পৃথিবীর ভেতরে কিভাবে লুকিয়ে আছে এভারেস্টের চেয়েও ৪ গুণ উঁচু পর্বত
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৬ জুন,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৫১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
পৃথিবীর গভীরে হাজার হাজার কিলোমিটার নিচে-যেখানে এখনো মানুষের পা পড়েনি বা সূর্যের আলো পৌঁছায়নি সেখানে আছে এমন পর্বতমালা যার কিছু শৃঙ্গ এভারেস্টের চাইতেও চারগুণ উঁচু। কিন্তু কেউ জানে না কিভাবে এবং কেনো এগুলো তৈরি হয়েছিল।
অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্মকালের একটি উজ্জ্বল দিন। তাপমাত্রা মাইনাস ৬২ সেলসিয়াস অর্থাৎ শূন্যের ৬২ ডিগ্রি নিচে। সামান্থা হ্যানসেনের চোখের পাতায় বরফ জমে গেছে। তার সামনে বরফের সাদা দেয়াল। কোনখানে যে তা ওপরের দিকে উঠে গেছে, কোথায় যে ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে, কোথায় দিগন্তরেখা আকাশের সাথে মিলেছে তা বোঝা যায় না।
সামনে তাকালে তাই একটা যেন মানসিক বিভ্রম তৈরি হয়।
এর মধ্যেই তুষারের ওপর একটা সুবিধেমতো জায়গা বের করলেন সামান্থা। তারপর হাতে তুলে নিলেন একটা কোদাল।
অ্যান্টার্কটিকার উষর অভ্যন্তরভাগ
হ্যানসেন যেখানে আছেন তা হচ্ছে এই অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের একেবারে ভেতরের একটি উষর অঞ্চল।
যেসব বিলাসবহুল জাহাজ অ্যান্টার্কটিকায় পর্যটকদের বেড়াতে নিয়ে আসে তারা এখানে আসে না। এখানে পরিবেশ একেবারেই নির্মম। এমনকি অ্যান্টার্কটিকায় যেসব স্থানীয় বন্যপ্রাণী বাস করে তারাও এদিকে খুব কমই আসে।
তো সামান্থা এসেছেন কিসের সন্ধানে?
আমেরিকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা ও আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অনুসন্ধানী দলের একজন সামান্থা হ্যানসেন এখানে এসেছেন গোপন কিছু পর্বতমালার সন্ধান খুঁজে বের করতে।
আজ পর্যন্ত এসব পর্বতমালার চূড়ায় কোনো অভিযাত্রীর পা পড়েনি। এমনকি কোনোদিন সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করে ওঠেনি সেসব শৃঙ্গ।
কারণ এসব পর্বত লুকিয়ে আছে পৃথিবীর মাটির নিচে অনেক গভীরে।
পৃথিবীর অভ্যন্তরে কী আছে?
এ গবেষণা শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। অ্যান্টার্কটিকায় এসে একটি গবেষক দল একটি সিসমোলজি স্টেশন (ভূত্বকের কম্পন পরিমাপক যন্ত্র) বসিয়ে গিয়েছিলেন।
এগুলো এমন কিছু যন্ত্র যার অর্ধেকটা বরফের মধ্যে প্রোথিত বাকি অর্ধেকটা বাইরে। আমাদের পৃথিবীর ভেতরে কি আছে তা বের করাটাই ছিল এর লক্ষ্য।
অ্যান্টার্কটিকার নানা স্থানে এমন ১৫টি স্টেশন বসিয়েছিলেন গবেষকদের দলটি।
এই সিসমোলজি স্টেশনের যন্ত্র দিয়ে যে পর্বতের মতো কাঠামোগুলোর কথা জানা গেল তা ছিল খুবই রহস্যময়।
এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে ‘আল্ট্রা লো ভেলোসিটি জোন’ বা ইউএলভি জেড।
কিন্তু হ্যানসেনের দলটি জানতে পারলো যে এই ইউএলভিজেডগুলো সম্ভবত পৃথিবীর সবখানেই আছে। আপনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেনো আপনার পায়ের নিচেই হয়তো আছে এগুলো।
হ্যানসেন বলেন, ‘আমরা প্রায় যেখানেই গিয়েছি সেখানেই ইউএলভিজেড থাকার প্রমাণ পেয়েছি।’
প্রশ্ন হলো এই ইউএলভিজেড জিনিসটা আসলে কী? আর পৃথিবীর গভীর অভ্যন্তরে এরা কী করছে?
রহস্যময় ইতিহাস
পৃথিবীর ভেতরে যে পর্বতগুলো আছে তাদের অবস্থান একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তরে।
আমাদের গ্রহের অভ্যন্তরে একেবারে কেন্দ্রস্থল বা ‘কোর’ হচ্ছে একটি অতি উত্তপ্ত ধাতব স্তর। তার চারপাশে আছে নরম ও শক্ত পাথুরে স্তর বা ম্যান্টল।
এই দুটি স্তরের পার্থক্য এত বেশি যে তাকে হ্যানসেনের দল বর্ণনা করছেন ‘কঠিন শিলা ও বাতাসের মধ্যে বাহ্যিক বা ভৌত পরিবর্তনের চেয়েও বেশি।’
পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক গঠনের এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তা কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীদের বিস্ময়ের কারণ হয়ে আছে।
পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার ভেতরে ‘কোর-ম্যান্টল সীমারেখার’ অবস্থান। কিন্তু যে উপরিভাগে মানুষ বাস করে তার সাথে তার অভ্যন্তর ভাগের অনেক পার্থক্য। অনেক জায়গা এমন যে মনে করা হয় এগুলো বহু আগে সমুদ্রের তলদেশ ছিল, হয়তো তারই কিছু টুকরো সেখানে চাপা পড়ে আছে।
পৃথিবীর অনেক জায়গায় যেমন হাওয়াইতে যে আকস্মিকভাবে আগ্নেয়গিরি তৈরি হয়েছে, তার পেছনে কারণ হয়তো এগুলোই।
‘ডীপ-আর্থ’ পর্বতের কথা কিভাবে জানা গেল?
