জালাল উদ্দিন আহমেদ
বন্ধুত্বের কড়িকাঠ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ মে,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:৫৯ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
কথাগুলো ব্যক্তি বা গোষ্ঠি স্বার্থে বলা হয়েছিল কিনা জানা নেই। কারন যিনি বলছেন তিনি শুধু দেশের আইন প্রণেতাই নন একাধারে তিনি বিভিন্ন লাভজনক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাধর পদাধিকারীও বটে। তবে কথা বলার শেষ দিকে যে শ্লেষাত্মক অভিব্যক্তি শোনা গেল তা থেকে আমরা আম জনতা ধরে নিতেই পারি যে আঁতুড় ঘরের নাড়ির টানটা কিন্তু একই আছে। কারন যখন বলছেন এবং বার বার বলছেন যে আমরা টাকা অগ্রিম দিয়েছি এবং আমাদের টাকা দিয়েই ওদের উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হয়েছে তখন দ্বিপক্ষীয় ব্যবসায়িক ব্যাপারটা উন্মোচিত হয়। আবার যখন বলেন এবং বার বার বলেন “আমরা ওদের থেকে এগিয়ে আছি। আমাদের টেকনোলজি আছে, সক্ষমতা আছে” ইত্যাদি ধরনের কথাবার্তা তখন কোথাও যেন একটা অসহায়ত্বের আভাস ফুটে উঠে। এই অসহায়ত্ব বাঙালীর নয়। এই আত্মসমর্পন বাঙালী জাতীয়তাবোধের নয়। এই আত্মসমর্পন গোষ্ঠি কেন্দ্রিক এক অলিখিত দায়বদ্ধতার ফালনামা।
বলছিলাম, কোভিড-১৯ এর টিকাদান প্রসঙ্গে সৃষ্ট জটিলতায় একছত্র আধিপত্য নিয়ে এই কর্ম সূচীকে নিজের করে ধরে রাখার খেসারত হিসাবে বর্তমানে ত্রিশংকু অবস্থায় বিরাজ করা বেক্সিমকো ফার্মার এমডি জনাব নাজমুল হাসান পাপনের প্রেস ব্রিফিং নিয়ে। তিনি বলছেন “আমাদের দেড় কোটি ডোজের অর্ডার দেয়া আছে এবং তার মূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তা নিয়েই। সুতরাং টাকা নিবে এবং পন্য দিবে না তাতো হতে পারে না”। এক্ষেত্রে একটি অস্ফুট অসহায়ত্বের ছাপ তার কথার মধ্যে ফুটে উঠেছে। তাহলে কি দুই সরকারের দ্বিপক্ষীয় কোন ব্যাপার এখানে নেই? সরকার বনাম সরকারের সমঝোতায় যদি তা না হয়ে থাকে তবে সেটা মুস্কিল ব্যাপার বলেই ধরে নেয়া যায়। কারন সাপ্লাই ও ট্রেডের আওতায় ক্রেতা বিক্রেতার কোন চুক্তি হলে সেক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার থাকে বলে মনে হয়না। কারন যে দেশের সরবরাহকারী এই চুক্তি করেছেন তারা যদি তাদের দেশের সরকারী নতুন কোন বিধি নিষেধের আওতায় পড়ে তখন সরকারী প্রাধান্যই কার্যকরী হবে এবং প্রচলিত নিয়মে তাইই বলে। বিষয়টি প্রকাশ্য হোল এই কারনে যখন আগাম মূল্য নেয়া ভারতের টিকা উৎপাদন কারী প্রতিষ্ঠানটি অর্ধেক পথে টিকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এবং আমাদের চলমান করোনার টিকা দেয়া কর্মসূচী বন্ধ হয়ে গেছে।
করোনার টিকা নিয়ে আমরা আম জনতা কতটুকুই বা জানি। সাধারন মানুষ তো আর পদ্ধতির ভিতরে কি ঘটে তা জানতে পারে না। এটা রাজনীতির পাশা খেলা। কে চাল দিচ্ছে, কে কার গুটি গিলে ফেলছে সে খবর সাধারন মানুষের জানার কথাও নয়। সেক্ষেত্রে কলম ধরা এই অধমের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। তবে আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় সব কিছু খুল্লুম খুল্লাহ। কোন বিষয় বা গতিধারা আজকাল চাপা রাখা যায় না। একেবারে জলজ্যান্ত জীবন্ত ভিডিও কিংবা অডিও নিয়ে এখনকার সময়ে এসব বিষয়ের গতিবিধি নিয়ে চালাচালি হয়ে থাকে। ঝড় উঠে। ঝড় থেমেও যায় একসময়। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রে এর দাগ যে পড়েনা তা কিন্তু বলা যায় না। গত বছর শেষের দিকে যখন এই টিকা বা ইনজেকশন নিয়ে কথা উঠলো তখন গ্লোব বায়োটেক নামের এক প্রতিষ্ঠান তাদের উদ্ভাবিত করোনার টিকা “বঙ্গভ্যাক্স” নিয়ে খবরের হেডলাইন হোল। কিংবা তারও আগে করোনা টেষ্টিং নিয়ে যখন টেষ্টিং কিটের আকাল পড়লো তখন গণস্বাস্থ্যের ডঃ বিজন কুমার শীলের উদ্ভাবিত টেষ্টিং কিটের কথা সামনে আসলো। তখন সেটা নিয়েও সরকারী আমলাতান্ত্রিক টালবাহানা বা সরকারের গড়িমসির ব্যাপারগুলোও জন সম্মুখে এসেছিল। গণস্বাস্থ্যের বড় বাবু ডঃ জাফরুল্লাহ যখন এর সত্যতা নিশ্চিত করলেন তখন চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেল। অথচ বাংলাদেশে আবিস্কৃত সেই করোনা টেষ্টিং কিট “র্যাপিড ডট ব্লট” ডঃ বিজনের নামে পেটেন্ট করিয়ে নিয়ে চিন তার দেশে তা প্রচলন করলো। আমরা এও দেখলাম ডঃ বিজন মনের কষ্ট নিয়ে দেশত্যাগ করলেন। কেন দেশত্যাগ? কারন উনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক। উনার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় আর বর্ধিত ভিসা দেয়া হয়নি বলে মনকষ্ট নিয়ে উনাকে চলে যেতে হোল।
