ষড়যন্ত্র তত্ব এবং COVID-19
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ এপ্রিল,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০৮:৩৪ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
মোঃ শফিকুল আলম: করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং এর উৎসস্থলের মধ্যেই ষড়যন্ত্র তত্বের উদ্ভবের সকল উপাদান নিহিত ছিলো এবং ইন্টারনেটের যুগে করোনাভাইরাস মহামারী আঁকার ধারনের পূর্বেই ষড়যন্ত্র তত্ব অধিকতর দ্রুত ভাইরাল হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই ভাইরাসের জন্ম মধ্য চীনের উহান প্রদেশের একটি সীফুড মার্কেটে বন্যপ্রানীর দেহে এবং এই ভাইরাস বন্যপ্রানী থেকে সংক্রমিত হয়েছে মানবদেহে। এই সংক্রমন ঘটেছে ২০১৯ এর শেষে। বিশেষ করে ডিসেম্বরে। এই সীফুড মার্কেটটির অবস্থান এবং চায়নার বায়োসেইফটি ল্যাবরেটরীর অবস্থান মাত্র আধা ঘন্টার ড্রাইভিং দূরত্বে।
মানব দেহে একটি মারাত্মক প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার দু’এক দিনের মধ্যেই কোনো অজানা সূত্র থেকে বায়োলোজিকাল অস্ত্র তৈরী হয়েছে মর্মে নিউজ প্রচারিত হয়ে যায়। এবং করোনাভাইরাস ছড়ানোর পূর্বেই অজানা সূত্র থেকে প্রচারিত হয় যে উহান ল্যাব থেকে এই ভাইরাস পালিয়ে নিকট দূরের সীফুড মার্কেটে মানবদেহে ছড়িয়েছে। সুতরাং অনেকেরই বিশ্বাস এই ভাইরাসের উৎপত্তি উহানের বায়োল্যাবে।
কি কি ষড়যন্ত্র তত্ব উচ্চারিত হচ্ছে? অনেকেই দাবী করছেন COVID-19 হচ্ছে চায়নার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন স্কীম। অথবা, ল্যাব্রেটরীতে চলোমান কোনো গবেষনা কার্যক্রম ভুল ফলাফলের জন্ম দিয়েছে। আবার অসংলগ্নভাবে কেউ বলছেন বড় বড় ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানীগুলো করোনাভাইরাস তৈরী করত: তার প্রতিশেধক (vaccines) তৈরী এবং তার প্যাটেন্ট গ্রাব করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামিয়ে নিবে।
ইতোমধ্যে আমেরিকা, ইরান, সাউথ আমেরিকা, এমন কি চায়না’র রাজনীতিকগন তাদের স্ব স্ব দেশের বিজ্ঞানীদের তথ্য বা অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর ক্রাইসিসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। রাশিয়া এবং চায়না সমর্থিত প্রচার মাধ্যম COVID-19 কে CIA এর সৃষ্টি বলে প্রচার করছে। অপর দিকে ট্রাম্প এবং হোয়াইট হাউজ বলছে চায়না আমেরিকান অর্থনীতি ধ্বংস করতে এবং ট্রাম্পের নেতৃত্বকে খাঁটো করতে করোনাভাইরাস প্লট তৈরী করেছে।
করোনাভাইরাসটি কোনো একটি ল্যাবে তৈরী এই ধারনাটি বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিশ্বাসযাগ্য ধারনা। কিন্তু সহজেই আবার ধারনাটি অমূলক হতে পারে। পুরো পৃথিবী জুড়ে অবশ্য হাজার হাজার বিজ্ঞানী এই ভাইরাসটি নিয়ে নিরলস বিস্তারিত গবেষনায় লিপ্ত রয়েছেন। বিজ্ঞানীরা এমনকি ২০১৩ সালে আবিষ্কৃত ব্যাট (Bat) ভাইরাসের সাথে করোনাভাইরাসের একটা কাছাকাছি সামন্জস্যতা খুঁজে পেয়েছেন এবং তাদের ধারনা এই ভাইরাসটির প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটেছে। তাদের এই ধারনা সত্য হলে ভ্যাকসিন বা প্রতিশেধক তৈরীর ফর্মূলা অনেকটা কাট এন্ড পেস্টের মতো সহজ হবে।
