কার্ডে লেখা আবাসিক হোটেল, কিন্তু আড়ালে...
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১১:০৫ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
এক দোকানি মিরপুর ১০-এ ফুটপাথে চশমার দোকান সাজাচ্ছিলেন। তবে তিনি খুব বিরক্ত। কারণ পুরো জায়গাটি ভরে গেছে ভিজিটিং কার্ডে। নানান রঙয়ের কার্ড। পরিষ্কার করতে করতে বললেন, দেখছেন কারবার? রোজ পরিষ্কার করি। সকালে এসে দেখি আবার জমে যায়। কার্ডগুলোতে দেখা গেল রহস্যজনকভাবে কিছু নামের সঙ্গে ‘ভাই’ শব্দটি জুড়ে দেয়া তিনি বললেন কোন ‘ভাই’ এরা জানেন? খোঁজ নিয়ে দেখেন। ওই যে ওভারব্রিজ দেখছেন, সেখান থেকে সব ফেলে ওরা।
দোকানির কথামতো ওভারব্রিজে গিয়ে দেখা মিললো অন্তত ১৮-২০ জন যুবকের। তাদের টার্গেট চলমান পথচারী। ওভারব্রিজে তারা এমনভাবে অবস্থান নিয়েছে যে, পথচারীদের হাঁটাই মুশকিল। কেউ কেউ সেসব যুবকের দেয়া কার্ড নিচ্ছেন।
কেউ বা বিরক্ত হয়ে গালি দিচ্ছেন। তবে তাতে কিছু আসে যায় না তাদের। কাউকে বা তারা জোর করে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে কার্ডগুলো।
এমন কিছু কার্ড নিয়ে দেখা গেল বিষয়টা আসলেই রহস্যজনক। সেসব কার্ডে ‘সিফাত ভাই’, ‘রবি ভাই’, ‘স্বাধীন ভাই’, ‘তুষার ভাই’, ‘চান্দ ভাই’ ‘মাটি ভাই’, ‘শান্ত ভাই’ এমন আরও হরেক নাম বড় করে লেখা। নিচে লেখা আবাসিক হোটেল। এসি/নন এসি। তাতে যুক্ত করা দুটা বা একটা মোবাইল নম্বর। ছোট্ট করে হোটেল কক্ষের ছবি। কোনোটায় গোলাপফুল বা ইন্টারনেট থেকে নামানো মেয়ের ছবিও দেয়া। কিন্তু সেসব হোটেল বা গেস্ট হাউজের কোনো ঠিকানা উল্লেখ নেই। শুধু লেখা এলাকার নাম। কোনোটায় লেখা থাকে- আসার আগে ফোন দিন।
কার্ডের সূত্র ধরে এক নম্বরে ফোন দেয়া হলে বললেন, কতোদূর আছেন? তিনি ফোনে ডিরেকশনও দিলেন। বললেন, সোজা কাজীপাড়া বরাবর হাঁটতে থাকুন। মেট্রোরেলের পিলারের (পিলারের নম্বর দিয়ে) কাছে আসুন। তার কথামতো সেখানে গেলে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা কয়েকজন পিছু নেয়। কার্ডের নম্বরওয়ালা সে লোক পুনরায় ফোনে বললেন, এই যে একটু ডানের বিল্ডিংয়ের দিকে তাকান। তিনি জানালা দিয়ে হাত ইশারা করছেন। পৌঁছতেই ঘিরে ধরলো অন্তত ছয়-সাতজন। তারা বললেন, ভাইয়ের কাছে যাবেন? আসেন। উপরে গেলে সেই কথিত ‘ভাই’ প্রশ্ন করলেন, কেমন বয়সী মেয়ে চান? স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি বা যে শহরের চান সব আছে। বলেই তিনি পেছনে তাকাতে বললেন। ১৫-২০ জন নানান বয়সী মেয়ে সেখানে বসে আছে। সরাসরি অফার করে বসলেন তিনি। চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। চাইলে সারারাত থাকতে পারবেন। এমন আরও অফারই তিনি করলেন।
জানতে চাওয়া হলো- প্রকাশ্যে আবাসিক হোটেলের কথা বলে এগুলো অসামাজিক কাজ চালাচ্ছেন। কেউ বাধা দেয় না? কার এত ক্ষমতা। ‘বড় ভাই’ আছে না? তবে তারা তাদের সেই ‘বড় ভাইয়ের’ নাম বললেন না। তাদের ভাষ্যমতে, সবই নাকি ম্যানেজ করা থাকে। তবে কার্ডে এসব ‘ভাই’দের আসল নাম দেয়া থাকে না। এরা প্রকৃতপক্ষে যৌনকর্মীদের দালাল। এভাবে হোটেলের কথা বলে যৌনকর্মীদের কাছে নিয়ে যায়। কখনো বা সরাসরি অফার করে বাসায় সাপ্লাই দেয়ারও।
কার্ডে কেন হোটেলের ঠিকানা দেয়া থাকে না? বললেন, ঠিকানার দরকার পড়ে না। নিজেরাই গিয়ে নিয়ে আসি কাস্টমারদের।
