avertisements 2

সাড়ে ৩ হাজার সাইট বন্ধের পরও থেমে নেই

আইপিএলের প্রতি ম্যাচ ঘিরে বাংলাদেশে চলে কোটি টাকার জুয়া!

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ মে,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৫:২৩ পিএম, ২৭ জুলাই,শনিবার,২০২৪

Text

ক্রিকেট মানেই রমরমা বাণিজ্য মাঠে খেলে দুই দল। তৃতীয় পক্ষ খেলে মাঠের বাইরে। আইপিএল (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ) খেলা হয় ভারতে। বাজিতে কোটি কোটি টাকা উড়ে বাংলাদেশে। ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের গায়ে জুয়ার কলঙ্ক লেগেছে অনেক আগেই। ম্যাচ গড়াপেটা কিংবা স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে ক্যারিয়ার বরবাদ হয়েছে অনেক খেলোয়াড়ের। তবে আড়ালের সর্বগ্রাসী সেই বাণিজ্য কেবল খেলোয়াড় বা কর্মকর্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাতে জড়িয়েছে দর্শকরাও। তার জ্বরে এখন পুড়ছে বাংলাদেশের দর্শকরাও। যে টুর্নামেন্ট ঘিরে জুয়ার এই উন্মাদনা চলছে, তার নাম আইপিএল (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ)। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ভারতীয় এই আসর ঘিরে জুয়াড়িদের মাধ্যমে হাতবদল হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। মহল্লার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ক্লাব কিংবা অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও প্রকাশ্যেই চলে এই জুয়া। আর তার ফাঁদে পড়ে রাতারাতি নিঃস্ব হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। জুয়ার টাকা নিয়ে বিরোধের জের ধরে হামলা, সংঘর্ষ এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।   

গত মঙ্গলবার রাতের ঘটনা। রাজধানীর খিলক্ষেতের আমতলা এলাকার একটি চায়ের দোকানের টেলিভিশনে আইপিএলের খেলা চলছিল। দিল্লি ডেয়ারডেভিলস বনাম সানরাইজার্স হায়দরাবাদের ম্যাচ। বলে বলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছিল দোকান ঘিরে বসে থাকা দর্শকদের মধ্যে। কারণ একের পর এক বাজি চলছিল। খেলা চলা অবস্থায়ই একজন বলে উঠল, ‘এই বলে ওয়ার্নারের চার হবে। ২০ টাকা। কে আছে?’ আরেকজন বলল, ‘চার হবে না। ঠিক আছে ২০।’ আরেকজন বলল, ‘ওয়ার্নার আউট। ৫০ টাকা, কেউ আছে? ঠিক আছে দুজনের লগেই...।’ বোলার জহির খানের পরবর্তী বলে এক রান হলো। সঙ্গে সঙ্গে বাজি ধরা দুই ব্যক্তি বিজয়ীদের পাওনা টাকা দিয়ে দিল। পুরো ম্যাচেই চলল এমন বাজি।

শুধু আইপিএল নয়, বিশ্বকাপ ক্রিকেট, ফুটবল, জাতীয় লীগ, ইউরোপ নেশন্স কাপ-উয়েফা, স্পেনিশ লিগ, কোপা আমেরিকা, বিপিএল—এসব টুর্নামেন্টে বিনোদনের চেয়ে এখন জুয়া খেলায় মত্ত থাকেন বাজিকররা। অনলাইনে বাজি ধরে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই, হারিয়েছেন সর্বস্ব।


দিনদিন জুয়াড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সারা দেশের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষ অনলাইনে বাজিতে বুঁদ হয়ে থাকে। আইপিএল ম্যাচ চলাকালীন সবচেয়ে বেশি জুয়া চলে। ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাজি ধরে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তো রয়েছেই, স্কুলের নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও অনলাইনে বাজি ধরতে বেশ পটু।

এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে আমাদের কাছে প্রায়ই তালিকা আসে। সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু জড়িতদের একটা সাইট বন্ধ করে দিলে, তারা একাধিক সাইট খুলে ফেলে। এই অনলাইন জুয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। সামনে যেসব সাইটগুলোর খবর জানতে পারব, সেসব সাইটও বন্ধ করে দেব। অনেক সময় ফেসবুকেও জুয়া খেলা হয়। আমরা এসব অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক ঐসব সাইট বন্ধ করে দেয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার গত কয়েক বছরে ৩ হাজার ৫০০টিরও বেশি জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে। সিআইডি, ডিবি ও র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছে জুয়ার সাইট পরিচালনাকারী শতাধিক ব্যক্তি। তবে প্রতিটি সাইট বন্ধ করার পরপর এই চক্র ভিপিএন (ভয়েস ওভার প্রটোকল নেটওয়ার্ক) দিয়ে সাইটগুলো আবার সচল করে। 

রাজধানীর পুরান ঢাকার বংশাল, ইসলামপুর, লালবাগ, চকবাজার, লক্ষ্মীবাজার, গেন্ডারিয়া, নারিন্দাসহ বেশির ভাগ এলাকার নিম্ন শ্রেণির পেশাজীবীর মধ্যে আইপিএলকে কেন্দ্র করে রাতের বেশির ভাগ সময় অনলাইনে বুঁদ হয়ে থাকে। সদরঘাটের ফুটপাতের একজন চা দোকানি অনলাইনে জুয়া খেলেন। গত সপ্তাহে আইপিএলের একটি খেলার বাজি ধরার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ঐদিন এক খেলায় দেখলেন বিরাট কোহলি ওভারের শেষ বলে ছক্কা মারতে পারেন। বাজি ধরলাম ১ হাজার টাকা। কিন্তু ওভারের শেষ বলে ছক্কা না হওয়ার কারণে বাজিতে হেরে গেলাম। যদি ছক্কা মারতেন, তাহলে আমি ১০ হাজার টাকা পেতাম। কিন্তু হলো না।


এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তো ১ হাজার টাকার বাজি ধরি। মাঝে মধ্যে লাভ হয়। আবার লসও আছে। লস যখন হয়, তখন আরেক জনের কাছে ধার করে টাকা খাটাই।’

ওয়ান এক্স বেট, বেট থ্রি-সিক্সটি-ফাইভ, মোস্ট বেট বিডি, ৯ উইকেটসসহ প্রায় ১০০ সাইটে আইপিএলের জুয়া চলছে। অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর অনেকগুলোতে এমনিতেই যে কেউ ঢুকতে পারে। আবার কোনো বেটিং সাইটগুলোতে নিবন্ধন করে ঢুকতে হয়। নিবন্ধন করতে আবার দ্বিগুণ টাকা দিতে হয়। আবার কোনো কোনো সাইটগুলোতে ডলার দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। আবার যে দেশগুলোর সাইট নিজস্ব তাদের টাকা দিয়ে কয়েন ক্রয় করে সাইটগুলোতে প্রবেশ করতে হয়। আর এর লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেট বা ভিসা, মাস্টারকার্ডে। তবে এই মাধ্যমে লেনদেনে জড়িত থাকে স্থানীয় এজেন্টরা। বেটিং সাইটগুলোতে বিট কয়েনের মাধ্যমে কেউ কেউ অংশ নিচ্ছে। জুয়ার পর ঐসব অর্থ ক্রেডিট কার্ড, ই-ব্যাংকিংয় ও হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। জুয়া বাবদ দিনে কী পরিমাণ টাকা মানি লন্ডারিং হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে।

অনেকে জুয়ার টাকা জোগাতে চুরি, ছিনতাইসহ জড়াচ্ছেন বিভিন্ন অপরাধে। জুয়ায় সব খুইয়ে নিজেকে বা স্বজনকে হত্যার খবরও মাঝেমধ্যেই শোনা যায়। দুই বছর আগে খোদ রাজধানীতেই জুয়ায় সর্বস্বান্ত বিটিসিএল কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন আহমেদ লিটন তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে হত্যা করেন বলে বেরিয়ে আসে তদন্তে। ২০২০ সালে রাজশাহীর ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুল ইসলাম ফয়সালকে ব্যাংকের ভল্ট থেকে ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা সরানোর দায়ে পুলিশ গ্রেফতার করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ফয়সাল জানান, পুরো টাকা দিয়ে তিনি অনলাইনে ’নেট থ্রি সিক্সটি ফাইভ’ জুয়া খেলে হারিয়েছেন। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাইদুল ইসলাম নামে এক যুবক আত্মহত্যা করেন। পরে জানা যায়, তিনি এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। অনলাইনে জুয়া খেলে ঋণের পুরো টাকাটাই খোয়ান তিনি। এ নিয়ে পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। এর জেরে কীটনাশক পানে করেন আত্মহত্যা।


 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2