মা-বাবার স্বপ্ন পূরণের আগেই না ফেরার দেশে ওরা ১১ জন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩০ জুলাই,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:০৮ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
বয়সে তারা তরুণ, কেউ এসএসসি কেউবা এইচএসসি পরীক্ষার্থী। সবার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরিবারের হাল ধরবে। তাদের নিয়ে মা-বাবার মনে ছিল হাজারো স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণের আগেই তারা ১১ জন না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
মিরসরাইয়ে শুক্রবার ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে সাত শিক্ষার্থীসহ ১১ জনের মৃত্যুতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী আমানবাজারের চলছে শোকের মাতম। বাড়িতে বাড়িতে চলছে আহাজারি। এমন ঘটনায় পুরো এলাকা জুড়ে যেন নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। এই গ্রামের মানুষ এখন শোকে স্তব্ধ। এলাকার লোকজন মেনে নিতে পারছেন না মেধাবী তরুণদের এমন মৃত্যু।
শনিবার হাটহাজারীর খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত জানাজায় মানুষের ঢল নামে। এলাকার একসঙ্গে এতোগুলো তরুণের চলে যাওয়া এলাকাবাসী যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না।
এক বাড়িতে ভীড়ের মাঝে দেখা গেল মধ্যবয়সী ব্যক্তির আহাজারি। তাকে সান্ত্বনা দেবে কে, স্বজনদের কান্নাও থামছে না। জানা গেল, তিনি দুর্ঘটনায় নিহতদের একজন জিয়াবুল হক সজীবের বাবা মোঃ হামিদ।
কাঁদতে কাঁদতেই বলে ওঠেন, ‘ছেলে বলেছিল বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। একটু একটু করে সেই স্বপ্ন পূরণও করছিল। এখন সে নেই, আমাদের কী হবে? বাবা সজীব, তোকে ছাড়া কিভাবে বাঁচব!’
হামিদ একটি মুদি দোকানের কর্মচারী। কোনোমতে সংসার চলে। একদিন ছেলে সব দুঃখ ঘোচাবে-সজীবকে ঘিরে এমন স্বপ্নই দেখেছিলেন বাবা। ছেলেও সেই পথে এগোচ্ছিলেন। যদিও টাকার অভাবে ২০১৮ সালেই থেমে যায় তার উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। কিন্তু থেমে যাননি সজীব।
খন্দকিয়া গ্রামের যুগীর হাট এলাকায় কলেজ শিক্ষার্থী জিয়াউল হকের বাড়িতে বিলাপ করছেন মা শাহনাজ আক্তার। ওই বাড়ির পাশে নিহত ইকবাল হোসেনের নানার বাড়ি। মায়ের সঙ্গে এখানেই কেটেছিল শৈশব-কৈশোরকাল। সে কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। সেখানেও ভিড় করছেন মানুষ।
এর প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে নিহত ওয়াহিদুল আলমের বাড়ি। তিনি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা করতেন সেই কোচিং সেন্টারে। তার বাবা জানে আলম কান্না করার শক্তি হারিয়েছেন।
খন্দকিয়া গ্রামের আবদুল লতিফ মাস্টারের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। ওমরগণি এমইএস কলেজে গণিত দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জিয়াউল কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। কিছুক্ষণ পর পর নিজের বুক চাপড়াচ্ছেন মা শাহনাজ আক্তার। বলছেন, ‘আমার মাস্টার সজীব কই?’ বাবা আবদুল হামিদ সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ।
শিক্ষক জিয়াউল হক সজীবের স্বজনরা জানায়, দুই দিন আগে এসএসসি ও এইচএসসি বিদায়ী পরীক্ষার্থীদের নিয়ে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝর্ণায় প্রাকৃতিক নৈসর্গ উপভোগ করার পরিকল্পনা করা হয়। নিহত তিন শিক্ষক যুগীরহাট কলেজে রোডের শেখ মার্কেটে আর এন্ড জে প্রাইভেট কেয়ার নামে একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতেন। নিহত শিক্ষার্থী সকলে ওই কোচিং সেন্টারের ছাত্র।
শুক্রবার ভোর ৬টায় তারা মাইক্রোবাস যোগে খৈয়াছড়া ঝরনার উদ্দেশে রওনা করেন। ভ্রমণ শেষে দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে নিজেদের গন্তব্যে রওনা হন তারা। ফিরতি পথে মিরসরাইয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম রেললাইনে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর প্রভাতী ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ হয়। এসময় ট্রেন মাইক্রোবাসটিকে ঠেলে এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে যায়।
সজীবের বাবা মোঃ হামিদ বলেন, আমি মুদির দোকানে চাকরি করি। পড়ালেখা করার সুযোগ হয়নি। আমার সজিব ওমরগণি এমইএস কলেজে গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষ শেষ করলেও টাকার অভাবে ছেলেকে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করাতে পারিনি। এরপর থেকে টিউশন ও ব্যাচ পড়িয়ে সংসারে সাহায্য করত সে। তিন মাস আগে তিনজন মিলে ৫০ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে আমানবাজারে আরএনজে কোচিং সেন্টার চালু করেছিল। কিন্তু মাঝপথেই থেমে গেল সব লড়াই-সংগ্রাম।
তিনি বলেন, তিনজন মিলে ৫০ হাজার টাকা কিস্তি নিয়ে কোচিং সেন্টারটি চালু করেছিল। দুই মাসের ১০ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করেছে। ভবন মালিকের কাছে ২৫ হাজার টাকা জমা রয়েছে। টাকার অভাবে পড়ালেখা করাতে পারিনি। সে মেধাবী ছিল, এলাকায় টিউশন ও ব্যাচ পড়াত।
এদিকে মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরুর বাড়িতে আরেক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। নিরুর স্ত্রী ও মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ ছিলে গগনবিদারী। নিরুর সাত বছর বয়সী একটি শিশু কন্যা রয়েছে। তার নাম নওরীন তাবাসসুম রুহি। বয়স অল্প হলেও পড়াশোনায় আগ্রহ থাকায় বাবা তাকে খন্দকিয়া সমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন।
রুহীর কাছে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলেন, বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। লাশ এখন থানায়। এই কথা বলে চলে যায় ঘরে। গতকাল দুপুরে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা দেখে মাইক্রোবাসে করে ফেরার পথে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যান হাটহাজারীর ১১ তরুণ।
তারা হলেন শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাসান (১৯), মোসহাব আহমেদ (১৬), মোস্তফা মাসুদ রাকিব (১৯), ইকবাল হোসেন মারুফ (১৯), মাহিন (১৭), আয়াতুল ইসলাম (১৮), সাগর (১৮), শিক্ষক জিয়াউল হক সজীব (২২), ওয়াহিদুল আলম জিসান (২৩), রেদওয়ান চৌধুরী (২২) ও মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরু (২৬)।