avertisements 2

কবুতরের জন্য গাছতলায় ঘুমান বিল্লাল

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ মার্চ,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০১:৪৩ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

শরীয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বসতভিটা। বিল্লালের বয়স তখন মোটে তিন দিন। সব হারিয়ে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে মা-বাবা দুজন পাড়ি জমান ঢাকায়। আজ এখানে, তো কাল ওখানে করে করে একসময় চলে আসেন হাইকোর্টের সামনে। দেখলেন এখানে তাঁদের মতো ছিন্নমূল অনেকেই আছে। তাদেরই একজন বললেন, ‘এখানে রাত হইলে কাত হওনের অসুবিধা নাই। পান-বিড়ি-পানি বেইচা হইলেও চলন যাইব।’ সেই থেকে এখানেই ধুলাবালি গায়ে মেখে বড় হতে থাকেন বিল্লাল। এখন মা বাসায় কাজ করেন। বিল্লাল বাবার সঙ্গে হাইকোর্টের সামনে বটগাছের নিচে চা-বিড়ি বেচেন।

তবে যৌবনের শুরুতে বটতলায় ছিলেন না। বনানী চেয়ারম্যানবাড়ির কাছে একটা বাসায় থাকতেন। কবুতর পালতেন বলে একদিন বাড়িওয়ালা এসে ধমকালেন—‘কবুতর বাসায় থাকলে তুমি থাকবার পারবা না।’ অগত্যা সেই বাসা ছাড়লেন, কিন্তু কবুতর নয়।

এরপর থেকে যেসব বাসায় উঠেছেন সেসব বাসাতেও কিছুদিন নির্বিঘ্নে থাকার পরে প্রতিবেশীরা বিরক্ত হতো। বাড়িওয়ালা এসে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিতেন। এভাবে সাত-আটটা বাসা বদলাতে হয়েছে। পরে দূরসম্পর্কের এক খালার বাসায় উঠলেন। সেখানে কুড়ি জোড়া কবুতর পেলেছেন। কিন্তু কয়েকমাস পর বাড়িওয়ালা এসে বললেন, ‘কবুতর বিক্রি করে দিতে হবে।’ রাজি না হওয়ায় খালার বাসার দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল বিল্লালের জন্য। খালা বললেন, ‘তোর জন্য মাইনসের কথা হুনতে অয়। তুই কবুতর লইয়াই থাক।’

বিল্লাল হোসেন

পরে রাগ করে সেই কবুতর আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বিল্লাল। এ রকম ঘটনা ঘটেছিল আরো দুই জায়গায়। এক পর্যায়ে দুই বন্ধু মিলে একটা বাসা নিয়েছিলেন। সেখানে ঘরের মধ্যে কবুতর  রাখতেন। কিন্তু বন্ধুটারও বেশিদিন সইল না। বললেন, ‘কবুতরের এক ধরনের গ্যাস (গন্ধ) আছে না। হেইটার জন্য অবজেকশন আইল।’ পরে সে বাসাও ছাড়লেন। মজার বিষয় হলো, বিল্লাল বাসা ছাড়লেও কবুতরগুলো ঠিকই পুরনো বাসায় ফিরত। প্রথম দিকে সেগুলো আনতে যেতেন। বছর কয়েক আগে এ রকম একটা কবুতর নিয়ে ফিরেছেন বটতলায়। আরেকটা কবুতর কিনেছিলেন কাপ্তান বাজার থেকে। কী মনে করে এক সকালে দুটিকেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। ‘দেখি আল্লায় যদি রাহে, তাইলে থাকব আর না রাখলে নাইগ্যা।’ কবুতর দুটি উড়তে উড়তে অনেক দূর চলে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার চায়ের কাপে লিকার ঢালা শুরু করলেন বিল্লাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পের মতো তিনিও হয়তো ভাবছিলেন, ‘পৃথিবীতে কে কাহার।’ কিন্তু গল্পে পোস্টমাস্টার রতনের কাছে না ফিরলেও মিনিট বিশেক পর দুটি কবুতরই ফিরল বিল্লালের কাছে! এটা বছর তিনেক আগের কথা। সেই থেকে হাইকোর্টের সামনে কবতুর পালা শুরু করেন বিল্লাল। কবুতরের খোপ বানালেন। বটগাছের মাঝামাঝি একটি জায়গায় বসালেন সেগুলো। বাঁশ দিয়ে ভালোমতো ডালের সঙ্গে বাঁধলেন। বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে বাসার ওপরে এবং পাশে পুরনো ব্যানার লাগিয়ে দিলেন।

এখন ৯টি খোপে ২০টি বড় কবুতর আছে। এগুলোর আবার ছোট ছোট বাচ্চাও আছে। খিদে লাগলেই কেবল বিল্লালের কাছে আসে কবুতরগুলো। বাকি সময় গাছের ওপরেই থাকে। ‘মনদিল ভালা’ থাকলে কিছুক্ষণ পরপর খাবার দেন। গম, সরিষা, ভুট্টা ইত্যাদি মিক্সড করে খাওয়ান। তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন খাবার কিনতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর।

কবুতরের নেশা পেয়ে বসল কখন? ‘ভাই, আর কইয়েন না। ছোডবেলায় দেখছি হাইকোর্ট মাজারে লোকজন কইতররে খাওয়াইতো। খাড়াইয়া দেখতাম। মনে হইত, আমারও যদি এ রকম কইতর থাকত। কিন্তু আমার তো বাড়িঘর নাই। একদিন একটা কবুতরের বাচ্চা দেখলাম উড়তে পারে না। কেডা জানি পাখ কাইটা দিছে। একটা বিড়াল চাইয়া রইছে ওইটারে ধরার লাইগ্যা। বাচ্চাটা লইয়া আইলাম। মা কইছে—বাবা, এগুলোরে নষ্ট করিস না। সেই থেইক্যা কইতরের লাইগ্যা মায়া। এখন এডিই আমার ফ্যামেলি। এহানে লোকে গাঁজাগুজা খায়। কইতর লইয়া থাকি বলে খারাপ নেশার সময় পাই না।’

হাইকোর্টের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখান থেকে কবুতর নিয়ে ওড়ানো হয় বলে জানালেন বিল্লাল। তবে বিশেষ দিনগুলোতে হাইকোর্ট এলাকায় পুলিশি তৎপরতা বাড়ে। ছিন্নমূল মানুষগুলোও তখন আর থাকতে পারে না। তখন রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারেন না বিল্লাল। বললেন, ‘পুলিশ খেদাইয়া দেয়। দূরে দূরে থাইক্যা পাহারা দিই। এগুলোর যদি কোনো ক্ষতি হইয়া যায়গা, আমার আফসোস পুরাইব না।’ কখন জানি চুরি হয়ে যায় এই ভয় তো আছেই। কবুতরগুলোর জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন না বিল্লাল। ‘এডির লাইগ্যাু দূরে যাইতেও পারি না। টেনশনে পইড়া যায়গ্যা। ঘরে বাচ্চাবুচ্চা আছে, ডিমডুম আছে। এখানে অহন শত্রু অইল কাউয়া। ডিম লইয়া, বাচ্চা লইয়া দৌড় দেয়। বৃষ্টি হইলে আমার চাইয়া টেনশন বেশি কেউ করে না। ওগো লাইগ্যা এখন আর বাসায় থাকি না। গাছতলায় ঘুমাই।’

তবে এভাবে কত দিন রাখা যাবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন বিল্লাল। বললেন, ‘এডিরে আমি বেচতে পারুম না। যত দিন সম্ভব নিজের কাছে রাখুম।’

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2