বিয়ে একটা সামাজিক ‘তামাশা’ হয়ে উঠেছে ক্যাম্পে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ নভেম্বর,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৫০ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
২১ বছর বয়সী নিয়ামতের (ছদ্মনাম) স্ত্রী সালমা (ছদ্মনাম) এখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কোলে রয়েছে আরেকটি কন্যাসন্তান। ঘরে নিয়মিত খাবার নেই। পাশের বাসা থেকে বাচ্চার জন্য খাবার দিয়ে যায়। সালমাকে জিজ্ঞেস করা হয়— নিয়ামত কোথায়? সে জবাব দেয় না। পাশে থেকে একজন বলেন, নিয়ামত দুই মাস হয় বিয়ে করেছে। সেখানেই থাকে। ২১ বছরেই দুই সন্তান রেখে আরেক জায়গায় বিয়ে করা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলে, সেই নারী জানান— এখানে এটা কোনও বিষয়ই না। বিয়ে না করে অন্য ঘরে যাওয়ার থেকে বিয়ে করে গেছে, সেটা ভালো। বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরে আবারও ফিরে আসবে— এই আশা নিয়ে দিন গুনছে সালমা। সন্তান জন্মের পরে আবার যে ফিরবে, আপনি নিশ্চিত? সালমা বলেন, ‘ফিরবে। গত সন্তান যখন পেটে ছিল সেসময়েও ছেড়ে গিয়েছিল।’
ক্যাম্পে খুঁজে বের করা হয় নিয়ামতকে। নতুন যাকে বিয়ে করেছেন, তার বয়স কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৩ বছর।’ ১৩ বছরের মেয়েকে বিয়ে করার কারণ কী জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পে মেয়েদের নিয়ে নানা ঝামেলায় থাকেন বাবা-মা। আমি তাদের সেই সমস্যা কমিয়েছি।’ আগের ঘরের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর খোঁজ রাখেন কিনা জানতে চাইলে নিয়ামতের জবাব, ‘তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। মাঝে-মধ্যে খেতে যাই।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একাধিক বিয়ে এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। একজন পুরুষ ঠিক কতটা বিয়ে করছে, তার কোনও নথি নেই। বেশিরভাগ বিয়ে হচ্ছে মওলানার মাধ্যমে দোয়া পড়িয়ে কবুল। একাধিক বিয়ে নিয়ে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। কিন্তু পুরুষ- নারী কেউ অভিযোগ না করার কারণে বড় ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের কোনও উদাহরণ নেই। ২০১৮ সালে ক্যাম্প ইন চার্জকে (সিআইসি) শরণার্থী শিবিরে বৈধ বিয়ে রেকর্ড এবং নথি সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এটা মানছে না কেউ।
তিনটি বিয়ে করেছেন রহিম (ছদ্মনাম)। একাধিক বিয়ের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক পরিবারের অভিভাবক মেয়েদের নিয়ে শঙ্কায় থাকে। বিয়ের পরিচয় থাকলে তাদের কোনও ক্ষতি কেউ করে না। ফলে কোনও মতে বিয়ে দিয়ে অভিভাবক নিশ্চিন্ত হতে চায়। আমার প্রথম স্ত্রী দুটি সন্তানের পর আমার অনুমতি ছাড়া জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়ায় আমি দ্বিতীয় বিয়ে করি। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী নিজেই অন্যজনের কাছে চলে যাওয়ায় তৃতীয় বিয়ে করেছি।’
বেশি বিয়ে করলে সমাজে অসম্মানিত হতে হয় কিনা প্রশ্নে রহিম বলেন, ‘পুরুষ মানুষ বিয়ে করবে সেটাই স্বাভাবিক।’
৩৬ বছরের রহমান বিয়ে করেছেন ১২ বছরের নাসিমাকে (ছদ্মনাম)। দুই জন দুই ক্যাম্পের বাসিন্দা। পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্যাম্পে ক্ষমতা বাড়বে সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে। রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে এ ধরনের বিয়ের পরিমাণ কম না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন মনে করেন, অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত না করতে পারলে এধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঠেকানো যাবে না। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পের গন্ডির মধ্যে কাজহীন বসে থাকা জীবন-যাপনের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোও স্বাভাবিক করে তুলেছে তারা।’
মুসলিম আইনে বহুবিবাহের ক্ষেত্রে আগের স্ত্রীর অনুমতির বিধান আছে। পাশাপাশি তিনি (পুরুষ) ‘বিশেষ ক্ষেত্রে’ একাধিক বিয়ে করতে পারবেন। বিশেষ ক্ষেত্র বলতে সব স্ত্রীকে সমানভাবে রাখার সক্ষমতা। কিন্তু ক্যাম্পের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা পুরুষরা কোনও নিয়মই মানছে না। প্রশাসন বলছে, রোহিঙ্গারা এগুলো লুকিয়ে করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের জানার উপায় থাকে না। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে অনুমতি নিয়ে বিয়ে নিবন্ধনের আবেদন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কেউ করেনি।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘সাধারণত বিয়ে করতে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু অনেকেই লুকিয়ে মওলানা ডেকে বিয়ে করলে, সেটা কোনও মনিটরিংয়ে থাকে না। ফলে কারা বহুবিবাহ বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে যাচ্ছে, যা সুনির্দিষ্ট করা সহজ না। তবে এখানে ভিন্ন একটা বাস্তবতাও রয়েছে। ক্যাম্পে বিবাহযোগ্য পুরুষের সংখ্যা নারীর তুলনায় কম। পুরুষেরা নানাভাবে মিয়ানমারে কারাগারে গেছে, কেউ মালয়েশিয়া, সৌদি আরবে গেছে। ফলে সেই সুযোগটা নিচ্ছে অনেকে। যেকোনও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমনটা ঘটতে দেখা যায়।’