একটি বুড়ো শালিকের আত্মকথা!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ মার্চ,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৪১ এএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
মনুষ্যসমাজের মতো আমাদের পাখিমহলেও বুড়োদের কেউ দেখতে পারে না। আমার বংশের নাতি-পুতিরা সময়-সুযোগ পেলে যেমন আমাকে নিয়ে মশকারা করতে ছাড়ে না, তদ্রুপ সুন্দরী যুবতী শ্যালিকারা আমার শরীর ঘেঁষে যখন সমধুর কণ্ঠে গান গাওয়া শুরু করে তখন কেন জানি আমার বৃদ্ধা স্ত্রীর খুব রাগ হয়। তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলতে থাকেন- বুড়োটার কেন মরণ হয় না। এত শ্যালিকা হররোজ মরছে আর বুড়োটা কেবলই দিন দিন জওয়ান হয়ে উঠছে। স্ত্রীর মতো আমার সন্তান-সন্ততিরাও মাঝে মধ্যে আমার ওপর বিরক্ত হয়। বিশেষ করে আমি যখন তাদেরকে আমার অভিজ্ঞতা-সফলতার কাহিনী বলি এবং মাঝে মধ্যে বিভিন্ন উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করি তখন তারা গাল ফুলিয়ে এমন একটা ভাব ধরে যা দেখলে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি- স্বজাতিকে আর কিছু বলব না। তার চেয়ে বরং মনুষ্যজাতিকে আমার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করব।
আমার কথা শুনে আপনারা যারা ভাবছেন, একটি বুড়ো শালিকের এমন কী অভিজ্ঞতা রয়েছে যা শুনে আমরা আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করব, তাদের সদয় অবগতির জন্য বলছি- প্লিজ, আমার কথাগুলো শুনুন। আপনাদের প্রতি আমার একটি অধিকার রয়েছে। আমার যৌবনের পুরোটা সময় আমি গান গেয়ে আপনাদের আনন্দ দিয়েছি। মাঝে মধ্যে নেচেছি। গাছের মগডালে বসে আপনাদের বাহারি মস্তক, শরীরের নড়াচড়া ও আজব কর্মকাণ্ড দেখেছি। আপনাদের নৈতিক-অনৈতিক কথাবার্তা শুনেছি। আবার অনাবিল আনন্দ, ক্রীড়া-কৌতুকও দেখেছি। আপনাদের কারো কারো আচরণে আমি লজ্জিত হয়েছি। বিশেষ করে আপনারা যারা পার্কে শরীরচর্চার নাম করে পরস্ত্রী অথবা পরপুরুষের সাথে সন্ধ্যার পর ডলাডলি করেছেন বা করে চলেছেন তাদের প্রতি আমার ক্রোধের সীমা-পরিসীমা নেই। কারণ ওসব কুকর্ম পাখিসমাজে কোনোকালেও ঘটেনি। সুতরাং আপনারা যখন বনবাদাড় কিংবা উদ্যানের পরিবেশ নষ্ট করেন তখন আমাদের ক্ষোভ-ক্রোধ-লজ্জাশরমের মাত্রা অতিক্রম করে। তবুও আমরা ধৈর্যহারা হয়ে আপনাদের শরীরে মলত্যাগ করি না অথবা উঁচু মগডাল থেকে নেমে এসে ঝটিকা আক্রমণে আপনাদের ক্ষত-বিক্ষত করি না।
আজকের আত্মকথা শুরুর আগে আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও বাসস্থান সম্পর্কে কিছু বলে নিই। আপনারা সবাই জানেন, বাংলাদেশে অনেক প্রজাতির শালিক রয়েছে। তবে ভাতশালিক ও গোশালিকের সংখ্যাই বেশি যদিও বাংলার গ্রামগঞ্জে গোশালিককে সবাই গুশালিক বলে। কিন্তু কেন আমার বংশের একটি উপজাতিকে আপনারা গুশালিক বলেন তা বলতে পারব না। তবে আপনাদের সদয় অবগতির জন্য বলছি, কোনো শালিক মরে গেলেও গু খায় না। ভাতশালিক গোশালিক ছাড়াও আরেক অভিজাত শালিক রয়েছে সেগুলোকে বলা হয় চিত্রাশালিক এবং আমি এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত সবচেয়ে বয়স্ক পাখি যার রয়েছে কিংবদন্তির মজার সব অভিজ্ঞতা যা শুনলে আপনার কান একবার শীতল হবে, আবার পরক্ষণে গরম হয়ে যাবে।
