avertisements 2

জামায়াত নিয়ে হয়তো পর্দার আড়ালে কিছু হচ্ছে: বদিউল আলম মজুমদার

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ জুলাই,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:০০ পিএম, ১৮ মে,শনিবার,২০২৪

Text

জামায়াতে ইসলামী কার সঙ্গে– তা নিয়ে রাজনৈতিক সক্রিয় মহলে চলছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। আওয়ামী লীগ বলছে, জামায়াত বিএনপির সঙ্গী। বিএনপি নেতারা জামায়াত তোষণের অভিযোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের দিকে। যদিও খোদ জামায়াতে ইসলামী বলছে, বিএনপি জোট ভেঙে দেওয়ার পর তারা একা পথ চলছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জামায়াতকে বিএনপির ‘বি টিম’ বলে অভিহিত করেছেন। যদিও ক্ষমতাসীন দলের চাওয়া, দুই দল যেন আবারও জোটবদ্ধ না হয়।

তবে সাংগঠনিক দূরত্ব বজায় রাখলেও বিএনপি চাইছে আন্দোলনে জামায়াত থাকুক। তাই ‘সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ রয়েছে’ বক্তব্য দিয়েও অবস্থান বদল করেছে বিএনপি। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে কূটরাজনীতি চলছে। গত এক দশকে জামায়াত সভা-সমাবেশের অনুমতি পায়নি।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গটি নতুন করে তোলেন সে সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ। তখন থেকে রাজনীতিতে কোণঠাসা জামায়াত। ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় তারা। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির সাজা হয়েছে। আদালতের রায়ে দলটির নিবন্ধনও বাতিল। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কথা বলে আসছে আওয়ামী লীগ। যদিও সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সেই পদক্ষেপ অদ্যাবধি নেওয়া হয়নি। তবে দলটির সব কার্যালয় অঘোষিতভাবে বন্ধ। নেতাকর্মীরাও ব্যাপক ধরপাকড়ের মুখে ছিলেন গত এক যুগ। জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এখনও আটক অনেক নেতাকর্মী।

গত ২৫ মে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর এক দশক পরে ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি পায় জামায়াত। ১০ জুন ঢাকায় তারা সমাবেশও করে। পাশাপাশি সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যে জামায়াত বিষয়ে নমনীয়তা দেখা যায়। এতদিন তাঁরা দলটিকে নিষিদ্ধের কথা বললেও জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে নানা যুক্তি দেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার প্রতিবেদনে জামায়াত ও দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর নিপীড়নের প্রসঙ্গ আসে। দেশটির ঢাকার দূতাবাস জামায়াত নেতাদের যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের আসন্ন অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছে। এভাবে এক দশক পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে দলটির যোগাযোগ আবার শুরু হয়। 

জামায়াত ঢাকার বাইরে বড় শহরেও সমাবেশ করার পরিকল্পনা করছে। দলটির কুমিল্লা মহানগর সেক্রেটারি এমদাদুল হক মামুন গতকাল রোববার জানান, আগামী ১৫ জুলাই সমাবেশ করতে শিগগির পুলিশের কাছে অনুমতি চাওয়া হবে। যদিও জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, সমাবেশের কর্মসূচি পেছাতে পারে।

এসব মিলিয়ে প্রকাশ্যে জামায়াতের ফিরে আসা রাজনীতিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। বিএনপির সন্দেহ, সরকারের সঙ্গে কোনো না কোনো সমঝোতা হয়েছে জামায়াতের। আওয়ামী লীগ তা অস্বীকার করলেও সরকারি বিভিন্ন সূত্র বলছে, আন্দোলনের মাঠে বিএনপিকে একা করতে জামায়াতকে আলাদাভাবে কর্মসূচি করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

গত শুক্রবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট।’ পরদিন জামায়াত এ বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। যদিও মির্জা ফখরুল দাবি করেছেন, তাঁর বক্তব্য ভুলভাবে এসেছে। তিনি বলেন, ‘সরকারে পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে চলমান আন্দোলনে যুগপৎভাবে জামায়াতসহ বিভিন্ন দল রয়েছে। এ নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই।’

জামায়াতের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের ব্যাখ্যা বিএনপি দিয়েছে। বিএনপি সূত্রের ভাষ্য, মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে গ্রহণ করেনি জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিএনপির একটি সূত্র বলেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে দু’জন নেতা কথা বলেছেন জামায়াত নেতৃত্বের সঙ্গে। তাঁরা আশ্বস্ত করেছেন– মহাসচিবের বক্তব্য দলীয় অবস্থান নয়।