মিরপুর ১০-এর ওভারব্রিজের সেসব যুবকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাদের কেউ বাধা দেয় কিনা। বাবর নামের একজন বললেন, কে বাধা দেবে? বাবর যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন আরও পাঁচ-ছয়জন এসে ক্ষিপ্ত হয় এই প্রতিবেদকের ওপর। এখান থেকে যান বলছি। ডিস্টার্ব করবেন না। তাদের দাপট সত্যি বেশ ভয়ঙ্কর। জুটে গেল আরও জন দশেক তরুণ। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন এসে তাদের অভয় দিতে থাকলো। এইখানে তোদের কেউ কিছু বলবে না। নির্ভয়ে কার্ড দিয়ে যা। তার কথা মতো বাবর ও কয়েকজন মিলে কার্ডগুলো ওভারব্রিজের দেয়ালে সাজাতে লাগলেন। এই কাজে ১০-১৫ বছর বয়সী কিশোরও রয়েছে। অনেক যুবক ঢাকায় এসে এসব কার্ড বিলির কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে।
এদেরই একজন জানান, কার্ড বিলির বিনিময়ে দিনে চার-পাঁচশ টাকা পান জনপ্রতি। অসুবিধা হলে শেল্টার দেয় বড় ‘ভাই’য়েরা। এসব কার্ডে যাদের নাম উল্লেখ করা থাকে তারা মূলত দালাল। এই দালালদের যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের নাম কেউ প্রকাশ করে না।
মিরপুর ১০, ১, ২ ওভারব্রিজ, ফুটপাথ বা মূল সড়কে চলমান গাড়িতে যারা কার্ড দেয়ার কাজ করে তাদের কয়েকজনের ভাষ্যমতে, এসব এলাকায় বেশকিছু হোটেলে দেহ ব্যবসা চলে, কখনো কখনো বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়েও।
এদের কার্ড দেয়া এবং এসব অসামাজিক কার্যকলাপে বিরক্ত পথচারী, দোকানি, স্থানীয় বাসিন্দারাও। একজন ফুল ব্যবসায়ী বললেন, মাঝেমধ্যে খুব লজ্জায় পড়তে হয়। বাসের এক যাত্রী ক্ষোভ নিয়ে বললেন, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে যখন এসব পথে আসি তখন খুব দ্রুত চলে যাই। চোখ সরিয়ে নেই। তারা শরীর বরাবর কার্ড ছুড়ে। ছেলে-মেয়ের গায়েও কার্ড এসে পড়ে।
এমন কার্ড ছুড়ে দেয়া বা কার্ড পড়ে থাকতে দেখা যায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। গত বৃহস্পতিবার মিরপুর-১০, মিরপুর-২, মিরপুর-১, টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর, মগবাজার কাওরান বাজার, ফার্মগেট এলাকাতেও দেখা গেল একই চিত্র। গলি থেকে মূল সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কার্ড পড়ে রয়েছে। ঠিকানাবিহীন এসব কার্ডে যোগাযোগের মাধ্যম শুধু মোবাইল নম্বর। কেউ কল দিলে তারাই রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যায়। নজর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া, গার্মেন্টকর্মী, বেকার যুবকদের ওপর। আগে এই দেহ ব্যবসার প্রচারণা আড়ালে চললেও এখন কোনো রাখঢাক নেই। কখনো বা যৌনকর্মীরা মুখে মাস্ক বা বোরকা পরে নিজেরাই এসব ভিজিটিং কার্ড বিলি করে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় রাজধানীর দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আমিনুল বাশার পিপিএম-এর কাছে। তিনি বলেন, এটা আসলে খুবই বিব্রতকর একটা বিষয়। আমরা স্পেসিফিক নিউজ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেই। এসব ব্যাপারে কোনো ছাড় দেই না। শুধু এটা কেন, সবদিক দিয়েই। মাদক বলেন বা অন্য যেকোনো কিছু, আমরা ব্যবস্থা নেই।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন বলেন, আমরা অবশ্যই চাই এগুলো বন্ধ হোক। কারণ সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অনেক খারাপ। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি রোধের। আইনের কঠোরতা দরকার। প্রতিনিয়ত মনিটরিং করি। আমরা পেলেই ধরি। যখনই এ ধরনের খবর পাই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেই। তবে আশেপাশে হোটেলগুলোতে এ ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ আমরা পাইনি। আমরা অভিযান চালাই। তবে ১০ নম্বর ফুটওভার ব্রিজে মাঝে মাঝে এসব হয়। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।