‘আমি কোনও সংখ্যা নই, গাজার একটি সত্যি ঘটনা– মনে রেখো’
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৮ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৫ | আপডেট: ০৭:৫০ এএম, ৮ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৫

ইসরায়েলের প্রায় দেড় বছরের আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তূপ ও মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। অল্প কয়েক দিনের যুদ্ধবিরতির পর পুনরায় গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছে ইসরায়েলি সেনারা। প্রতিদিন শত শত মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। নিহতদের বেশিরভাগ নারী ও শিশু। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এক ফিলিস্তিনি নারীর লেখা প্রকাশ করেছে। রুয়াইদা আমের নামের নারীর লেখায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের মধ্যে গাজাবাসীর দুর্ভোগ, যন্ত্রণা ও লড়াইয়ের কথা উঠে এসেছে। সেই লেখাটি সংক্ষিপ্ত আকারে বাংলা ট্রিবিউন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
আমি কয়েক দিন ধরে একটি উইল লিখবো বলে ভাবছি।
আমি কখনও ভাবিনি মৃত্যুকে এত কাছ থেকে অনুভব করবো। আগে মনে করতাম, মৃত্যু হঠাৎ আসে, আমরা টেরও পাই না। কিন্তু এই যুদ্ধে আমাদের সবকিছু ধীরে ধীরে টের পেতে বাধ্য করা হয়েছে।
আমরা মরার আগেও কষ্ট পাই—যেমন তোমার নিজের বাড়িতে বোমা আঘাত হানবে বলে অপেক্ষা করা।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হয়তো বাড়িটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ভয়টা তোমার মন থেকে যাচ্ছে না। এই ভয় আমার মনকে ক্ষয় করে দিয়েছে, এখন মনে হয় আর কিছুই সহ্য করতে পারবো না।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এত কাছে চলে আসা আমি এখনও মেনে নিতে পারছি না। নেতজারিম এলাকা থেকে ট্যাংক ঢোকার মুহূর্তটা এখনও মনে আছে—আমি হতবাক হয়ে বন্ধুদের মেসেজ লিখেছিলাম, ‘ওরা গাজায় কীভাবে ঢুকলো? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?!’
আমি অপেক্ষা করছিলাম, ওরা গাজা থেকে সরে যাবে, গাজা আবার মুক্ত হবে, যেমন আমরা চিনতাম গাজাকে। এখন ওরা আমার খুব কাছেই আছে—খান ইউনিসের পূর্বে ও রাফাহর উত্তরে আল-ফুখারিতে। এটা সেই জায়গা যেখানে খান ইউনিস শেষ হয়ে রাফাহ শুরু হয়।
ওরা এত কাছেই আছে যে আমরা প্রতি মুহূর্তে ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ শুনছি, সেই অন্তহীন আওয়াজ সহ্য করছি।
এই যুদ্ধ সম্পূর্ণ আলাদা, আগে যা দেখেছি তার চেয়ে ভিন্ন।
আমার কথা মনে রেখো
শহীদদের ‘অজ্ঞাত পরিচয়’ বলে উল্লেখ করা বা গণকবরে রাখা দেখে এই চিন্তা আমার মাথায় ঢুকে গেছে। তাদের কেউ কেউ তো শুধু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যাদের চিহ্নিতই করা যায়নি।
আমার কাফনের ওপর কি শুধু লেখা থাকবে, ‘এক তরুণী, কালো/নীল ব্লাউজ পরা?’
আমি কি শুধু একটি সংখ্যা হয়ে ‘অজ্ঞাত পরিচয়’ হিসেবে মরবো?
আমি চাই, আমার আশপাশের সবাই আমার কথা মনে রাখুক। আমি কোনও সংখ্যা নই।
আমি সেই মেয়ে যে গাজায় চরম অবরোধের মধ্যেও উচ্চবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বাবাকে সাহায্য করতে চাকরি খুঁজেছি—যিনি অবরোধে ক্লান্ত হয়ে একের পর এক কাজ হারিয়েছেন।
আমি পরিবারের বড় মেয়ে, বাবাকে সাহায্য করতে চেয়েছি, আমাদের জন্য একটা ভালো বাড়ি চেয়েছি।
একটু অপেক্ষা করুন...আমি কিছুই ভুলতে চাই না।
আমি শরণার্থী। আমার দাদা-দাদি ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি দখলদারদের হাতে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে এসেছিলেন।
আমি সেই শিবিরেই জন্মগ্রহণ করি, কিন্তু ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সেখানেও আমাদের শান্তিতে থাকতে দেয়নি।
২০০০ সালে আমাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, দুই বছর আমরা আশ্রয়হীন ছিলাম। একের পর এক জরাজীর্ণ বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছি, শেষে ২০০৩ সালে ইউএনআরডব্লিউএ আমাদের আল-ফুখারিতে একটি বাড়ি দেয়।
সেই সুন্দর এলাকা, সবুজ জমি—যেখানে আমরা ‘ইউরোপিয়ান হাউজিং’ নামক পাড়ায় বাসা বানিয়েছিলাম।
বাড়িটি ছোট ছিল, পাঁচ সদস্যের পরিবারের জন্য যথেষ্ট নয়। ২০১৫ সাল থেকে আমি কাজ করে বাবাকে সাহায্য করেছি, বাড়িটাকে বাসযোগ্য করে তুলেছি।
ঠিক যুদ্ধ শুরুর তিন মাস আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে, আমরা শেষ পর্যন্ত বাড়িটা পূর্ণাঙ্গভাবে গুছিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম।
দৌড়াতে দৌড়াতে ঘুম ভাঙে আমার
যুদ্ধ শুরুর আগেই আমি অবরোধ ও গাজার কঠিন জীবনযাত্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর যুদ্ধ এসে আমাকে সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ করে দিলো।
আমরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছি—ক্ষুধা, পিপাসা, পাগলামি থেকে বাঁচার লড়াই।
আমি চারটি বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছি, প্রতিটিই ইসরায়েলি বোমার আঘাতের কাছাকাছি। নিরাপদ কোনও জায়গা নেই।
যুদ্ধের সময় আমি কাঁদিনি। শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে।
আমি ১০ বছর সাংবাদিক ও শিক্ষিকা হিসেবে কাজ করেছি। আমার প্রিয় ছাত্ররা, সহকর্মীদের সঙ্গে সুন্দর স্মৃতি আছে।
গাজায় জীবন কখনোই সহজ ছিল না, কিন্তু আমরা এটাকে ভালোবাসি—আমরা অন্য কোনও বাড়িকে ভালোবাসতে পারি না।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমার আশপাশের সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। অনেক পরিবার এখনও এখানে আছে, তারা স্থানান্তর হতে চায় না—কারণ তা শারীরিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্লান্তিকর।
আমার প্রথম স্থানান্তরের স্মৃতি ২০০০ সালের, যখন আমার বয়স আট বছর। ইসরায়েলি বুলডোজার খান ইউনিস ক্যাম্পে ঢুকে আমার চাচা ও দাদার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
ঈদের আগের রাতে আমাদের বাড়িও ধ্বংস করা হয়। ঈদের দিন আমরা ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন জামা পরে ঈদ উদযাপন করেছিলাম।
আমি জানি না, এই নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাত থেকে বিশ্ব যদি আমাদের বাঁচাতে না আসে, তাহলে ভবিষ্যৎ কী হবে।
আমি জানি না, আমার হৃদয় আর কত এই অবিরাম আওয়াজ সহ্য করতে পারবে।
শুধু এইটুকু চাই—তোমরা আমার গল্প ভুলে যেও না। আমি কোনও সংখ্যা নই।