বিজ্ঞানীরা এখনও জানেননা যে প্রকৃতপক্ষে করোনাভাইরাস কখন এবং কিভাবে প্রানীদেহ থেকে মানবদেহে প্রবেশ করলো। কিন্তু প্রথম আক্রান্তদের অধিকাংশ বা প্রায় সবাই উহানের সীফুড মার্কেটের বন্যপ্রানী ব্যবসায়ী। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করেন যে ভাইরাসটি প্রকৃতি থেকে বিবর্তিত হয়েছে। তা’হলে কেনো ল্যাবে তৈরী হয়েছে এমন গুজব সর্বত্র ভাসমান? এই বিতর্কটির শুরু হয়েছে যখন একজন বিজ্ঞানী অন্য কোনো বিজ্ঞানীদের সাথে পরামর্শ না করে তড়িঘড়ি একটি গবেষনাপত্রে করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোডের মধ্যে HIV’র পাত্ত পেয়েছেন বলেছেন তখন থেকেই।
যদিও তিনি তার গবেষনাপত্রটি ভুল তথ্যের কথা স্বীকার করে তুলে নিয়েছেন। এই ম্যানুপুলেশনের কারনেই প্রথম একজন ইউএস সিনেটর প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং পরবর্তীতে এটি ভাইরাল হয়ে যায় যে ভাইরাসটি চীনের ল্যাবরেটরীতে তৈরী। COVID-19 ষড়যন্ত্র তত্ব কেনো এতো দ্রুত ছড়ালো? এই ধরনের গল্পে বিশ্বাস করা কি পাগলামো? অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফিলোসোফির সহযোগী অধ্যাপক কোলিন ক্লেইন বলেন যে যদিও এসব তত্ব ভুল তবুও দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে এটা বলা অযৌক্তিক হবেনা যে অনেকের কাছে অন্যদের থেকে বেশী তথ্য থাকতে পারে।
ষড়যন্ত্র তত্ব অস্পষ্টতা থেকে সৃষ্টি হয় যার পুরোটা প্রকাশিত হয়না।যখন দ্রুত মহামারী ছড়িয়ে পড়ছে তখন প্রতিদিন এই খবর এতো দ্রুত ছড়ায় যে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাসযোগ্য গবেষনাপত্র প্রস্তুতের সময়ও পাননা। তখন মিথ্যে আবিষ্কারও অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাসযাগ্য হয়ে যায়। বাস্তবে এই সমস্ত ভাইরাস জনিত রোগ প্রানীদেহ থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। আবার ৭০% নতুন প্যাথোজেন মানবদেহেও উদ্ভূত হয়। মানুষ বৃদ্ধির সাথে পৃথিবীতে এই প্যাথোজেনের নি:সরন হতে থাকে।
বিজ্ঞানীদের মতে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রনে যখন এক ধাপ এগিয়ে থেকে সম্ভাব্য ভাইরাসবাহকদের (Could be animal like bats) চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন তখনই এই ষড়যন্ত্র তত্ব ধুম্রজাল তৈরী করে রাজনীতিকগনকে লাইনচ্যুত করছে। ষড়যন্ত্র ছড়ানোয় কার ভূমিকা রয়েছে? সাইবারস্পেস ষড়যন্ত্র তত্ব ছড়ানোর উর্বর মাধ্যম বটে। অবশ্য ষড়যন্ত্র তত্ব নিজে নিজেই ছড়ায়। সামাজিক মাধ্যম সাধারন মানুষের মধ্যে একটি আবেগ তৈরী করে যখন মানুষ আর যুক্তি খুঁজতে চায়না। মানুষ তখন সত্যতা যাচাই করেনা।
এমতাবস্থায় ষড়যন্ত্র তত্ব আরও বেশী গতিতে ছড়ায়। বর্তমান সময়ে ষড়যন্ত্র তত্ব একটি বড় সমস্যার অন্যতম সিম্পটম। হতে পারে স্বচ্ছতার অভাব। আবার কমিউনিকেশেন ফেইলিউর। ষড়যন্ত্র তত্ব বন্ধ করার চেষ্টা করার পূর্বে মূলত খুঁজে বের করতে হবে কেনো মানুষ ষড়যন্ত্র তত্ব বিশ্বাস করে। একটি বড় সমস্যা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারলে ষড়যন্ত্র তত্বের সৃষ্টি হবেনা। সিম্পটমের জন্য অসুধ দিলে রোগের আরোগ্য হবেনা।