গাছির অভাবে অযত্নে পড়ে আছে শত শত খেজুর গাছ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২১ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১০:১২ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
গোয়ালন্দ উপজেলায় গাছির অভাবে ঐতিহ্যবাহী শত শত খেজুর গাছ দীর্ঘদিন ধরে অনাবাদী পড়ে আছে। এতে করে এ অঞ্চল থেকে দিন দিন খেজুর রস ও পাটালী গুড় হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও উপজেলার কোন কোন এলাকায় খেজুর রস দেখা গেছে। সাধারণত প্রতিবছর হেমন্তের শেষ দিকে ও শীতের শুরুতেই গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ত খেজুর গাছ নিয়ে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অসংখ্যা খেজুর গাছ অনাবাদী পড়ে থাকলেও কোথাও গাছির সারা পাওয়া যাচ্ছে না।
কাঁচা খেজুর রস আর পাটালী গুড় চেনেন না এমন লোক হয়ত বাংলাদেশে খুব কমই। আজও শহরের মানুষ শীতকালে খেজুর রসের পিঠা-পুলির স্বাধ উপভোগ করতে গ্রামে আসেন। গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে জমির আইলে রাস্তার পাশে বাড়ির আঙ্গিনায় দুই-একটি খেজুর গাছের দেখা মিলবেই। শীতকালে বিকাল হলে গাছের মাথায় ঠক ঠক শব্দ আর ভোর হলেই গাছিদের খেজুর রস নামানোর হাক ডাকে ঘুম ভাঙ্গত গোয়ালন্দ এলাকার মানুষের। মা-চাচীরা মেয়ে-জামাই দাওয়াত করে আনত খেজুর রসের পায়েস আর পিঠা-পুলি খাওয়াতে।
প্রতিবছর কার্তিক-অগ্রহায়ন মাস থেকে শুরু হয়ে ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত চলে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ। উপজেলার হাউলি কেউটিল গ্রামের জুলমত গাছি (জুল্যা গাছি), নলডুবির জুরেন গাছি, উজানচর গ্রামের লোকমান গাছি সহ হাজারো গাছিরা ব্যস্ত থাকত খেজুর রস সংগ্রহের কাজে। প্রত্যেক বাড়ির খেজুর গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হতো মাটির হাড়ি। ভোর বেলায় হাড়িতে জমে থাকা রস নামানো হতো। গাছের মালিক ও গাছিরা আধাআধি ভাগ করে নিতেন খেজুর রস। তাতে প্রত্যেক বাড়িতেই দুই-তিন হাড়ি পর্যন্ত রস ভাগে পেতেন।
ভোরের আলো ফুটতেই প্রায় বাড়িতে পরাঙ্গী ধানের মুড়ির সাথে কাঁচা রস খাওয়ার ধুম পড়ত। তাছাড়া পাটালি গুড় মুড়ির তো মজাই আলাদা। খেজুর গাছ থেকে মাটির হাঁড়িতে সংগ্রহ করা খেজুর রস জ্বালিয়ে পাটালী তৈরি করা হয়। তাছাড়া রস পাকিয়ে মাটির পাত্রে রেখে তৈরি করা হতো ঝোলা গুড় বা নলেন গুড়। সারা বছরই গাছিদের বাড়িতে পাটালী ও ঝোলা গুড় পাওয়া যেত। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুর গাছ ও খেজুর রস। এক সময় বাড়ির আনাচে কানাচে রাস্তার পাশে খেজুর চারা রোপন করলেও এখন আর তা চোখে পড়ে না।
এক সময়ে জুলমত গাছির খুব নাম-ডাক ছিল। বংশ পরিচয়ে তিনি মল্লিক হলেও গাছি নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। বছর ত্রিশ আগে তিনি মৃত্যু বরণ করলেও তার বাড়িটি এখন গাছি বাড়ি নামে পরিচিত। তার ছেলে সন্তানরা এখনো গাছির পরিচয়েই বেশি পরিচিত। তার ছেলে আব্দুল গাছি (৭৫) জানান, মানুষ এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে চায় না। একটু পরিশ্রম করলেই প্রতি সিজনে এখনো খেজুর রস সংগ্রহ করে ভালো উপার্জন করা সম্ভব।
বাজারে আগের মতো আসল খেজুর পাটালী পাওয়া যায় না। চড়াদামে পাওয়া যায় চিনির সাথে কেমিক্যাল মিশ্রিত নকল খেজুর গুর পাটালী। বিভিন্ন এলাকার গাছিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ইট ভাটায় জ্বালানির কাজে খেজুর গাছ ব্যবহার করায় দিন দিন খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া খেজুর রস খেয়ে নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়, জ্বলানির অভাব সহ বিভিন্ন কারণে গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহে আগ্রহ হারাচ্ছে। এলাবাসীর ধারণা এখনো যারা এ পেশায় আছেন তারাও যদি এই রস সংগ্রহ ছেড়ে দেন, তাহলে এই এলাকার মানুষ এক সময় হয়ত ঐতিহ্যবাহী খেজুর রস ও গুড়ের কথা ভুলেই যাবে।