আজকের আত্মকথন শুরুর আগে আমার সম্প্রদায় ও বাসস্থান সম্পর্কে কিছু বলে নিই। আমি থাকি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ধানমন্ডি লেকের পাড়ে অবস্থিত মস্ত বড় একটি গাছের মগডালে নির্মিত সুরম্য প্রাসাদে। আমার প্রাসাদ থেকে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হররোজ যেসব কর্মকাণ্ড ঘটে তা যেমন দেখি, তদ্রুপ রবীন্দ্র সরোবরের হৈহুল্লোড়, দাপাদাপি-জড়াজড়ি ও মারামারিও দেখতে পারি। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে অবস্থিত দুটো মসজিদের মুসল্লিদের ইবাদত-বন্দেগি ছাড়াও লেকের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রাতবিরাতে যারা নেশা করে তাদের কর্মকাণ্ডও দেখি। আমার প্রজাতির লাজুক উপজাতি ময়নারা ইতোমধ্যেই রাগ-অভিমান-লজ্জায় লেক এলাকা ছেড়ে পিলখানার বিজিবি সদর দফতরের গাছপালায় আশ্রয় নিয়েছে।
আপনারা হয়তো জানেন, শালিক বড্ড সামাজিক প্রাণী, এরা দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো দলীয় ফোরামে আলোচিত হয়। শালিকেরা মানুষ চিনতে পারে এবং মানুষের কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করতে পারে। মানুষের কথা শুনে তারা মানুষদের আলাদা করে চিহ্নিত করে থাকে। শালিকদের দাম্পত্য সম্পর্কের মতো এত সুন্দর সম্পর্ক প্রকৃতিতে খুব অল্প প্রাণীর মধ্যেই লক্ষ করা যায়। স্বামী-স্ত্রী বেশির ভাগ সময় একত্রে চলাফেরা করে। এই মনুষ্যসমাজে জোড়াশালিক দর্শনকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা যায়। কিন্তু বুড়াকালে শালিকের স্ত্রীরা ঝগড়াঝাঁটি বেশি করে ও নিজেদের দল ভারী করার জন্য আরো অনেক বুড়ো-বুড়ি দলবদ্ধ হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন ঝগড়া শুরু করে যা শালিক সমাজে রীতিমতো নাটক-সিনেমার মতো।
শালিক সমাজ বাদ দিয়ে এবার মনুষ্যসমাজের গল্প বলি। আমার গল্পগুলো বেশি দিনের পুরোনো নয়। আমার বয়স এখন ছয় বছর এবং শালিকদের মধ্যে এত সময় ধরে কেউ বাঁচে না। ভাতশালিক-গোশালিক তিন-চার বছর বাঁচে। আর আমার প্রজাতি অর্থাৎ চিত্রাশালিকেরা বাঁচে পাঁচ বছর। সুতরাং শালিক সমাজে বিশেষ করে ধানমন্ডি লেকের আশপাশে আমার চেয়ে প্রবীণতম কেউ নেই। গত পাঁচ বছরে যা দেখেছি তা ক্ষেত্রবিশেষ কৌত‚হলোদ্দীপক ও হৃদয়বিদারকও বটে। এক দিনের ঘটনা বলি। সেদিন সন্ধ্যার পর দুই চোর এসে আমার প্রাসাদসংলগ্ন একটি বৃক্ষতলে দাঁড়াল। আপনি যদি তাদের পোশাক বেশভ‚ষা দেখেন তবে নির্ঘাত অতি উঁচু মার্গের ধনী ও ভদ্রলোক বলে প্রথমেই ভুল করে বসবেন। চোর দু’টি একটি দামি মার্সিডিজ জিপ থেকে নামল। তাদের ঠোঁটে হাভানা চুরুট, পরনে ডানহিলের স্যুট, পায়ে বেল্লি ব্র্যান্ডের জুতো ও হাতে প্যাটেক ফিলিপের ঘড়ি ছিল।
আমি চোরদেরকে ভদ্রলোক ভেবে আমার প্রাসাদের উঁচুতলা থেকে নেমে এলাম এবং কাছাকাছি একটি ডালের ওপর বসে তাদের দেখতে লাগলাম। তাদের ব্যাপারে আমার উৎসাহ-উদ্দীপনার মূল কারণ ছিল তাদের বেশভ‚ষা। সন্ধ্যার পর ধানমন্ডি লেকের অন্ধকার এলাকায় যারা বসে তাদের বেশির ভাগই দু’নম্বরি থেকে চৌদ্দনম্বরি ধান্ধার লোক হয়। তারা মনুষ্য সমাজের নোংরা কাজগুলো করে আবার মাঝে মধ্যে এত অশ্লীল কর্ম করে যা আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না, তো আমার প্রাসাদ সংলগ্ন অন্ধকার স্থানে যখন দামি গাড়ি থেকে নেমে আসা কেতাদুরস্ত দুই আদম সন্তানকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখলাম তখন তাদের সম্পর্কে আমার আগ্রহ বহুগুণ বেড়ে গেল। আমি গাছের ডালে বসে তাদের কথোপকথন শুনতে পেলাম।
