‘আমার মা মাটির নিচে ঘুমাচ্ছে, রাতে আসবে’ ছেলে নূর মাহিম
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ জুলাই,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:২৮ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ছবি : সংগৃহীত
আমার মা অফিস থেকে আসবে। আমার মা মাটির নিচে ঘুমাচ্ছে, রাতে আসবে। মায়ের কাপড় রেখে দিয়েছি ড্রয়ারে। হারানো মাকে নিয়ে নতুন শেখা ভাষায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের কথা বলে চলছে সাড়ে চার বছরের নূর মাহিম। তার মা রহিমা খাতুন প্রিয়া গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাইজপাড়া এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হন। রহিমা খাতুন প্রিয়াকে স্থানীয়রা মিম নামে চিনত।
এ ঘটনায় মোট পাঁচজন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন আহত হন। নিহত একমাত্র রহিমা খাতুন প্রিয়া শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের বালিয়াপাড়া গ্রামের শুভ হাসানের স্ত্রী। সে দুর্ঘটনা কবলিত গার্মেন্টস শ্রমিকবাহী বাসের যাত্রী ছিলেন। বাসটি শ্রীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের টেপিরবাড়ি এলাকার জামান ফ্যাশন লিমিটেডের শ্রমিক বহন করে কারখানায় নিয়ে যাচ্ছিল।
বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকজন ছিল প্রিয়ার একান্ত আপন :
প্রিয়ার স্বামী শুভ হাসান বলেন, আট বছর আগে প্রিয়াকে তার মামাবাড়ি নারায়ণগঞ্জ থেকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। প্রিয়ার পরিবারের কেউ জানতেন না তিনি শুভকে বিয়ে করছেন। বিয়ের খবর শোনার পর এই আট বছরে তার স্বজনেরা কেউ তাকে একদিন দেখতেও আসেনি। শ্বশুর-শাশুড়ি ও বাড়ির লোকদেরকে একান্ত আপন করে নিয়েছিল। গত রোববার (২৪ জুলাই) দুর্ঘটনায় প্রিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে তার মা ওই দিনই এসেছিলেন তাকে দেখতে।
ছেলেটার ভবিষ্যতের আগেই সে চলে গেল :
আমার ছেলেটার একটা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সে চাকরি নিয়েছিল। ছেলেটার ভবিষ্যতের আগেই সে চলে গেল। সংসারটা চালাত সেই-ই। আমার সংসার অনেক কষ্টে চলত। আমার চাকরি ছিল না। সেই তখন চাকরি করত। চাকরিতে গিয়ে সে ফিরে আসবে না এমন জানলে তাকে চাকরি করতে দিতাম না।
তুমি যেদিন আসবা সেদিন আমাকে খুঁজে পাবে না :
গত তিন মাস আগে স্ত্রী প্রিয়ার সঙ্গে সামান্য অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হন স্বামী শুভ হাসান। কিন্তু স্ত্রী প্রিয়ার সঙ্গে প্রতিদিন বেশ কয়েকবার মুঠোফোন, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে কথা হতো। শনিবার (২৩ জুলাই) রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রিয়ার সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। মান-অভিমানের নানা কথার ফাঁকে যে কথাটি বলে প্রিয়া ফোন রেখে দিয়েছিল তা এখন আমাকে বেদনা দেয়। যদিও হাসি-আনন্দের মধ্যে কথা হচ্ছিল সেটি ছিল ‘তুমি যেদিন আসবা সেদিন আমাকে খুঁজে পাবে না।’ সত্যিই আমি কুমিল্লা থেকে এসে তাকে আর পাইনি। তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমাকে আমার কর্মস্থল কুমিল্লা থেকে আসতে হয়েছে। সেই কথাটি এখন আমার জীবেন স্মৃতি হয়ে গেছে। আমাদের দুজনের মধ্যে অনেক মিল ছিল। দাম্পত্য জীবনে আমাদের সাড়ে চার বছরের একটি মাত্র ছেলে। ছেলেটি এখন মা হারা।
মা আমার পুতটারে (ছেলে) দেইখ্যা রাইখেন:
প্রিয়ার শাশুড়ি শামসুন্নাহার বলেন, বউ হিসেবে প্রিয়া অনেক ভালো ছিল। শ্বশুর-শাশুড়িসহ সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত। মারা যাওয়ার আগের রাতে আমাকে শেষ কথা বলে গিয়েছিল, মা আমার ছেলেটারে দেখে রাইখেন। আমি ঘুমাইতে যাই। সকালে সে কারখানায় যাওয়ার সময় আমি ঘুমিয়েছিলাম।
সবাইকে নিয়ে গেছে প্রিয়া পড়ে আছে :
প্রিয়ার শ্বশুর নুরুল ইসলাম বলেন, সে আমার ছেলের বউ না, মেয়ে বললেই চলে। সে যা করে গেছে তা ভোলার মতো না। সে কারখানায় গেলে আমাকে বলে যেত, আব্বা আমি যাইতেছি। কিন্তু আমি একটু অসুস্থ থাকায় সেদিন ফজরের নামাজের পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই আমাকে আর ডাকেনি। সে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর শুনি ট্রেনের সঙ্গে বাসের দুর্ঘটনা ঘটেছে। খবর নিয়ে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি সবাইকে নিয়ে গেছে। আমার প্রিয়া পড়ে আছে। সেখান থেকে তার মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসি।
প্রতিবেশীরা যা বললেন :
প্রিয়ার প্রতিবেশী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, মেয়েটি অনেক ভালো ছিল। আমাদের বাড়িতে আসত, আড্ডা দিত। অফিস ছুটি থাকলে আমাদের বাড়িতে এসে গল্প-সল্প করত। অনেক ভালো ব্যবহার ছিল। তার মৃত্যুতে আমরা এলাকাবাসী শোকাহত। তার মতো এমন ভালো মেয়ে ও বউ এ যুগে পাওয়া যায় না।