প্রকৃত আলেমরাই সিদ্ধান্ত দিতে পারেন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:৫২ পিএম, ১২ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০৩:১৫ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণসংক্রান্ত বিতর্কের ঝড় সহসা থামবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রথমে ভেবেছিলাম এ বিষয়ে কিছু লিখব না বা কোনো কিছু না লেখাই বোধহয় ভালো হবে। কারণ লিখতে গেলে তা অবশ্যই উভয় পক্ষে যাবে না। আবার নিরপেক্ষতা রক্ষা করে লিখতে গেলে তা হবে নিজের সঙ্গে আপস করার শামিল।
কারণ মানুষ মাত্রই নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, বুদ্ধি-বিবেচনা দ্বারা পরিচালিত। আর এক্ষেত্রে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার বিষয়টি জড়িত বিধায় শত চেষ্টা করলেও লেখাটির বিষয়বস্তু একদিকে চলে যাবেই। এ অবস্থায় সবকিছু বিবেচনায়, নিজের স্বাধীন চিন্তা-চেতনার ওপর আস্থা রেখেই লেখাটি শুরু করলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা বিশ্বে একজন অবিসংবাদিত নেতার নাম। তাকে নিয়ে নতুন করে কিছু করতে গেলে আলোচনা-সমালোচনা হবে এবং তা একটু বেশিই হবে সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং বর্তমানে তার ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়ে সারা দেশে যা শুরু হয়েছে সেক্ষেত্রেও খুব বড় ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়া এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে যা জানতে ও বুঝতে পারছি, তাতে মনে হচ্ছে সাদামাটা চিন্তায় বা সহজ সিদ্ধান্তে বিষয়টি ফয়সালা করা সম্ভব হবে না। আর তা করা উচিতও হবে না।
কারণ ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে এত বেশি ধর্মীয় অনুভূতি ও আবেগ সৃষ্টি করা হয়েছে, যা একেবারে উপক্ষণীয় নয়। আর এ কাজটি করতে সফল হয়েছে এ দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী। এ গোষ্ঠী বা শক্তি বিভিন্ন মিডিয়া ব্যবহার করে দেশ-বিদেশের ধর্মভীরু মুসলমানদের মধ্যে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে যা আমরা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি। আবার আমরা যারা স্বাধীনতার পক্ষের তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনার ধারক ও বাহক, তারাও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বড়সড় আন্দোলন গড়ে তুলেছি। এক্ষেত্রে আমাদের আন্দোলনের শক্তি যতটা দৃশ্যমান, অপর পক্ষেরটি ততটা দৃশ্যমান না হলেও তা একেবারে কম নয়।
কারণ মৌলবাদী শক্তি তাদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণায় এসব বিষয় জিহাদি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ সবকিছুই একদেশদর্শী। প্রতি বছর কিছুসংখ্যক মাদ্রাসাছাত্র ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি যে ধরনের দীক্ষা লাভ করেন, তাতে করে তাদের মনে ধর্ম সম্পর্কে অনেক কুসংস্কার ঢুকিয়ে জিহাদি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ অবস্থায় দিনরাত শুধু একই বিষয় নিয়ে পড়ে থাকায় তাদের মাথায় অন্য আর কিছু ঢোকে না বা ঢোকানো সম্ভব হয় না।
ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধর্মীয় কুসংস্কার তাদের এমনভাবে গ্রাস করে যে, ধর্মের নামে তাদের দিয়ে কোটারি স্বার্থ হাসিলসহ অনেক কিছুই করানো সম্ভব। সে অবস্থায় কুষ্টিয়ার যে দু’জন মাদ্রাসাছাত্র বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করেছে তারা তা বুঝেশুনে করেছে, নাকি ধর্মের নামে উসকানি দিয়ে কাজটি করানো হয়েছে, সে প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ।
যে দু’জন ছাত্রকে রাতের অন্ধকারে মই বেয়ে উঠতে দেখা গেল, তারা পরিণত বয়স্ক বলেও মনে হল না। এ বয়সে তাদের ভালো-মন্দ বোঝার সময়ও হয়নি। অথচ তাদের দিয়েই ধর্মের নামে বিরাট অপকর্মটি করানো হয়েছে। তারা হয়তো বোঝেওনি যে কতবড় মহা অপরাধ তারা করে ফেলেছে! সুতরাং এক্ষেত্রে যারা তাদের দিয়ে কাজটি করিয়েছে, তারাই যে মূল অপরাধী সে কথা বলাই বাহুল্য।
