এই প্রাণী থেকেই কি কোভিড মানুষের শরীরে ঢুকেছিল
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৬ মার্চ,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:২৮ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
বিজ্ঞানীদের একটি দল দাবি করেছেন, প্রথম কোভিড-১৯ ভাইরাস মানব শরীরে ছড়িয়ে কিভাবে পড়েছিল, তার ‘সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ’ তারা খুঁজে পেয়েছেন। এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাসটি কিভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছিল- তা নিয়ে নানারকম গবেষণাও হয়েছে। যার মধ্যে পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব রয়েছে এবং যার মধ্যে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। যদিও ওই সব থিওরির কোনোটিই চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত হয়নি।
এসব জটিলতার মধ্যে নতুন এই গবেষণার তথ্যকে একটি মোড়বদলকারী ঘটনা বলে মনে করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে একটি নির্দিষ্ট প্রাণী প্রজাতিকে লক্ষ্য করে সর্বশেষ এই গবেষণা করা হয়।
তিন বছর আগে উহানের হুয়ানান বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে সংগ্রহ করা নমুনার ওপর ভিত্তি করে এ সব বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। শুরু থেকেই ধারণা করা হয়েছিল যে ওই বাজার থেকেই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে।
গত ২০ মার্চ এই গবেষণার ফলাফল একটি অনলাইন জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। যখন কোভিড একটি রহস্যময় রোগ হিসাবে বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত ছিল, সেই ২০২০ সালের প্রথমদিকে ওই বাজার থেকে নমুনাগুলো সংগ্রহ করেছিল চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)।
সম্প্রতি সেসব নমুনার জেনেটিক তথ্য বের করা হয়েছে, যা সংক্ষিপ্ত এবং সার্বজনীন। সেসব তথ্য পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানীদের একটি দল কোভিড-১৯ ভাইরাস বিস্তারের জন্য মধ্যবর্তী বাহক হিসাবে 'রেকুন ডগ' নামে একটি কুকুরজাতীয় প্রাণীকে শনাক্ত করেছেন। যেখান থেকে ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, বাজারের যে জায়গা থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় সার্স কোভ-২ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে এবং যেখানে বন্য স্তন্যপায়ী প্রাণী মাংসের জন্য বাজারে বিক্রি করা হচ্ছিল। সেখানে এই রেকুন কুকুরের লালাও পাওয়া গেছে।
কিন্তু করোনাভাইরাসের উৎস খোঁজার ব্যাপক অনুসন্ধান এবং দীর্ঘদিন আগেই বাজারটি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং বিক্রির জন্য আনা প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলার কারণে এই বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই।
তিন বছর আগে গবেষণাটি করা হলেও সেটার ফলাফল প্রকাশে এত বেশি দেরি হওয়াকেও অনেক বিজ্ঞানী ‘কলঙ্কজনক’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘কোন গবেষণাগার থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল'- যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের মধ্যে এমন একটি তত্ত্ব যখন জোরালো ভিত্তি পেতে শুরু করেছে, তেমন আভাসের মধ্যেই এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হলো।
চীনের সরকার অবশ্য ওই দেশের কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে ভাইরাসটির জন্ম হয়েছিল বলে যে ধারণা করা হচ্ছে, তা জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এবং মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি ধারণা করছে যে সেটা ‘হলেও হতে পারে’।
ভাইরাসের উৎপত্তি রহস্য নিয়ে তদন্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে গত ১ মার্চ এফবিআইয়ের পরিচালক চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে তারা তদন্তে ‘বিভ্রান্তি এবং অস্পষ্টতা’ তৈরি করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। সেই সাথে তিনি বলেন, চীনের কোন গবেষণাগার থেকে ভাইরাসটির বিস্তার তত্ত্বের ব্যাপারে অনেক দিন ধরেই এফবিআই নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সেটা জানার পরেও কেন এফবিআই এসব তথ্য প্রকাশ করেনি, তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন কোনো কোনো বিজ্ঞানী।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানে তিন বছর ধরে যারা কাজ করেছেন, এমন কয়েকজন বিজ্ঞানীর সাথে কথা বলেছে বিবিসি। তারা বিশ্বাস করেন, কিভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল, এই নতুন গবেষণা তা বোঝার জন্য সবচেয়ে কাছাকাছি থিওরি বা তত্ত্ব হতে পারে। সেই সাথে চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, তা রহস্য সমাধানের বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
নতুন গবেষণায় কী জানা যাচ্ছে? চীনে বন্যপ্রাণী বাজার থেকে সংগ্রহ করা নমুনাগুলোর জিনগত বিশ্লেষণ করে দেখেছেন প্যারিসের ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ইন্সটিটিউটের সিনিয়র গবেষক ড. ফ্লোরেন্স ডেবারে। তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সায়েন্স ইন অ্যাকশন প্রোগ্রামকে বলেছেন, যখন তিনি প্রথম জানতে পারেন যে এই ধরনের কিছু তথ্য রয়েছে, সেটা পাওয়ার জন্য তিনি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।
বিজ্ঞানীদের এই ধরনের তথ্য শেয়ার করার প্লাটফর্ম- জিআইএসএআইডি নামের একটি জেনেটিক তথ্যভাণ্ডারে এসব জেনেটিক কোড পাওয়ার এবং ডাউনলোড করে নেয়ার পর তিনি এবং তার সহকর্মীরা বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন যে চীনের ওই বাজারে ভাইরাসের স্থান থেকে সংগ্রহ করা নমুনার সাথে কোন জাতীয় প্রাণীর নমুনার মিল রয়েছে?