লোক দু’টির কথা শুনে মনে হলো, তারা বিদেশী। তবে তাদের ভাষা বাংলা। নিজ দেশে ও এই দেশে তাদের যোগাযোগ অতি উঁচুপর্যায়ে রয়েছে। তারা ব্যবসায়-বাণিজ্যের দালালি ও মুদ্রা পাচার নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছিল। গত পাঁচ বছরে লোক দু’টি মোট কত টাকার দালালি করেছে এবং কাকে কত টাকা ঘুষ দিয়েছে তা নিয়ে কথা বলছিল। তারা ব্যবসায় হাসিলের জন্য কোনো ব্যক্তিকে দেশ-বিদেশের কোন হোটেলে বলিউড, ঢালিউড, মস্কো-লেবাননের কোন সুন্দরীকে কয়দিনের জন্য কত টাকায় ভাড়া করে এনেছিল তা নিয়ে ফিসফিস করে এমন সব কথা বলল যা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল এবং বুড়ো শরীরে কিছুটা হলেও অস্থিরতা শুরু হলো।
ভদ্রবেশী চোর দুটো মুদ্রাপাচারের রুট সম্পর্কে যে কথা বলল তা শুনে আমি তো রীতিমতো থ বনে গেলাম। নগদ অর্থ ডলার-পাউন্ডে রূপান্তর করে কিভাবে বিমান, সমুদ্রপথ ও স্থলপথে প্রতিবেশী দেশ হয়ে দুবাই যায় এবং এই কাজের সাথে দালাল ফড়িয়া, দুর্নীতিবাজ কর্তারা কিভাবে জড়ায় তা মাঝে মধ্যে অতি লোভের কারণে অপরাধজগতে বিশেষ সীমান্তে যে খুন খারাবি হয় তা তারা অকপটে বলতে থাকল। দেশের কিছু ব্যবসায়ী নামধারী টাউট ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার কিভাবে বস্তাভর্তি নগদ অর্থ কনটেইনারে করে বেগমপাড়ায় পাঠিয়ে দেয় সে কথা যেমন বলল- তেমনি সোনা, হীরা ও সাদাকর চালানের সাথে হুন্ডি ব্যবসার সংযোগ এবং ক্ষমতার স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে নিয়মিত বখরা দেয়ার পরও ক্ষমতাধররা কিভাবে বেঈমানি করে তা শুনে আমি রীতিমতো হতবাক হয়ে পড়লাম।
তাদের কথা শুনে মনে হলো, আজ তাদের মন খারাপ। তারা জনৈক দুরাচারের নামে অনেকগুলো বাড়ি কিনে দিয়েছে বিদেশের মাটিতে যার আর্থিক মূল্য কয়েক শ’ কোটি টাকা। সেই দুরাচার তাদের পাওনা পরিশোধ না করে আরেকটি চোর সিন্ডিকেটের সাথে হাত মিলিয়েছে। এ অবস্থায় আলোচ্য চোরযুগল সেই দুরাচারকে শায়েস্তা করার জন্য আরেক দুরাচারকে কিভাবে ভাড়া করেছে তা শুনে আমি তাদের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলাম না। তারা গভীর রাত পর্যন্ত আমার প্রাসাদের নিম্নাঞ্চলের মাটি-বাতাস অপবিত্র করল এবং নানান অজানা তথ্য নিজেদের অজান্তে আমাকে জানিয়ে গভীর রাতে স্থান ত্যাগ করল।
চোরদের কথাবার্তা শুনে আমার রীতিমতো বমি চলে এলো। ইচ্ছে হলো, লেকের পানিতে গোসল করে তারপর পবিত্র হয়ে আমার প্রাসাদে ঢুকি। কিন্তু ২০২৩ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিনের মধ্যরাতে ধানমন্ডি লেকে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল। তাই গোসল করলে ঠাণ্ডাজ্বর কিংবা নিউমোনিয়া হতে পারে এই ভয়ে অপবিত্র ইন্দ্রিয় নিয়ে আমার পবিত্র প্রাসাদে প্রবেশ করলাম বটে- কিন্তু সারাটা রাত একটুও ঘুমোতে পারলাম না। আমার নির্ঘুম শরীরের অতিরিক্ত নড়াচড়া দেখে বুড়ি বউ ফ্যাচর ফ্যাচর শুরু করল। অন্যদিন হলে হয়তো দু’ঘা বসিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার মনটা এতটা অশান্ত ছিল যে, চোরদের কথার চেয়ে বুড়ির খিস্তিখেউর রীতিমতো অমৃত সুধার মতো মনে হতে থাকল।