avertisements 2

এবারও তুরুপের তাস জাতীয় পার্টি

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ এপ্রিল, বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:১৩ এএম, ১৮ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪

Text

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মরহুম রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালীন প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ও তার দলকে তরুপের তাস হিসেবে দেখে আসছে দেশের মানুষ। এরশাদ মৃত্যুর পর আবারও তরুপের তাস হয়ে উঠেছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপা।

ক্ষমতার রাজনীতিতে বরাবরই সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ছিলেন তুরুপের তাস। এ তাসকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই বেশি ব্যবহার করেছে। বিএনপিও চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে তাস হিসেবে তাকে ব্যবহার করা যায়নি। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকারপ্রধান হিসেবে আসার পর ভয়ভীতি দেখানো হয় এরশাদকে। পুরনো মামলায় তাকে জেলে দেয়া হবে, নতুন করে আরও মামলা দেয়া হবে- এমন ভীতি প্রদর্শনের ফলে এরশাদ ২০০৫ সালে জাতীয় পার্টি নিয়ে মহাসমারোহে খালেদা জিয়ার জোটে যোগ দেন। খালেদা জিয়াও তাকে কাছে টেনে নেন। ২০০৭ সালের এক-এগারোর কিছু আগে সেই সমীকরণ পাল্টে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এরশাদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেন। ২০০৯ সাল তিনি এবং তার দল ক্ষমতার ভাগিদার হন। ভোটের রাজনীতিতে ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুতির পর নানা মামলায় হাত-পা বাঁধা ছিল এরশাদের। সেই ধারাবাহিকতায় আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আবারো টানাটানি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

ওয়ান-ইলেভেনের পর প্রথমবারের মতো পরস্পরের ইফতার আয়োজনে যোগ দিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। গত ২ এপ্রিল রাজধানীর হোটেল রেডিসন ব্লু–তে জাপার ইফতারে অংশগ্রহণ করেন বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা। পরদিন ৩ এপ্রিল বিএনপির ইফতারে যোগ দেন জাপার পাঁচ নেতা। ১৬ বছর পর বিএনপি ও জাপার কাছাকাছি আসার বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিতে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এই আলোচনাকে ইতিবাচক দেখছেন জাপার শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। তারা বলছেন রাজনীতিতে হিংসা হানাহানি চাই না। রাজনীতি হবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এমনটি জানিয়েছেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম এমপি। তিনি গতকাল মানবকণ্ঠকে বলেন, আমরা রাজনীতি করি দেশের জন্য, মানুষের জন্য।

এদিকে ওয়ান-ইলেভেনের পর প্রথমবারের মতো বিএনপি ও জাপার কাছাকাছি আসাটা রাজনীতিতে নতুন বার্তা যোগ হচ্ছে। এই বার্তাটি কতদূর এগিয়ে যাবে তা কেউ পরিষ্কার করে বলছেন না। তবে সবাই ইতিবাচক দেখলেও অনেকে মনে করছেন, রাজনীতি শেষ কথা বলতে কিছু নেই। বিগত ২০০৯ সাল থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শন করে আসছে জাতীয় পার্টি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেই রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে তারা। ২০০৯ সাল থেকে বিএনপি ও জাপার সম্পর্ক বিপরীতমুখী। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের পক্ষ থেকে জাপাকে বরাবরই ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। ফলে এত দিনের দুমুখো সম্পর্কে এখন উষ্ণতা এসেছে। গত ২ এপ্রিল জাপার ইফতারে যোগ দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান মনিরুল হক চৌধুরী ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম।

ইফতারের টেবিলে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম বলেন, আমরা চাই দেশের বর্তমান যে অবস্থা তার থেকে উত্তরণ। জনগণের ভোটাধিকারের প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দল, মত নির্বিশেষে একসঙ্গে আসুক-এটাই আমরা চাই। সরকার দেশের মানুষকে অতিষ্ট করে রেখেছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে, গ্যাস থাকছে না, মূল্য বাড়াচ্ছে; বিদ্যুৎ থাকছে না, দাম বাড়াচ্ছে; এসব থেকে মানুষকে রক্ষা পেতে মানুষ সোচ্চার হোক, এটাই আমরা চাই।

এদিকে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, কাউকে ক্ষমতায় নিতে, কারো বি-টিম হতে বা কারো দাসত্ব করতে আমাদের রাজনীতি নয়। আমরা দেশ ও জাতির স্বার্থে রাজনীতি করবো। যারা আমাদের সাথে বন্ধুর মর্যাদায় বন্ধুত্ব করতে চাইবেন, আমরা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবো। কারো জিম্মি বা ক্রীতদাস হতে রাজনীতি করছি না। রাজনীতিতে বন্ধুত্ব করতে হলে সমানে সমান বন্ধুত্ব করব, চোখে চোখ রেখে বন্ধুত্ব করব। রাজনীতিতে বন্ধুত্বের নামে কারো কাছে মাথা নত করব না।

অপরদিকে বিএনপির ইফতারে অংশ নেন জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী ফিরোজ রশীদ, মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলা ও ফখরুল ইমাম।

ইফতারে অংশ নেয়ার বিষয়ে জাপার একাধিক নেতা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও দলটির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য মানবকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনের আগে সরকার ও বিএনপি-উভয়পক্ষ থেকেই ডাক আছে জাতীয় পার্টির দিকে। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি চাইবে নিজেদের রাজনৈতিক দাম-দর নিয়ে সক্রিয় থাকতে। এর অংশ হিসেবেই পরস্পরের ইফতারে যোগ দিয়েছে।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচিতে যুক্ত এমন একটি দলের শীর্ষ নেতা বলেন, জাতীয় পার্টি হাওয়া বুঝে দিক ঠিক করবে। তারা এখন ঘুরবে। তারা দেখবে কারা শক্তিশালী, সরকার পক্ষ; নাকি বিএনপি। যারা প্রভাব বিস্তার করবে, তাদের পক্ষেই যাবে জাপা।’ আবার কোনো-কোনো নেতা এও বলছেন, ‘জাতীয় পার্টি দেশের আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল। টেকনিক্যাল কারণেই বিএনপির ইফতারে জাপার অংশগ্রহণ গুরুত্ববহ।

তবে জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা মনে করেন, এ পার্টির পরামর্শকরা সব দিকেই সুসম্পর্ক ছড়িয়ে রাখার কৌশল অবলম্বনের পক্ষে। নির্বাচন ইস্যুতে এখনই জোট গঠন বা কোন পক্ষে যাবে, তা নিয়ে বলার সুযোগ নেই। একইসঙ্গে রওশন এরশাদের বিষয়টিও যুক্ত। তিনি ইতোমধ্যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। আবার জাপার ইফতারেও অংশ নেননি। দলটির এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার মন্তব্য, বিএনপির অ্যাপ্রোচ ভালো। সে কারণে তারা ডাকে সাড়া দিয়েছে। আমরাও দিয়েছি।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, রাজনীতিতে মুখ দেখাদেখির চল প্রায় নেই। এটা তো শোভন নয়। আমরা বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তারা এসেছেন; তারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আমরা গিয়েছি। রাজনীতিতে এই সংস্কৃতি ফেরাতে হবে। বরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, আমাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে। ভবিষ্যতে কি হবে, সেটা তো বলতে পারি না। তিনি বলেন, শক্তিশালী দল হলেই সবাই আমাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে আসবে। আর সেক্ষেত্রে শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, প্রতিটি স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনেও জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জনের জন্যও পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে। সংগঠন শক্তিশালী করে আমরা নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে গণমানুষের সামনে গেলে উজ্জল ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলনের ঐক্য গড়ে জাতীয় পার্টি রাজপথে যখন ছিল তখন এরশাদ কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জেলে বসে তিনি পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ওই নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তার ও জাতীয় পার্টির জন্য ছিল না। নেতাকর্মীরা ছিলেন জেলে, নয়তো পলাতক। গণরোষে জাতীয় পার্টি সেই ভোটযুদ্ধে ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৯৬ সালে দায়ের করা মঞ্জুর হত্যা মামলাটি তখনও বিচারাধীন। রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে এক সপ্তাহের মধ্যে মামলাটির মীমাংসা হতো। কিন্তু মীমাংসা হয়নি। কারণ, এরশাদ হলেন মহাজোটের তুরুপের তাস, যেমনটি বিএনপির জন্য জামায়াত।

