জালাল উদ্দিন আহমেদ
সুড়ঙ্গের ফাঁকে আলোক রশ্মি
প্রকাশ: ০৯:২৩ পিএম, ৬ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:১৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
দু'হাজার সাত আটের দিকে একটা কথা বেশ আওয়াজ করে উচ্চারিত হোত। বাংলার বড় বড় বুদ্ধিবৃত্তির মহাশয়েরা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে এসব কথা উচ্চারন করতেন। সে সময়টা ছিল তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের এক সিভিল মিলিটারী অটোক্র্যাসির যাঁতাকল। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক বহু অপকর্ম সেই জবাব দিহিহীন রাষ্ট্রাচারের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক, ছাত্র-জনতা এমনকি অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীরাও তৎসময়ের সরকারী মেক্যানিজমের যাঁতাকলে নিগৃহীত হয়েছেন। একটি অনির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা যে জনজীবনে অভিশাপের ছায়া হয়ে বিচরন করে তার জলজ্যান্ত উদাহারন ছিল সেই মিলিটারী নিয়ন্ত্রিত সিভিল ব্যুরাক্র্যাসির কেয়ার টেকার সরকার। সে সময় টিভি টক'শোতে বুদ্ধিবৃত্তির বিদগ্ধজনেরা আলোচনার ফাঁকে এই কথাটি বেশ সুন্দর ভাবে উচ্চারন করতেন। টক'শো গুলোতে দেশের গনতন্ত্র উত্তরনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে তারা প্রায়শঃ উচ্চারন করতেন, “সুড়ঙ্গের অপর প্রান্ত থেকে আলোর সুক্ষ্ম রেখা এখনো দেখা যায়। ওই আলোর ছটা দিয়েই গনতন্ত্রের বিচ্ছুরন হবে। দেশে গনতন্ত্র তার আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করবে” ইত্যাদি ইত্যাদি সব গাল ভরা কথাবার্তা। রাত জেগে টিভি সেটের সামনে শুয়ে বসে বাঙালী এসব কথাবার্তা দেখতো এবং শুনতো।
এক যুগ আগে বলে যাওয়া সে সব সম্মানিত মানুষগুলো আজকে অনেকেই আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাদের তেজদীপ্ত আকাশ ছোঁয়া বিশুদ্ধ উচ্চারন গুলি এখনো আমাদের মাঝে অনুরনিত হয়। মনে পড়ে সাংবাদিকতার ব্র্যান্ড এম্বাসেডর এবিএম মুসার কথা। কিংবা সাংবাদিক সম্পাদক মাহবুবুল হক, প্রখ্যাত রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ডঃ এমাজুদ্দিন আহমেদ, প্রশাসক ও অর্থনীতিবিদ ডঃ আকবর আলি খান এবং প্রথিতযশা আমলা ডঃ সাদাত হোসেনের কথা। আরো অনেক বড় বড় অধ্যাপক,আইনজ্ঞ ও প্রথিত যশা বুদ্ধিজীবি ছিলেন এবং এখনো আমাদের মাঝে রয়েছেন, যাদের বিশ্লেষাত্মক এবং ক্ষেত্রবিশেষে শ্লেষাত্মক কথাবার্তা আমরা শুনতাম যা রাষ্ট্র বিনির্মানের মোক্ষম সুত্র হয়ে আমাদেরকে শক্ত কোমরে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারতো। কিন্তু তা কি প্রকৃত অর্থে হয়েছে বা হয়! এখনও ওরকম কথাবার্তা আমাদের দেশের টেলিভিশন গুলোতে হয়। তবে তা সীমিত গন্ডির নিয়ন্ত্রিত বাক্যালাপে। অবশ্য ইদানীং কালে মুখচেনা দলীয় বশংবদ লোকেদের ভীড়ে সুস্থ্য চিন্তার ওই বিশুদ্ধ উচ্চারনের তেজদীপ্ত টিভি টক'শো আমরা এখনকার সময়ে দেখতে বা শুনতে পাইনা। কারন একটাই। নিয়ন্ত্রন। এই নিয়ন্ত্রন নামক অক্টোপাশের ঝাপ্টানিতে আজ আমরা বাকরূদ্ধ।
একটা সময় ছিল যখন টিভি চ্যানেল মানেই খবর আর টক'শো। বাংলাদেশ নামক এই ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের ছোট্ট ভূখন্ডে আড়াই ডজনের মত টিভি চ্যানেল। কি দেখাবে, কি তাদের পরিকল্পনা, কোন আঙ্গিকে টিভির মত একটি বাস্তব চিত্রের মিডিয়াতে সাধারন মানুষকে তারা আকৃষ্ট করবে তার সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল কিনা তা তারাই বলতে পারবেন। কারন টেলিভিশন একটি শক্তিশালী গনমাধ্যম। এই মিডিয়ার মাধ্যমে দেশ ও সমাজকে যেমন এগিয়ে নেয়া যায় তেমনি এর উন্নাসিক পথচলায় সমাজ ও রাষ্ট্রের গতি ভিন্ন পথেও প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে মিডিয়ার পত্তন সেই লক্ষ্য নিয়ে ঘটেছে কিনা তা আমার জানা নেই। আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রেই এরকম হয় বলে শুনে আসছি।