আসি করোনার টীকার বিষয়ে। গ্লোব বায়োটেক গবেষনা প্রতিষ্ঠানটি যখন তাদের গবেষনার ফসল হিসাবে করোনার ভ্যক্সিন “বঙ্গভ্যাক্স” উদ্ভাবন ক'রে প্রকাশ্যে এলো তখন আমাদের মিডিয়া জগতে ঝড় উঠলো। কিন্তু উপরের এই দুই দেশীয় প্রয়াস কোন এক অজ্ঞাত কারনে স্তিমিত হয়ে গেল। জনগন সেসব কারন জানতে না পারলেও অনুমান কিন্তু ঠিকই করতে পারে। সেক্ষেত্রে সারা বিশ্বে যখন এই ভাইরাসের টিকা নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয় তখন এস্ট্রোজেনিকার কোভি শিল্ড প্রচারে আসে। ভারতের সিরাম ইন্ডাস্ট্রীজ সেই কোভি শিল্ড উৎপাদনের লাইসেন্স পায়। আমাদের সরকারী এবং সরকার সমর্থিত মিডিয়াগুলো এ বিষয়ে ফলাও করে প্রচার শুরু করে। এবং ঠিক পরবর্তী মূহূর্তেই আম পাবলিককে জানানো হয় যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা উপহার হিসাবে বিশ লাখ পিস করোনা টিকার ডোজ ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে জুড়ে দেয়া হোল সিরামের এই টিকা পৃথিবী বিখ্যাত এবং প্রমানিত। বাংলাদেশের এক কোম্পানীর মাধ্যমে এই ভ্যাক্সিন বাংলাদেশে সরবরাহ করা হবে। স্বভাবতই নিজের ব্যবসায়িক কারিশমা ও সরকার সংশ্লিষ্টতার বদৌলতে বেক্সিমকো ফার্মা এই ব্যবসাটা নিজের করে সাজিয়ে নিল। অর্থাৎ একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে বেক্সিমকো এই টিকা ভারত থেকে কিনে আনবে এবং তা বাংলাদেশ সরকারকে সরবরাহ করবে। জানিনা সরকারের বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় কিংবা অধিদপ্তরের এই একতরফা ব্যবসার ফাঁদে কি শুভঙ্করের ফাঁক রয়েছে। তাছাড়া রাজনীতির অতি ভাজাভাজিতে পোড় খাওয়া বাঙালী এটা নিয়ে ভাববার অবসর সে সময় পেয়েছিল কিনা তাও জানা নেই! কারন করোনার অতি আতংকে “চাচা আপন জান বাঁচা”র সময়ে সবাই “না ঘরকা না ঘাটকা”র অবস্থানে টিকে থাকার মন্ত্র পড়ায় তখন মোটামুটি ব্যস্তই বলা চলে। তবে কথা যে উঠেনি তা কিন্তু নয়। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে এক বাঙালী সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিনের মাধ্যমে তার বর্তমান অবস্থানের ডয়েচ ভেলের এক ভার্চুয়াল টক'শোতে এব্যাপারে বেক্সিমকোর কর্ণধার সালমান এফ রহমানকে নাস্তানাবুদ হতে দেখলাম। সেই অনুষ্ঠানে বেক্সিমকোর কর্ণধার খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবেই এই করোনা টিকা পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন।
তারপরে তো আমরা দেখলাম বিশেষ বিমানে ভারতের প্রধান মন্ত্রীর শুভেচ্ছা উপহারের বিশ লাখ পিস এস্ট্রোজেনিকার কোভি শিল্ড এলো। এবং বাঙালী তা বন্ধুত্বের গদগদ আচরনে সরকারী প্রচার যন্ত্রের সরাসরি সম্প্রচারে দেখেও নিল। তবে ওই উড়োজাহাজে আসা করোনার টিকা গ্রহনের সময় বধুত্বের অতি উৎসাহী কর্মীবাহিনী জয় শ্রীরাম বা হরে হরে করে তাদের সেই শুভেচ্ছার উপহার গ্রহন করেছিল কিনা তা আমাদের জানা নেই। পরবর্তীতে আবারো সেই টিকার চালান ভারত থেকে এসেছে। তবে কোনটা কি এলো এবং কিভাবে বা কোন শর্তে এলো তার ঠিকুজি কর্তা ব্যক্তিরাই বলতে পারবেন। কারন পাপন সাহেব যখন বলেন দেড় কোটি ডোজের কথা তখন আমরা ধরে নেব এক কোটি সত্তর লাখ ডোজ আমাদের ঘরে আসবে। কিন্তু কোথায় কি শুভংকরের ফাঁক রয়েছে তাতো আমাদের জানা নেই। ওদিকে ভারতীয় মিডিয়া তাদের বর্তমানের করোনা হাহাকারের দংশনে যেভাবে তাদের দান খয়রাতের কথা ফলাও করে প্রচার করছে এবং পার্শ্ববর্তী বাংলার নির্বাচনী জনসভায় দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রীরা যেভাবে বাংলাদেশকে খয়রাতি রাষ্ট্র প্রমান করতে প্রাণান্ত করছেন তাতে করে আমার দেশ স্বাধীন সার্বভৌমত্বের ন্যুনতম পর্যায়ে আছে কিনা তাতে খটকা লাগে বৈকি??