বিএনপি ভালো করেই জানে, জামায়াতকে ছাড়া নির্বাচনের পুলসিরাত পার হওয়া অসম্ভব। আওয়ামী লীগও বুঝে যায়, মুশকিল আসান করে দেবেন এরশাদ তথা তার জাতীয় পার্টি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনেও এরশাদ কারাগারে বসে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। তবে কারামুক্ত হয়ে এরশাদ জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী ও সুসংহত করতে কার্যকর, দূরদর্শী ভ‚মিকা রাখতে পারেননি। এতে দলটি ভাঙনের মুখে পড়ে। দলের অনেক নেতা তাকে ছেড়ে চলে যান। তিনি জেল খেটে অর্থদণ্ড দিয়ে বের হন এবং ওই সময় তিনি চারদলীয় জোটও ছাড়েন। কঠিন বিপর্যয়ের মুখেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৪টি আসন লাভ করে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হওয়ায় ভোটের পরদিনই এরশাদ দেশের বাইরে চলে যান। পরিবেশ অনুকূলে এলে দেশে ফিরে দল গোছানোর কাজে হাত দেন। সেই নির্বাচনের আগেও জাতীয় পার্টি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে।

২০০৬ সালে বাতিল হওয়া নির্বাচনের আগে নানা নাটকীয়তা ও শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার মধ্যে প্রধান দুই দল তাকে কাছে টেনেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে তিনি যখন পল্টনের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের মঞ্চে উঠলেন, তখন ১৪ দল মহাজোটে পরিণত হয়। সেবার আওয়ামী লীগ তাকে রাষ্ট্রপতি ও ক্ষমতায় এলে আনুপাতিক হারে মন্ত্রিত্ব দানের চুক্তি করেছিল। কিন্তু ওয়ান ইলেভেন এলে সেই চুক্তি তামাদি হয়ে যায়।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটে প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি আবারও দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। মহাজোট সরকারের অংশীদারও হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঘিরে দ্বিধাদ্ব›দ্ব, নানামুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ জাতীয় পার্টিকে আরেক দফা বিপর্যয়ে ফেলে। ভাঙনও দেখা দেয় দলে। তবুও সংসদে বিরোধী দল ও সরকারের অংশীদারত্ব পায় জাতীয় পার্টি।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে আবারও আসন নিয়ে দেন-দরবার শুরু করেন এরশাদ। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেন। সরকারের খুঁটি বেশ শক্তিশালী হওয়ায় এবং ব্যাপক উন্নয়নের কারণে আবারও শতভাগ ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থাকায় এরশাদ তেমন জেদ ধরতে পারেননি। ফলে আওয়ামী লীগ যে কয়টি আসন জাতীয় পার্টির জন্য ছেড়ে দেয় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।একাদশ সংসদে সরকারে মন্ত্রিত্বের ভাগ না পেয়ে বিরোধী দলে অবস্থান নেয় জাতীয় পার্টি। যদিও জাতীয় পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে সেই সময় জানায়, তারা বিরোধী দল হিসেবে রাজপথে ও সংসদে থাকবে। সরকারের গৃহপালিত বিরোধী দল হবে না।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2