মনে পড়ে আশির দশকের সামরিক শাসন কালের সময়ের কথা। সে সময় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়নে সবকিছু চলতো না। ঘনিষ্ঠতা ও আশীর্বাদ পুষ্ট হতে পারলেই সোনার হরিন হাতের মুঠোয় চলে আসতো (এখনও সে রকমটা হয় বলে শুনা যায়)। এরকম একটি পরিবেশে রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর চাকা ঘুরতো তখন। দেশের প্রধান ব্যক্তি কোন এক কৃষি পন্যের প্রদর্শনীর অনুষ্ঠানে বলে বসলেন “দেশের বাজার অর্থনীতি ঠিক রাখতে হলে দেশব্যাপী কোল্ড স্টোরেজ গড়ে তুলতে হবে”। ব্যাশ! শিল্পখাতে এক মহা প্রলয় ঘটে গেল। আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোও তাদের টাকার বাক্স নিয়ে দোকান খুলে দিল। ফলে ব্যাঙের ছাতার মত যেখানে সেখানে কোল্ড স্টোর গড়ে উঠলো। এক সময় দেখা গেল রাজনীতি ও প্রতিপত্তির সুবিধাভোগী এলাকায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোল্ড স্টোর গড়ে উঠার ফলে সেইসব প্রতিষ্ঠান লোকসানী ব্যবসায় হিসাবে মুখ থুবড়ে পড়লো। তো, এরকমটাই ঘটে আমাদের দেশে। সম্ভাব্যতা যাঁচাইয়ের প্রকৃত মানদন্ডে না থেকে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম বা কর্তৃপক্ষকে খুশী করতে গিয়ে সরকারী দন্ডমুন্ডের বড় কর্তারা তাদের অতি পারংগমতার নিকাশি করতে গিয়ে জাতির ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে দেন।
যা হোক, মূল বিষয়ে ফিরে আসি। বুদ্ধিজীবি বলতে আমরা তাদেরকেই বুঝি যারা তাদের বুদ্ধি ও বিদ্যার নির্যাস নিংড়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তাদের সৃষ্টির ঝাপি খুলে দেন। সেটা লিখিত আকারেও হতে পারে কিংবা তার মুখ নিসৃত বাণী দিয়েও তিনি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে যেতে পারেন। একজন বুদ্ধিজীবি তার বিদ্যার ছড়িয়ে দেয়া কথা দিয়ে সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখেন।সেই বুদ্ধিজীবিরা হতে পারেন রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, সাংবাদিক, আইনজীবি, অবসরের সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারী এবং কুটনীতিক। সেই তাঁরা যখন জাতির সামনে টিভি টক'শো গুলিতে দিনের পর দিন তাদের বুদ্ধিবৃত্তির আলো ঝলমলে বাক্যগুলি উচ্চারন করেন তখন এদেশের দন্ডমুন্ডের কর্তারা তা ঘুনাক্ষরেও শুনেন বা দেখেন বলে অন্ততঃ আমার কাছে মনে হয়নি। কারন প্রথিত্ যশা ওই সব বুদ্ধিবৃত্তির মানুষগুলো যখন রাত জেগে দেশ, রাজনীতি ও গনতন্ত্র নিয়ে কথা গুলো বলেন তখন সেসব কথাবার্তা আমার মত দশম ক্লাশ পেরুনো মানুষ ছাড়া আর কেউ দেখে বলে আমার মনে হয় নি। যদি তাই হোত তাহলে দেশের এতসব বরেন্য ব্যক্তিদের কথাগুলো একই সুরে এবং একই ঢংয়ে বিগত বিশ বছর ধরে ভাঙ্গা রবকর্ডের মত একইভাবে বেজেই চলতো না। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা দৃষ্টিকটু ও অপরিপক্কতার ছাপও আমরা দেখতে পাই। আগেই বলেছি ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের এই ছোট্ট ভূখন্ডে আড়াই ডজন টেলিভিশন চ্যানেল যাদের খবর ও টক' শো করানো ছাড়া আর কোন মুখ্য ফোকাস আছে কিনা তা দৃশ্যমান নয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে এই কথা বলা মানুষগুলোও অনেক সময় রাজনীতির পক্ষ বিপক্ষের কথা বার্তায় টক'শো গুলোকে একঘেয়েমীতে ভরে তুলেন। এই অনুষ্ঠানটি ইদানীং কালে কেমন যেন রাজনীতির পক্ষ বিপক্ষের ফোক্যাল পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে একঘেয়ামীর কাঠগড়ায় এখন এই মিডিয়াটি মানুষের মন থেকে সরে যাচ্ছে। তবুও বুদ্ধিজীবিদের বুদ্ধিদীপ্ত সেই সুড়ঙ্গের ছিদ্রটির দিকে সাধারন বাঙালী এখনো চাতক পাখির মত চেয়ে আছে।