তবে এতে সন্তুষ্ট নয় জামায়াত। সে কারণে মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ আখ্যা দিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছে তারা। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেওয়া এবং কারাগারে আটকে রাখা সরকারের সঙ্গে আপসের প্রশ্নই আসে না।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্য বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেছেন, বিষয়টি এখন অতীত। জামায়াত কার সঙ্গে আছে– সে প্রশ্নে তিনি বলেছেন, জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে। জামায়াত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না– এটাই তাঁদের শেষ কথা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও জামায়াত প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে নারাজ।
বিএনপির একাধিক সূত্রের ভাষ্য, স্বাধীনতার বিরোধিতার দায় এড়াতে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করলেও দলটিকে আন্দোলনে চায় বিএনপি। সে কারণেই দলটির সঙ্গে বৈরিতা তৈরি করতে চায় না তারা। এ কারণে জামায়াত বিষয়ে বক্তব্য না দিতে দলীয় নেতাদের বলা হয়েছে। বিএনপির নীতি হলো, জোট হবে না। বিএনপি ও জামায়াত যে যার মতো আন্দোলন করবে। নির্দলীয় সরকার অথবা সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায় করার পরই কেবল নির্বাচনী জোটের বিষয়টি আসবে।

জামায়াতের একজন জ্যেষ্ঠ নেতাও একই তথ্য জানিয়েছেন । তিনি বলেছেন, বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়ে জোট ভেঙেছে। সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে বিএনপিকেই দায়িত্ব নিতে হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির আন্দোলনে জামায়াত অংশ নেবে কিনা– এ প্রশ্নে এই নেতা বলেছেন, জামায়াত নিজের মতো করে আন্দোলন করবে। তবে নির্বাচনী বছরে প্রতিদিনই পরিস্থিতির বদল হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে, আগামী মাসে বা ছয় মাস পর কী করা হবে; সেই সিদ্ধান্ত এখন নেওয়ার পরিস্থিতি আর নেই। অনেক কিছুই হতে পারে।  

জামায়াত প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে রাজি হননি আওয়ামী লীগ নেতারা। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলেননি। সুজন সম্পাদক আরও বলেছেন, হয়তো পর্দার আড়ালে কিছু একটা হচ্ছে। তাই জামায়াত হঠাৎ মার্কিন আমন্ত্রণ পাচ্ছে; সমাবেশ করতে পারছে। তবে এসব কূটরাজনীতির চেয়ে জরুরি হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবার সমঝোতা। গত দু’বারের মতো নির্বাচন হলে, এবার রাজনীতি কারও জন্যই সুখকর হবে না।

তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত একজন নেতা বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে দৃশ্যমান সম্পর্ক তৈরি করা অসম্ভব। বিরোধী দলগুলোকে সভা-সমাবেশের সুযোগ দিতে মার্কিন ভিসা নীতি ছাড়াও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। সে কারণেই জামায়াতকে কিছুটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনেরও চাপ রয়েছে। বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আবারও নির্বাচন বর্জন করলে জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল যদি অংশ নেয়, তাহলে আওয়ামী লীগ লাভবান হতে পারে। বিএনপি বর্জন করলে জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা– এ প্রশ্নের জবাব অবশ্য দলটি দিচ্ছে না।

তবে জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবেই বলছে, মার্কিন নীতির কারণে সমাবেশ করতে দিলেও সরকার ছাড় দিচ্ছে না। এখনও দলীয় কার্যালয় খুলতে দিচ্ছে না। আগের মতো ঢালাও আটক করা না হলেও গ্রেপ্তার থেমে নেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানীয় পর্যায়ের নেতা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার জামিন পেলেও পুরোনো মামলায় বা নতুন মামলা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা আগামী দিনের রাজনীতির সমীকরণ মাথায় রেখে জামায়াত প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে খোলামেলা বক্তব্য দিতে নারাজ। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে আরও বলেছেন, যে জামায়াতকে কয়েক দিন আগেও ধরপাকড় ও নিষিদ্ধের কথা বলা হচ্ছিল, তাদের এখন সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। দুই বড় দল পরস্পরের বিরুদ্ধে জামায়াত-সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বলছে। আসলে পুরো বিষয়টিই সবার জন্য বিভ্রান্তিকর।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2