সব সরষেতেই ভূত!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:২৭ এএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বাঙালি যখনই এগিয়ে যেতে থাকে, তখনই ষড়যন্ত্র শুরু হয়।
দেশের একটি শ্রেণি সেই অতীতকাল থেকেই পরাধীন হয়ে থাকতে চায়। এদেশেই একটি শ্রেণি আছে যারা আত্মমর্যাদা নিয়ে চলতে জানে না। তারা আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিয়েই টিকে থাকতে চায়। তারা পরাধীন হয়ে থাকতে পছন্দ করে।
এদেশের গৌরব-সমৃদ্ধি-উন্নয়ন তারা চোখে দেখে না। আমার অবাক লাগে তাদের চিন্তাধারা দেখে।’ বঙ্গবন্ধুর লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলতেন, বাংলাদেশের মাটি উর্বর, এখানে ফসলের সঙ্গে পরগাছাও জন্মায়।
তাই এগুলো নিয়ে চিন্তা করি না। সমাজে আগাছা থাকবেই। তাদের কী করে সরাতে হবে, তা বাঙালিকেই ভাবতে হবে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অসাধারণ সত্যবাদিতার পরিচায়ক উল্লিখিত বক্তব্যের আলোকে দেশের প্রত্যেক নাগরিক ঘৃণ্য দুর্বৃত্তায়নে জড়িত খুনি-বর্ণচোরাদের মুখোশ উন্মোচন ও এদের বিরুদ্ধে যথার্থ বিচার কার্যক্রম দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুরু ও সম্পন্ন করার প্রত্যাশা করছে।
জনশ্রুতিমতে, পরাজিত অপশক্তি দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে কঠিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। দেশে অরাজক-অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে অন্ধকারের অশুভ শক্তিরা দেশকে জঙ্গিবাদে এবং অনগ্রসরতায় নিপতিত করতে তৎপর রয়েছে। বিভিন্ন ছদ্মবেশে-ছলচাতুরীর অপকৌশলে হিংস্র নাগ-নাগিনীর কদর্য পদচারণা সর্বত্রই দৃশ্যমান। তাদের বেপরোয়া আচরণ, দুর্নীতি-জোচ্চুরি-স্বজনপ্রীতি, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ-উপার্জন ও পাচার, দেশবিধ্বংসী কর্মকাণ্ড রোধ করার কোনো প্রয়াসই কার্যকর হচ্ছে বলে মনে হয় না। অনৈতিক-অবাঞ্ছিত পন্থায় গুটিকয়েক ব্যক্তি মুখোশ পালটে লবিং-তদবির বাণিজ্যের আড়ালে পদ-পদবি-পদক দখলে নিয়ে কথিত হাইব্রিড-অনুপ্রবেশকারীদের অসংলগ্ন-অসংযত কূটকর্মের উৎসশক্তি-পৃষ্ঠপোষক হিসাবে কাজ করছে বলে জনমত রয়েছে।
‘ম্যানেজ’ অপসংস্কৃতি পরিচর্যায় পারদর্শী-পারঙ্গম এই জঘণ্য প্রকৃতির অনুঘটকদের কোনো অপকর্মই নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার ন্যূনতম আলামতও পাওয়া যাচ্ছে না। বিপরীতে এসব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্যে কথিত সংস্থাগুলোর অবৈধ লেনদেন-যোগসাজশে সৎ-যোগ্য ব্যক্তিদের নানাভাবে হয়রানি, ফাঁসিয়ে দেওয়ার উদাহরণও কম নয়। ন্যূনতম বিরুদ্ধাচরণ বা তাদের বিপক্ষে যায় এমনসব মন্তব্য, লেখালেখি, মতপ্রকাশে সাহসী ব্যক্তিদের অহেতুক হয়রানি-নির্যাতন-নিপীড়নের ব্যবস্থাও তাদের কুক্ষিগত।
দেশব্যাপী প্রতারণা-জালিয়াতি-মিথ্যাচার ও অবৈধ অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষা খাতসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ সংস্থাগুলো স্বল্পসংখ্যক নষ্টদের দখলের প্রভাব বলয়ে প্রায় বশীভূত। নিজ নিজ অঞ্চল-প্রতিষ্ঠানে চিহ্নিত এসব ঘৃণ্য অপরাধীর হীন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দেশের সচেতন মহল সম্যক অবগত। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন দেশ-জনগণকে বিশ্বপরিমণ্ডলে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করেছে। শুধু হাতেগোনা কিছু সিন্ডিকেট সদস্য কর্তৃক রাষ্ট্রের সমুদয় সম্পদ করায়ত্তের মাধ্যমে দেশ ও জনগণকে জিম্মি করার অপচেষ্টা সর্বত্রই পরিলক্ষিত। এই দুর্বৃত্তদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা অত্যন্ত কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। দেশে-বিদেশে এসব দুর্বৃত্তের অপকর্মের শেকড় এত বেশি গভীরে প্রোথিত যে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণও দুরূহ হয়ে পড়েছে।
দেশে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতির পেছনে অসৎ রাজনৈতিক চক্রান্ত সক্রিয়। তারা জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ঘোলাজলে মাছ শিকারের দুরভিসন্ধি করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি-এসব অজুহাতে কালোবাজারি-মজুতদারদের সিন্ডিকেট কূটকৌশল অবলম্বন করছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজনীতি-বাণিজ্য-শিক্ষা-প্রশাসন সর্বত্রই নানামুখী সিন্ডিকেট কারসাজি বিদ্যমান। এসব দুষ্টচক্রের জনবিরোধী কর্মযজ্ঞে দেশবাসীর জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ রূপ পরিগ্রহ করছে। জনগণের ক্ষোভ-অসন্তোষ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাস শুরুর দীর্ঘ সময় আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের, বিশেষ করে রমজান মাসে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়-সরবরাহ-বিতরণ অবাধ ও সহনীয় রাখতে সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ সত্ত্বেও এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সৃষ্টির উৎসগুলোকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হলেও মুনাফালোভী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় রয়েছে। এদের যে কোনো মূল্যে নির্মূল করা অত্যন্ত জরুরি।