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কম্পিউটার স্ক্রিনে যে সব ফলাফল পেয়েছি, তা হলো, রেকুন কুকুর, রেকুন কুকুর, রেকুন কুকুর, রেকুন কুকুর।’ রেকুন ডগ হচ্ছে এমন একটি ছোট আকারের কুকুর-সদৃশ প্রাণী, যার সাথে শিয়ালেরও অনেক মিল আছে। পূর্ব এশিয়ার চীন, জাপান, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চলে এ প্রাণীটির আবাসস্থল রয়েছে।
ড. ডেবারে ব্যাখ্যা করছেন, ‘সুতরাং আমরা একই জায়গায় একই সাথে ভাইরাস এবং (বাহক) প্রাণী খুঁজে পেয়েছি।’ তিনি বলছেন, ‘এর মানে এই না যে ওই কুকুরগুলো সংক্রমিত হয়েছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা যত ব্যাখ্যা পেয়েছি, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা।’
এই গবেষণার সাথে জড়িত সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডি হোমসের মতে, ভাইরাসটি কিভাবে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে এসেছে, এটাই তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ। প্রফেসর হোমস বিবিসিকে বলছেন, ‘আমরা আর কখনোই সেই বাহক প্রাণীটিকে খুঁজে পাবো না, কারণ সেটি (তথ্যপ্রমাণ) হারিয়ে গেছে।’
তিনি বিবিসিকে আরো বলেছেন, ‘এই পুরো ব্যাপারটি অসাধারণ যে জেনেটিক তথ্যের মাধ্যমে সেটাকে খুঁজে পাওয়া গেছে। আর এর মাধ্যমে শুধু সেটা কোন প্রজাতি তাই নয়, তারা বাজারের ঠিক কোন জায়গায় ছিল, সেটাও আমরা জানতে পারছি।’
কোভিডের উৎস সম্পর্কে এখন বিজ্ঞানীরা আর কী করতে পারেন?
সর্বশেষ এই গবেষণায় পাওয়া নতুন তথ্যগুলো কোভিড মহামারীর উৎস সম্পর্কে আরো জানতে বা গবেষণা করতে মূল ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, সেই গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া জটিল হবে।
রটারডামের ইরাসমাস ইউনিভার্সিটিরই অধ্যাপক মেরিয়ন কুপম্যানস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্তকারী দলের সদস্য ছিলেন, যারার ২০২০ সালে উহানে গিয়েছিল।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘নতুন গবেষণায় এসব প্রাণীর অবস্থান নির্দিষ্ট স্টল বা দোকানে থাকার বিষয়টি চিহ্নিত করে দিয়েছে। সেখানে বিক্রি করা প্রাণীগুলোয় কোথা থেকে এসেছে, তা আপনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। কিন্তু এটা যদি অবৈধ বিক্রির অংশ হয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্ন হলো যে আপনি সেসব তথ্য আর খুঁজে পাবেন কিনা?’