রাজনীতির মূল ফোকাসে আমরা যতই গনতন্ত্রের কথা বলি কিন্তু আমাদের বিগত পঞ্চাশ বছরে বাঙালীর ঘটে কি জমেছে তা কি আমরা স্বচ্ছ্ব আয়নায় ফেলে বিশ্লেষন করেছি কখনো? যতই পরিবার তন্ত্রের কথা বলুন, ব্যবসায়ী মহাজনী রাজনীতির কথা বলুন কিংবা দাদাগিরি মাসলম্যান উঠতি ছেলে ছোকড়াদের কথা বলুন – সেই রাহুর করতলে বন্দি থেকে প্রতি নিয়ত তাদের চপেটাঘাত খেয়েই তো আমাদের বিগত পঞ্চাশ বছরের রোজ-নামচা। এই বৃত্তের মধ্যেই তো আমাদের রাজনীতি ও গনতন্ত্র। পক্ষ বদলায় কিন্তু পরিবার বদলায় না। যদিওবা মহান মুক্তি যুদ্ধের কৃতজ্ঞতায় পিতা ও ঘোষনা পাঠের পরিবারকে সম্মানিত স্থানে বাঙালী জায়গা দিতে চায় কিন্তু হালের চলমান পারিবারিক পরম্পরার যে স্রোত চালু হয়েছে তাতে করে এমন একটা সময় আসবে যখন সারা দেশে সব মিলিয়ে পনের বিশটা পরিবারের জমিদারীতে এই বাংলার রাজ চলমান হবে বলে বিদগ্ধজনেরা ভবিষ্যত বাণী করে থাকেন। সুতরাং রাজনীতির চলমান আদল, বর্তমান আদলের গনতান্ত্রিক অনুশীলন এবং দেশকে সম্মানিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করার একপক্ষীয় আস্ফালনে হয়তো সাময়িক তৃপ্তির ঢেকুর আসবে কিন্তু জন সম্পৃক্ততার দীর্ঘমেয়াদী তৃপ্তিতে তা কখনোই জাতিকে সমৃদ্ধ করতে পারবে না বলেই অভিমত পাওয়া যায়।
আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে পা দিয়েছি। গুটি গুটি এগিয়েও যাচ্ছি বলে বাতাস কানাকানি করে। কিন্তু আমরা তো সোস্যালিজম বা কমিউনিজমের ধারনার প্রফাইলে আমাদের সমাজকে বিনির্মান করিনি। ফলে আমরা চীন বা রাশিয়াও হতে পারবো না কিংবা নিদেনপক্ষে ভিয়েতনামী প্রফাইলেও যেতে আমাদের অসুবিধা হবে। কারন যে ডানপন্থি রাজনীতির আদলে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠিত হয়েছে তাতে গনতান্ত্রিক ন্যুনতম আচার আচরনের বাতাবরন এখনো এদেশে প্রতিষ্টা পায় নি। ফলে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে পুর্বসুরীদের অর্জনকে মূল্যায়নে না রেখে ক্ষমতার বর্তমান পক্ষ দৌর্দন্ড প্রতাপে নতুন আঙ্গিকে দেশ শাসনে ব্রতী হন। সময়ের চাহিদায় ভাল ভাল প্রকল্পও বিপক্ষীয় অবহেলায় মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে করে জনগনের ট্যাক্সের টাকার অপচয় ও অবচয়ের সার্কাস বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলার এই স্বাধীন ভূখন্ডে বার বার পুনরাবৃত্তি হয়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক আচার আচরনে গনতান্ত্রিক মুল্যবোধের বাতাবরন তৈরী না হওয়া পর্যন্ত দেশের উন্নয়নের স্থায়িত্ব মজবুত বা টেকসই হয়না বলে বিজ্ঞজনের অভিমত দিয়ে থাকেন।
এমতাবস্থায় গনতান্ত্রিক শাসন কাঠামোয় রাজনৈতিক আচার আচরনে সংযম, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ন্যুনতম বাতাবরন তৈরী করে পক্ষ বিপক্ষের সবাইকে আস্থায় রেখে দেশ বিনির্মানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। দেশকে উন্নয়নের শক্ত সিঁড়িতে দাঁড় করাতে হলে সামাজিক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় যুথবদ্ধতায় মুষ্টিবদ্ধ একাগ্রতা নিয়ে সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে। বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে হলে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে সামনে রেখে পূর্ব পুরুষদের জনকল্যানমুখী কর্মযজ্ঞের মূল্যায়নে সামঞ্জস্যতা রেখে এগোতে হবে।