ইসলাম একটি মহান ধর্ম। যুগে যুগে ইসলাম মানবসমাজকে সুন্দর ও সুপথের সন্ধান দিয়েছে, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানিমুক্ত জীবনের পথ দেখিয়েছে। অথচ সেই ইসলাম ধর্মেরই অপব্যবহার করে একদল লোক নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে চলেছে! সহজ-সরল ধর্মভীরু মানুষকে নিজ মতলবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তাদের মগজে কুসংস্কার ঢোকানো হচ্ছে! বস্তুত অনেক ক্ষেত্রে মাদ্রাসাছাত্রদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে দূরে রেখে শুধু ধর্মীয় এবং পীর-দরবেশের জীবনীসংবলিত বইপুস্তক পাঠ করিয়ে তাদের একটি বিশেষ শ্রেণিতে পরিণত করে রিজার্ভ সৈন্য হিসেবে সময়মতো নিজেদের কাজে ব্যবহার করা হয়।
আর বর্তমানেও ঠিক সেই কাজটিই করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করে তারা নিজেদের অবস্থান এবং শক্তি প্রদর্শনের কাজটি ইতোমধ্যে সেরে ফেলেছে এবং এখন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে তারা তাদের প্রচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী প্রচারণা জমজমাট করে তুলেছে। ফলে অনেককেই এখন বলতে শোনা যাচ্ছে, ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। আর এখানেই মৌলবাদীদের সার্থকতা।
অন্যদিকে স্বাধীনতার পক্ষে বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষধারী আমরা তাদের কথার বিরোধিতা করে শাস্তি দাবি করছি। তাদের পক্ষেও জনমত তৈরি হচ্ছে। আর আমাদের দাবিই জোরালো বলে আমরা মনে করছি। তবে বর্তমান অবস্থায় আমরা যারা সোচ্চার কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের পক্ষে কাজ করে চলেছি এবং অপরদিকে যারা প্রকাশ্যে আমাদের বিরোধিতা করে চলেছে, তারা ছাড়াও এদেশে অন্য একটি শ্রেণি আছে, যারা পক্ষে-বিপক্ষে কোনো দিকেই সোচ্চার নন।
যদিও এ শ্রেণির মানুষেরও এ বিষয়ে তাদের নিজস্ব মতামত আছে। তাদের সঙ্গে কথা বললে জানতে ও বুঝতে পারা যায়, বিষয়টিতে তারাও স্পর্শকাতর। এ শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, তারা প্রকাশ্যে তাদের মতামত জানাতে কিছুটা হলেও ইতস্তত করেন। কোনো ঝামেলায় পড়েন কিনা সেই ভয়ে তারা মুখ ফুটে কিছু বলতে চান না। আবার অনেকেই আছেন, এসব না ভেবে তারা বলে ফেলেন।
এ অবস্থায় ভাস্কর্য বনাম মূর্তি নিয়ে এসব চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার মানুষের দেশে এ বিষয়ে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হবে সময়ের কাজ। আমাদের পক্ষে প্রচুর জনসমর্থন আছে, প্রচুর মিছিল-মিটিং হচ্ছে এ কথাটি যেমন সত্য, তেমনি ভিন্ন চিন্তাধারার লোকেরও কিন্তু অভাব নেই। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে যেমন বিরোধিতা করা হচ্ছে, অন্যদিকে ভেতরে ভেতরেও এ নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করা হচ্ছে।
সুতরাং কাজটি এমনভাবে করতে হবে যাতে সাপও মরে, আবার লাঠিও না ভাঙে! পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ভাস্কর্য আছে, সুতরাং আমাদের দেশে তা করতে অসুবিধা নেই। এ ধারণাটি যেমন ঠিক, তেমনি কোরআন-হাদিসের আলোকেও তা যে যথার্থ, তেমনটিও প্রমাণ করে কাজটি করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে বলে মনে করি। আর এজন্য একটি মজলিসে শূরা বা ইসলামী আলেমদের নিয়ে কোনো কমিটি গঠন করে সেই কমিটির ওপরও কাজটির দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ সরাসরি সরকার বা সরকারদলীয় সিদ্ধান্তের পরিবর্তে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব।
পরিশেষে বলতে চাই, উপরের পরামর্শটি সম্পূর্ণরূপে আমার ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা থেকে উল্লেখ করেছি। এ বিষয়ে কেউ ভুল বুঝবেন না বলেই মনে করি। কারণ আগেই বলে রেখেছি, প্রত্যেক মানুষেরই একটি নির্দিষ্ট বিচার-বুদ্ধি, ধ্যান-ধারণা আছে, যার দ্বারা তিনি পরিচালিত হন।