আজকে ভারত যখন নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চরমতম অসহায়ত্বের পর্যায়ে দিন গুজরান করছে তখন চারিদিক থেকে তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সহায়কের সাহাযার্থে সবাই হাত বাড়াচ্ছে। তাদের অক্সিজেন সরবরাহের স্বল্পতা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার দৈনতায় আজ আমরা চমকে উঠছি। যে ভারতে চিকিৎসা করানোটা বাংলার সিংহ ভাগ মানুষের কাছে অন্ধের যষ্ঠি ছিল সেই ভারতেকে করোনার চপেটাঘাতে কুপোকাত হতে দেখে তারা বিস্মিতই বটে। সুপার পাওয়ার খায়েসের ভারতের রাজধানীতে চিকিৎসার জন্য যেভাবে মানুষজন অসহায়ের মত দোড়াদোড়ি করছে তা দেখে বিশ্ব আজ হতবাক। সেক্ষেত্রে আমরা জনবহুল ছোট্ট এই ভূখন্ডে করোনা চিকিৎসা ও তার সতর্কতা অবলম্বনে যথেষ্ট দক্ষতার প্রমান দিয়েছি। আমরা দক্ষিন এশিয়ার যেকোন দেশ হতে উন্নততর পর্যায়ে মহামারী মোকাবিলায় এগিয়ে ছিলাম এবং আছি। কিন্তু কোন্ বেড়াজালে পড়ে আমরা ভারতের মুখপেক্ষী হয়ে আজ অভিযোগের সুরে আমাদের অসহয়ত্বের প্রমান দিচ্ছি তা নিয়তির খেলা বলেই মনে হচ্ছে। যেখানে ভারতই তাদের জন স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য টালমাটাল অবস্থায় বিরাজ করছে সেক্ষেত্রে আমাদের অন্য প্রতিবেশী চীন বা পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার ভ্যাক্সিনের দিকে বহুমুখী দ্বার কেন আমরা বন্ধ রেখেছিলাম তা বোধগম্যে আসছে না। তবে সুখের ব্যাপার হচ্ছে অবশেষে সরকার তার সম্বিত ফিরে পেয়েছে যে রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বলে কোন কথা নেই। সেই সুত্র ধরেই আমরা এখন চীন ও রাশিয়ার দিকে হাত বাড়ানোর কথা ভাবছি। আর যেখানে আমরাই যৌথ উদ্যোগে আমাদের দেশেই এই ভ্যাকক্সিন তৈরী করতে পারি সেখানে বন্ধু বলে অতি বন্ধু বাৎসল্যের এই হেয়ালীপনার কোন অর্থ আছে কি? যারা নিজেরাই নিজেদের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক হৈ হট্টগোলে দৈননন্দিন জীবন যাপনে তটস্থ সেই বন্ধুত্বের হামবড়া অহমিকায় এক'শা তাদের দিকে তাকিয়ে এভাবে অসহায় হয়ে বসে থাকার সময় এখন নয়।
পিতার কন্যার নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের গতিপথে এখন দুর্দমনীয়। ইতোমধ্যে ভারতের চেয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সূচকের অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে গেছি। সেক্ষেত্রে আমাদেরটা আমাদেরই সামলাতে হবে। এবং আমরা পারবো ইনশা আল্লাহ। সরকারকে শুধু চোখ কান খুলে শত্রু মিত্রের সংজ্ঞা পঠন পাঠনে মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি সরকারের চারপাশে ভক্তিগীতির এজেন্সি নিয়ে সুজন সেজে থাকা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সংজ্ঞা নতুন ভাবে সাজাতে হবে।