যেসব খামারে এসব প্রাণী বড় করা হয়েছে সেখানেও জৈবিক প্রমাণ থাকতে পারে। গবেষকরা যদি সেসব খামারের প্রাণীতে অ্যান্টিবডি দেখতে পান, যা প্রমাণ করে যে এসব প্রাণী সার্স কোভ-২ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। সেটাও গবেষকদের আরেকটি সূত্র দিতে পারে।
জেনেটিক এসব তথ্য গবেষণার বা তদন্তের ক্ষেত্র অনেক কমিয়ে আনতে পারে।
তবে অধ্যাপক হোমস বলছেন, কোন প্রাণীর মধ্যে আসল ভাইরাসটি ছিল তা খুঁজে বের করা বেশ কঠিন একটা কাজ হবে।
মহামারী কিভাবে শুরু হয়েছিল, সেই উত্তর পাওয়া যাবে?
এই গবেষণায় সেটা অবশ্যই নিশ্চিতভাবে বলা যায়নি। হয়তো এটা এমন একটা উত্তর, যা কোনোদিনই জানা যাবে না।
সেই উত্তর খোঁজার কাজটি এখন ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক এবং বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।
এই গবেষণায় যদিও আগের তত্ত্বকেই জোরালো করে তুলছে যে ভাইরাসটি বন্য প্রাণী থেকে উদ্ভূত হয় এবং উহানের বাজারেই তা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।
কিন্তু আরেকটি থিওরিতে বলা হচ্ছে, উহান ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজির একটি গবেষণাগার থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জির গোয়েন্দা মূল্যায়ন এবং মহামারীর উৎস সম্পর্কে রিপাবলিকান নেতৃত্বাধীন শুনানির পর এফবিআইয়ের পদক্ষেপের কারণে দ্বিতীয় থিওরিটি শিরোনাম হয়ে উঠেছে।
বিবিসির সায়েন্স ইন অ্যাকশনের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক হোমস এর আগের একটি গবেষণার ফলাফলের দিকে গুরুত্বারোপ করেছেন।
‘মহামারীটি বাজার থেকেই ছড়াতে শুরু করেছিল। এখন আমরা বুঝতে পারছি যে কেন মূল প্রাণীগুলো সেখানে ছিল।’
তিনি বলছেন, ‘উহানের গবেষণাগারের আশপাশ থেকে মহামারীর সূত্রপাত হয়নি, সেটা ৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল। প্রথমদিকে গবেষণাগারের আশেপাশে সংক্রমণেরও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’
এসব মূল্যবান তথ্য প্রকাশে তিন বছরের বেশি সময় ধরে বিলম্ব করায় চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) প্রতি ক্ষোভ ও হতাশাও প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
অধ্যাপক হোমস বলেন, ‘এসব তথ্য তিন বছরের পুরনো। এত দিন ধরে সেটা প্রকাশ না করা একটা বড় ধরনের লজ্জাজনক ব্যাপার।’
জিআইএসএআইডি তথ্যভাণ্ডারে এসব তথ্য আপলোড করা হয়েছিল এই বছরের জানুয়ারি মাসে। কিন্তু কেউ সেটা লক্ষ্য করেনি।
ধারণা করা হয় যে এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চীনের সিডিসির গবেষকদের তৈরি করা একটি গবেষণার সহায়তা নথিপত্র হিসেবে এটা আপলোড করা হয়েছিল। (বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকাশের জন্য এ ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড তথ্য অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।)
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চীনা গবেষকরা জানতে পারেন যে অন্যরা তথ্যটি দেখতে পেয়েছে। এরপর সেসব তথ্য আবার লুকিয়ে ফেলা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস গেব্রেইয়েসুস গত ১৭ মার্চ একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘(মহামারী উৎস) রহস্যের উত্তরের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য প্রতিটি তথ্যই গুরুত্বপূর্ণ’ এবং ‘কোভিড-১৯ এর উৎস সম্পর্কিত যেকোনো গবেষণার প্রতিটি তথ্য অবিলম্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে ভাগাভাগি করা উচিত।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘আমাদের রাজনীতির বাইরে যেতে হবে এবং বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের চর্চা করতে হবে।’
ঘেব্রেইয়েসাস আরো বলেছেন, ‘বন্যপ্রাণী থেকে মানুষের শরীরে ভাইরাস আসে এটা আমাদের সেই বিবর্তনের ইতিহাস থেকেই একটি প্রচলিত সত্য। এখানে আমরা যেটা করতে পারি। তা হলো এই বন্যপ্রাণী থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখা এবং আরো ভালো নজরদারি করা।’