এগুলো নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। সে সময় বিজ্ঞানীরা মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক নিচে থাকা ‘কোর-ম্যান্টল’ বাউন্ডারি নিয়ে গবেষণা করছিলেন।
এ গবেষণা করা হচ্ছিল সিসমিক ওয়েভ বা ভূমিকম্পের মতো ঘটনার সময় পৃথিবীর ভেতরের স্তরগুলোর ভেতর দিয়ে যে কম্পনের তরঙ্গ বয়ে যায় এবং এতে যে ঝাঁকুনি লাগে তারই বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে।
এগুলো সমন্বয় করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভেতরে কী আছে তার এক্স-রে ছবির মতো একটা চিত্র তৈরি করতে পারলেন।
বিজ্ঞানীরা যখন এমন ২৫টি ভূমিকম্পের চিত্র পরীক্ষা করলেন তারা দেখলেন যে ‘কোর-ম্যান্টল’ বাউন্ডারিতে একটি উঁচু-নিচু অংশে এসে এই কম্পনটির গতি কমে যাচ্ছে যা কেন হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।
এটা একটি পর্বতমালার মতো যার শৃঙ্গগুলো ম্যান্টলের ভেতরে ঢুকে আছে।
এমন কিছু শৃঙ্গের উচ্চতা ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত, তার মানে এগুলোর উচ্চতা এভারেস্টের চাইতেও সাড়ে চারগুণ বেশি। অন্য আরো কিছু শৃঙ্গের উচ্চতা তিন কিলোমিটারের মতো।
এরপর পৃথিবীর ‘কোর’ জুড়ে এমন আরো অনেকগুলো পর্বত চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি পাওয়া গেছে যা অত্যন্ত বিশাল। এটি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঞ্চলের নিচে এবং তা ছড়িয়ে রয়েছে ৯১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে।
এগুলো কিভাবে হলো, বা এগুলো কী দিয়ে তৈরি তা এখনো কেউ জানে না। তাছাড়া এ পর্বতগুলোর কাছাকাছি আরো কিছু গোলাকার পিন্ডের উপস্থিতি দেখা গেছে তবে এগুলো যে ঠিক কী এবং কোথা থেকে এলো, তা রহস্যময়।
কিন্তু এই পর্বত ও পিণ্ড একই জায়গায় উপস্থিত থাকায় তাদের মধ্যে কিছু একটা সম্পর্ক আছে বলেই অনুমান করা হয়।
কেনো এসব পর্বতমালা তৈরি হয়েছে?
সাধারণত পৃথিবীর ম্যান্টলের তাপমাত্রা ৩,৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু কোরের তাপমাত্রা আরো বেশি প্রায় ৫,৫০০ ডিগ্রি সেললিসিয়াস।
এ তাপমাত্রা প্রায় সূর্যের উপরিভাগের কাছাকাছি।
একটা তত্ত্ব হচ্ছে, এসব পর্বতগুলো ম্যান্টলের নিচের দিকের অংশ যা জ্বলন্ত কোরের কাছাকাছি থাকার কারণে অতি উত্তপ্ত হয়ে আংশিকভাবে গলে গেছে এবং সেটাকেই ইউএলভিজেড বলা হচ্ছে।
দ্বিতীয় আরেকটি তত্ত্ব হলো এই ডীপ-আর্থ মাউন্টেনগুলো তৈরি হয়েছে কিছুটা ভিন্ন আরেক ধরনের শিলা দিয়ে যা ম্যান্টলকে ঘিরে আছে।
অনেকে বলেছেন হয়তো এটি কোনো প্রাচীন মহাসাগরের নিচের ভূস্তর বা ক্রাস্টের টুকরো যা কোনো কারণে ম্যান্টলের ভেতরে ডুবে গেছে এবং কোটি কোটি বছর পর এখন তা কোরের ঠিক ওপরে এসে অবস্থান নিয়েছে।
কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের নিচে ডীপ-আর্থ পর্বতমালা পাওয়া যাবার সাথে এ তত্ব মিলছে না, বলছেন হ্যানসেন।
তার মতে, ‘আমরা আমাদের গবেষণা চালিয়েছি দক্ষিণ গোলার্ধে যা ওই সব বড় কাঠামো থেকে অনেক দূরে।’
অতীতে একটা সময় মনে করা হতো যে ডীপ-আর্থ পর্বতগুলো সবখানে নেই, বরং কিছু কিছু জায়গায় ছড়িয়ে আছে মাত্র।
কিন্তু হ্যানসেনের দল অ্যান্টার্কটিকায় যেখানেই নমুনা নিয়েছেন সেখানেই ইউএলভিজেড কাঠামো পেয়েছেন।
এমন হতে পারে যে এই ইউএলভিজেড হয়তো পুরো কোরের চারদিকেই একটি কম্বলের মতো জড়িয়ে আছে।
কিন্তু এমন কোনো অনুমান নিশ্চিত করতে হলে আরো অনেক বেশি অনুসন্ধান ও গবেষণা দরকার।