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঘুস-দুর্নীতি-অর্থ আত্মসাৎ-লুটপাট-জালিয়াতির ক্রমবর্ধমান সংবাদে দেশের জনগণ অতিশয় উদ্বিগ্ন-শঙ্কিত। প্রায় প্রতিদিনই নানাক্ষেত্রে উল্লেখিত এসব অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। পরিসংখ্যানমতে, এক বছরে ঘুসের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুর্নীতি হ্রাসকরণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রায় দ্বিগুণ, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানা নির্দেশনা প্রদান করা হলেও সেবা খাতের কোথাও দুর্নীতি কমেছে বলে মনে হয় না। সেবা খাতের নানা অনিয়মের অভিযোগের পাশাপাশি জোরপূর্বক ঘুস আদায়ের উদাহরণও রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালে ‘রিস্ক বেনেফিট’ হিসাবে এর মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় বলেও প্রবল জনশ্রুতি আছে। ২০২১ সালে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক দেশের ১৬টি গুরুত্বপূর্ণ খাত নিয়ে পরিচালিত জরিপের তথ্যমতে, দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঘুস না দিলে কোনো সেবা খাতে সেবা মেলে না। সার্বিকভাবে ঘুসের শিকার (ঘুস দিতে বাধ্য) হওয়া খানার হার ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে, দেশে উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছে, তার সাফল্য অনেকাংশেই ম্লান করে দিচ্ছে প্রশাসনের অত্যন্ত সীমিতসংখ্যক দুষ্টচক্রের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। প্রশাসনের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না। পত্রপত্রিকায় প্রতিনিয়ত এসব খবর আসছে। ঘুস ছাড়া কোনো ফাইল না নড়ার বিষয়টি সবার গোচরীভূত। সম্প্রতি ঘুসের টাকা না পেয়ে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। টিআইবির প্রতিবেদনে সেই তথ্যই উঠে এসেছে। দুর্নীতি রোধে বিচার বিভাগ, দুদক এবং অন্যান্য দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার অব্যাহত প্রচেষ্টা কিছুটা সুফল দিলেও তা অতি অপ্রতুল বলেই মনে করছেন তারা। ১৭ জানুয়ারি গণমাধ্যম সূত্রে দেশের চলমান বিদ্যুৎ খাত ডিজিটালাইজেশনে স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার সংযোজনে দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানির (বেসিকো) ভিত্তিহীন বাজেট তৈরি, মালামাল ক্রয়ে সরকারি নিয়ম অমান্য, স্বাক্ষর স্ক্যান করে বোর্ড সভার ভুয়া কার্যবিবরণী তৈরি, ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকি, সার্কুলার ছাড়া নিয়োগ, জাল স্বাক্ষরে ব্যাংক থেকে টাকা হস্তান্তর, সর্বোপরি মিটার ক্রয়ের জন্য চুক্তিবহির্ভূত ও মিথ্যা ডিক্লারেশনে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচারসহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানা যায়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের জেলাভিত্তিক গণশুনানিতেও পুলিশি হয়রানি, হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়া, পাসপোর্ট অফিস এবং জেলা প্রশাসনে ঘুস-দুর্নীতি-দালালদের দৌরাত্ম্যে হয়রানি ও বঞ্চনার বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যম সংবাদ মারফত জানা যায়, ফরিদপুরের ২৫টি সরকারি দপ্তরের বিরুদ্ধে ১৪৫টি অভিযোগ উঠেছে দুদক’র এ জেলাভিত্তিক গণশুনানিতে। স্বৈর-সামরিক শাসনামলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া আর্থিক খাতে বৃহৎ দুর্নীতি-লুটপাটের সংবাদ প্রায়ই গণমাধ্যমে পরিবেশিত হতো। দুঃখজনক হলেও সত্য, আর্থিক খাতের দুর্নীতির সঙ্গে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারক-কর্মকর্তাদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডে (আইএলএফএসএল) আর্থিক কেলেঙ্কারির দায় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পাঁচ ডেপুটি গভর্নরসহ ২৪৯ কর্মকর্তার। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে সততা-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে দেশপ্রেমিক, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন এবং সত্য-বস্তুনিষ্ঠ-নিরপেক্ষ বিচার বিশ্লেষণে এই দেশবিধ্বংসী অপরাধীদের চিহ্নিত করে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ধরনের পদক্ষেপ জনগণের ক্ষোভ-উদ্বেগ প্রশমনে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখবে।