রমজান : ব্যবসায় ও ব্যবসায়ী
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ মার্চ,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:২১ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নির্দিষ্ট কোনো বিষয়কে সামনে রেখে ব্যবসায়ে রমরমা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কোথাও ধর্মীয় বিষয়- যেমন মুসলমানদের রোজা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা, কোথাও নতুন বছর, কোথাও অন্য কোনো বিষয়ে। খ্রিষ্টানদের বড়দিন, ভালোবাসা দিবস প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যের জোয়ার উত্তুঙ্গে ওঠে। মুসলমানদের রমজান, দুই ঈদ, সনাতন ধর্মীয়দের দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মহামতি বুদ্ধের জন্মতিথিকে কেন্দ্র করে কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে দেখা যায় ব্যবসার আরেক রমরমা অবস্থা। ব্যবসায়ীরাও থাকেন এই সুযোগের অপেক্ষায়। সারা বছরের বিকিকিনি এই কয়েকটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই জমে ওঠে। ভরে ওঠে ব্যবসায়ীদের লাভের তহবিল।
ব্যতিক্রম ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে। ইসলামে ব্যবসায়কে শুধু জীবিকা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, এটি একটি আমানত, যা ব্যবসায়ীদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। এটি এমন একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রম, যা মানব কল্যাণবোধের ধারণায় উজ্জীবিত, স্বীকৃত ও পরিগণিত। মানব সত্তাকে রক্ষা, সমাজের কল্যাণবোধ এখানে ব্যবসার মূলনীতি। শুধুই লাভের অংশকে স্ফীত করাকে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। লাভের জন্য মজুদদারি, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ, মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর দ্রব্যাদির ব্যবসায় ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামে ব্যবসায় শুধুই লাভালাভের বিষয় নয়; এটি একটি ইবাদতও বটে। সামাজিক জীবনে পারস্পরিক নির্ভরতা একটি অবিচ্ছিন্ন ধারা। এই ধারা সমাজকে উন্নতির সোপানে পরিচালনা করে। সুস্থ সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা একটি অপরিহার্য শর্ত। সততা, বিনয়, ভদ্রতা, উঁচু নৈতিক মান ও জবাবদিহিতামূলক মনোভাবসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের ইসলাম মর্যাদার উঁচু আসনে বসিয়েছে। ‘সৎ ব্যবসায়ী শেষ বিচারের দিন সিদ্দিক ও শহীদদের সাথে থাকবে’ নবী সা:-এর এই কথায় ব্যবসায় ও ব্যবসায়ীদের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। অপর ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের নির্দেশনা- ‘তোমরা ওজনে কম দিও না’ এর মাধ্যমে সদাচার ও নৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যবসায় পরিচালনার নীতিমালার গুরুত্ব ফুটে উঠেছে।
আল্লাহ তায়ালা ব্যবসায়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। অপর দিকে, রাসূল সা:-এর বক্তব্য ‘সর্বোত্তম উপার্জন হচ্ছে নিষ্ঠাপূর্ণ বেচাকেনা’। একই সাথে মজুদদারির ব্যাপারে রয়েছে কঠোর সতর্কবাণী- ‘যে মূল্যবৃদ্ধির জন্য ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, সে আল্লাহর হিফাজত থেকে বেরিয়ে যাবে।’ ‘সৎ ব্যবসায়ী রিজিকপ্রাপ্ত হয়, পণ্য মজুদকারী হয় অভিশপ্ত’ এবং ‘যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেবে সে আমার উম্মত নয়’ প্রভৃতি সতর্কবাণীর মাধ্যমে ব্যবসায়ে মজুদদারি, ভেজাল, ক্রেতাকে প্রতারিত করার বিরুদ্ধে নবী সা: সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ- ‘তোমরা ওজনে কম করো না’-এর মাধ্যমে ব্যবসায়ের মৌলিক নীতিমালা প্রতিভাত হয়েছে। ভোক্তা অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা যা ভোক্তাকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করেছে; অনুৎসাহিত করেছে এ ধরনের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকে। ইসলামের ব্যবসায়িক নীতিমালায় সর্বত্রই অর্থনীতিকে গতিশীল, সৃষ্টিধর্মী ও কল্যাণমুখী করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সামনে রমজান। রমজানকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য আর ভোক্তাপর্যায়ে ভীতি তৈরি হয়েছে। রমজানের আগেই দ্রব্যমূল্য পাগলা ঘোড়ার মতো উপরের দিকে উঠছে। রমজানে না জানি কী হয় এমন ধরনের একটি চাপা আতঙ্ক ভোক্তাপর্যায়ে। এর অবসান হওয়া দরকার। স্বস্তির সাথে রোজাদাররা যেন রোজা রাখতে পারেন, এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের রয়েছে কল্যাণমুখী অবস্থান। ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার, নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য বিপণনের বিরুদ্ধে তারা নিতে পারেন সাহসী ভূমিকা। মজুদদারির ব্যাপারে তারা কঠোর হলে দ্রব্যমূল্য অনেকটাই সহনীয় থাকে। ব্যবসায়ীরা এ মাসে নিজেদের পরকালীন কল্যাণে অভিষিক্ত করতে পারেন অতিরিক্ত মুনাফার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে। একই সাথে ভোক্তারাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তারা সারা মাসের বাজার একসাথে না করে অল্প অল্প করে প্রয়োজনীয় বাজার করলে পণ্যের সরবরাহে চাপ পড়ে না। দ্রব্যমূল্য স্থির থাকে। বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, খাদ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোক্তা অধিকার পরিষদের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স এ ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ইলেকট্র্রনিক ও প্রিন্ট বিভিন্ন মিডিয়া ব্যবসায়ীগণ ও ভোক্তাদের সচেতন করার ক্ষেত্রে পালন করতে পারে অনন্য ভূমিকা যা শুধু রমজানে সীমিত না হয়ে সারা বছর তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করতে পারে। রমজান মাস শুধু সংযমেরই মাস নয়; আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভেরও মাস। এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করলে রমজান সত্যিকারভাবেই হয়ে উঠবে কল্যাণের, মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাসে।