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিন সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে একে একে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, হল প্রশাসন ও শাখা ছাত্রলীগ তদন্ত কমিটি গঠন করে।
এই চার কমিটি প্রায় দুই সপ্তাহ তদন্ত শেষে অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে অভিযুক্ত পাঁচজনকে ছয় মাসের জন্য সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর চার মাস পর উচ্চ আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির সভায় শনিবার অভিযুক্তদের সাজা প্রদানের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস কোড অব কন্ডাক্ট-১৯৮৭-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৮ ধারায় এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী অন্তরাসহ পাঁচ অভিযুক্তকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ বহিষ্কারাদেশ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই কার্যকর। ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে সিদ্ধান্তটি হাইকোর্টে পাঠানো হবে।
স্টুডেন্টস কোড অব কন্ডাক্টের ওই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো শিক্ষার্থী অসদাচরণ বা নিয়ম ভঙ্গ করলে উপাচার্য ৫০০ টাকা জরিমানা করতে পারবেন। যদি জরিমানা পর্যাপ্ত না হয়, তবে শৃঙ্খলা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ এক বছরের জন্য বহিষ্কার করতে পারবেন।’ প্রক্টর অধ্যাপক শাহাদৎ হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি এবং হাইকোর্টের প্রতিবেদনের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টস কোড অব কন্ডাক্ট অনুযায়ী চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর সিদ্ধান্তের সময় থেকেই বহিষ্কারাদেশ কার্যকর হবে।’
ইবি উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আবদুস সালামের সভাপতিত্বে গতকাল শৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া, প্রক্টর অধ্যাপক শাহাদৎ হোসেন আজাদ, ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক সেলীনা নাসরীন, আইন প্রশাসক অধ্যাপক আনিচুর রহমান, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এইচ এম আলী হাসানসহ কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ইবি কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, ‘অপরাধীদের প্রাথমিকভাবে বহিষ্কার করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। এর পর তদন্ত করে বের করতে হবে তাদের অপরাধের মাত্রা কতটুকু ছিল, সে অনুযায়ী শাস্তি হয়েছে কিনা, ভুক্তভোগী এ সাজায় সন্তুষ্ট কিনা– সবকিছুই পর্যায়ক্রমে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। এ ঘটনায় ফৌজদারি মামলা হয়েছিল কিনা, হয়ে থাকলে কী পর্যায়ে আছে– এগুলোও দেখতে হবে।’
ইবি ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, ‘র্যাগিংয়ের মতো এমন জঘন্য অপরাধ বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করে। এ ধরনের অপরাধীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা প্রয়োজন। নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের ঘটনা প্রতিরোধে প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধীদের যেন কোনো ঠাঁই না হয়, এ ব্যাপারে প্রশাসনের আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুখলেসুর রহমান সুইট বলেন, ‘এমন র্যাগিংয়ের ঘটনায় এক বছরের বহিষ্কার যথেষ্ট নয়। এই শাস্তিকে কোনোভাবেই দৃষ্টান্তমূলক বলা যায় না। অপরাধীদের এমন শাস্তি হওয়া প্রয়োজন যেন দ্বিতীয়বার কেউ এমন সাহস না করে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আইন প্রশাসক ও আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘এমন একটি ঘটনার জন্য এত কম শাস্তি কাম্য নয়। তবে আচরণবিধিতে যা আছে, প্রশাসন তো এর বাইরে যেতে পারবে না। এ জন্য কোড অব কন্ডাক্ট সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যুগের সঙ্গে মিলিয়ে সংশোধনী আনা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘র্যাগিং যেহেতু একটি ফৌজদারি অপরাধ, তাই যে কেউ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করতে পারবে। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হতে পারে, ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের যে কেউও হতে পারে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই অথরিটি, তাই তারা তাদের শাস্তি নিশ্চিত করেছে।’
রিটকারী আইনজীবী গাজী মো. মহসীন অভিযুক্ত পাঁচ শিক্ষার্থীর সাজার বিষয়ে বলেন, ‘আমি শুনেছি শুধু, আদেশের কপিটা এখনও দেখিনি। আমার কাছে আসুক। আগে দেখি, তার পর মন্তব্য করব।’
এদিকে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো ফৌজদারি মামলা হয়নি। এমনকি তদন্তে ভুক্তভোগীর বিবস্ত্র ভিডিও ধারণের সত্যতা পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। এর পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানায় এর আলোকে একটি চিঠি পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেলেও মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আননূর যায়েদ বিপ্লব বলেন, ‘মোবাইল ফোন উদ্ধারের জন্য আমরা চিঠি পেয়েছি। কিন্তু এখনও উদ্ধার করা যায়নি।’ তবে উদ্ধার করতে না পারার কারণ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।