ই-কমার্সে প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের বিবর্ণ ঈদ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ জুলাই,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:০৭ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসা শুরু করেছিলেন ফয়সাল। আমদানি-রফতানির ব্যবসা শুরু করলেও এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে প্রায় ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন ই-কমার্সভিত্তিক দুটি প্রতিষ্ঠানে। মাস তিনেকের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ লাভের আশা ছিল। কিন্তু পোড়া কপাল, আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ ও কিউকম নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের অফারের ফাঁদে মোটরসাইকেল কিনতে গিয়ে এখন পুরো মূলধনই হারানোর পথে। ফয়সাল জানান, ই-অরেঞ্জে তার ২৬ লাখ টাকার মোটরসাইকেল ও কিউকমে ২২ লাখ টাকার মোটরসাইকেল অর্ডার দেওয়া ছিল। এক বছর পেরিয়ে গেছে একটি টাকাও তিনি ফেরত পাননি। কিউকমের টাকাটা ফেরত পাওয়া নিয়ে তিনি আশাবাদী হলেও ই-অরেঞ্জে বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন।
শুধু ফয়সাল নন, ফয়সালের মতো এরকম হাজার হাজার তরুণ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে এখন পথে পথে ঘুরছেন। নিজের কাছে থাকা মূলধনের পাশাপাশি বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার করে অর্থ এনে বিনিয়োগ করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু এখন টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না, আবার পাওনাদার স্বজনদের জন্য বাড়িতেও যেতে পারছেন না। অনেকটা পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের। আনন্দের ঈদ তাদের কাছে বিবর্ণ হয়ে এসেছে আবারও।
দিনাজপুরের সুইহারী এলাকার বাসিন্দা রবিউল বন্ধু ও স্বজনদের কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা এনে একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছিলেন। তার টার্গেট ছিল অফারের মাধ্যমে অর্ধেক টাকায় মোটরসাইকেল কিনে মূল দামে বিক্রি করবেন। কিন্তু ই-অরেঞ্জ ও ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করা সেই টাকা কবে ফেরত পাবেন তার কোনও আশা নেই। বন্ধু-স্বজনদের কাছ থেকে অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। রবিউল বলেন, ‘ভাই, গত রমজানের ঈদেও বাড়িতে যেতে পারি নাই, এই কোরবানির ঈদেও বাড়ি যাওয়া হলো না। বাড়িতে যাব কোন মুখ নিয়ে। বাড়িতে গেলেই তো পাওনাদাররা টাকার জন্য আসবে। টাকা তো ফেরত পাই নাই। ওদের দিব কোত্থেকে?’
অফারের নামে অত্যধিক কম দামে পণ্য দেওয়ার ফাঁদ তৈরি করে বাংলাদেশের বেশিরভাগ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সম্ভাবনাময় এই খাতে প্রতারণা ও বিশৃঙ্খলা শুরু হওয়ার পর গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এসময় প্রতারিত গ্রাহকদের অভিযোগের ভিত্তিতে ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে নামিদামি প্রতিষ্ঠানসহ অনেক ই-কমার্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর থেকে বিনিয়োগ বা পণ্যের অর্ডার দেওয়া অর্থ ফেরত পেতে পথে পথে ঘুরতে হচ্ছে হাজার হাজার গ্রাহককে।
পেমেন্ট গেটওয়েতে থাকা টাকা ফেরত পাচ্ছে গ্রাহকরা
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে পণ্য কেনাবেচা নিয়ে প্রতারণার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য পরিশোধের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফলে যেসব গ্রাহকের অর্থ বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে ছিল তারাই সেই টাকা ফেরত পাচ্ছেন, যারা পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার নামে সরাসরি অর্থ নিয়েছে তাদের অর্থ ফেরতের বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ধারাবাহিক অভিযানের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ২১৪ কোটি টাকা বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে এসব টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
গত বছরের ৩ অক্টোবর রাজধানীর পল্টন থানায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৌরভ দে। মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, তাদের মোট ১৬ জনের তিন কোটি ৩০ লাখ টাকার অর্ডার নিয়েও কিউকম যথাসময়ে পণ্য ডেলিভারি দেয়নি। ওই মামলায় কিউকমের প্রধান নির্বাহী রিপন মিয়াকে গ্রেফতারও করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
যোগাযোগ করা হলে সৌরভ দে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তাদের ১৬ জনের মধ্যে কেউ কেউ টাকা ফেরত পেয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজে এখনও এক টাকাও ফেরত পাননি। সৌরভ দে বলছেন, যাদের অর্ডারের টাকাটা পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে হয়েছে তারা টাকা ফেরত পেয়েছে। তিনি নিজেসহ আরও কয়েকজন সরাসরি কিউকমের একাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করেছিলেন। এজন্য তাদের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তা জানান, বেশিরভাগ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব, মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে রাখা হয়েছে। ফলে তারা যে একাউন্ট থেকে টাকা তুলে গ্রাহকদের ফেরত দেবেন তারও কোনও উপায় নেই।
ই-কমার্সের প্রতারণা ও অন্যান্য অভিযোগের ভিত্তিতে গত এক বছরে শতাধিক মামলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন থানায়। এসব মামলার বেশিরভাগই তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিভিন্ন শাখা। এর মধ্যে ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম শাখা মোট ৭টি মামলার তদন্ত করছে। এই শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর জানান, আমরা একটি মামলায় চার্জশিট দিয়েছি। আরও সাতটি মামলা তদন্তাধীন। আমরা মূলত অর্থ পাচারের বিষয়টি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহকেরা কিভাবে টাকা ফেরত পাবেন এটি সরকারের সিদ্ধান্ত। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। পেমেন্ট গেটওয়েতে থাকা টাকা গ্রাহকরা ফেরত পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা টাকাগুলো কোথায় স্থানান্তর হয়েছে তা খুঁজে বের করতে পারলে তা জব্দ করে আদালতের মাধ্যমে গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া যেতে পারে। তবে সেটিও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।’
উৎসঃ বাংলা ট্রিবিউন