যাবজ্জীবন জেল খাটার চুক্তি দেড় লাখ টাকায় মিনুর সাথে কুলসুমীর
যাবজ্জীবন জেল খাটার চুক্তি দেড় লাখ টাকায় মিনুর সাথে কুলসুমীর
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ আগস্ট,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:০৪ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
চট্টগ্রামে কোহিনুর আক্তার নামে এক গৃহকর্মী হত্যা মামলায় কুলসুমী আক্তার কুলসুমীকে (৩৫) যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন আদালত। কিন্তু কুলসুমী কৌশলে নিজের বদলে মিনু (৩৪) নামে এক নারীকে আদালতে আত্মসমর্পণ করানোর মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করেন। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেন মর্জিনা বেগম (৩৫), মো. নুর আলম কাওয়াল (৪৮) এবং মো. শাহাদাত হোসেন (৪২) নামে তিনজন। মূলত মর্জিনার মধ্যস্থতায় দেড় লাখ টাকার চুক্তির বিনিময়ে মিনুকে কুলসুমীর পরিবর্তে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন নুর আলম ও শাহাদাত।
রোববার (১ আগস্ট) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফী উদ্দীনের আদালতে কুলসুমীর ১৬৪ ধারায় প্রদান করা জবানবন্দিতে এ তথ্য ওঠে আসে।
কুলসুমীর জবানবন্দি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘২০০৬ সালের একটি হত্যা মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৭ সালে কুলসুমী আক্তার কুলসুমীকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন আদালত। কিন্তু কুলসুমী কয়েকজনের সহযোগিতায় তার বদলে ২০১৮ সালে মিনুকে আত্মসমর্পণ করানোর মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করেন। সেই থেকে নিরপরাধ মিনু কারাবাস করতে থাকেন। ২০২১ সালে এসে বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন অ্যাডভোকেট গোলাম মওলা মুরাদ নামে এক আইনজীবী। তিন বছরেরও বেশি সময় বিনা দোষে কারাবাসের পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে গত ১৬ জুন মুক্ত হন মিনু আক্তার। তবে মুক্ত হওয়ার কয়েকদিন পর ২৮ জুন দিবাগত রাতে বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন মিনু।’
ওসি আরও বলেন, ‘মিনু আক্তার মুক্ত হওয়ার পর কুলসুমীর গ্রেফতারি পরোয়ানা কোতোয়ালি থানায় আসে। এরপর কুলসুমীকে গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করতে থাকে কোতোয়ালি থানা। একপর্যায়ে ২৯ জুলাই ভোরে কুলসুমী ও তার সহযোগী মর্জিনাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একই দিন তাদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় নতুন একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত তাদের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।’
তিনি আরও বলেন ‘রিমান্ডে থাকাকালে তারা তাদের দুই সহযোগী মো. নুর আলম কাওয়াল ও মো. শাহাদাত হোসেনের নাম প্রকাশ করেন। অভিযান চালিয়ে ৩০ জুলাই দিবাগত রাতে নুর আলমকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন (৩১ জুলাই) বিকেলে শাহাদাতকেও গ্রেফতার করা হয়। এদিকে রিমান্ড শেষে কুলসুমীকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি আদালতে ঘটনার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।’
আদালত ও পুলিশ সূত্রে কুলসুমীর প্রদান করা জবানবন্দির বিষয়ে জানা গেছে, হত্যা মামলায় কুলসুমী এক বছর চার মাস কারাবাস শেষে জামিনে বের হয়ে দীর্ঘ ১০ বছর আদালতে হাজিরা দেয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর উক্ত মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আদেশ হওয়ায় আসামি কুলসুমী বিষয়টি আসামি মর্জিনার সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সাজা থেকে বাঁচার জন্য মর্জিনাকে সহযোগিতা করতে বলেন। মর্জিনা বেগম কুলসুমীকে সাজা থেকে বাঁচানোর জন্য বিষয়টি নিয়ে মো. শাহাদাতের সঙ্গে আলোচনা করেন। শাহাদাত হোসেন বিষয়টি নিয়ে নুর আলম কাওয়ালের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরপর নুর আলম ও শাহাদাত হোসেন মিলে আলোচনা করে দেড় লাখ টাকায় কুলসুমী পরিবর্তে আরেকজনকে জেলখানায় পাঠাবে বলে মর্জিনাকে জানায়।
এদিকে চুক্তির বিষয়টি মর্জিনা কুলসুমীকে জানালে তিনি এক কথায় রাজি হয়ে যান এবং দেড় লাখ টাকা প্রদান করবে বলে জানান। অন্যদিকে মর্জিনা টাকার লোভ এবং এক মাসের মধ্যে জামিন করে দেবে বলে মিনুর সঙ্গে কথা বলেন। কথা মোতাবেক ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনুকে কুলসুমী সাজিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ওই দিনই আদালত কুলসুমীকে ডাক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিনু হাজতে ঢুকে যান।
আবার মিনু জেলখানায় যাওয়ার পর শাহাদাত ও নুর আলম মর্জিনা বেগমের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী দেড় লাখ টাকা দাবি করেন। কিন্তু কুলসুমী ও মর্জিনা চুক্তি অনুযায়ী টাকা না দিয়ে নগরের ইপিজেড এলাকায় আত্মগোপন করেন। অন্যদিকে টাকা না পেয়ে শাহাদাত ও নুর আলম ছিন্নমূল এলাকায় থাকা কুলসুমী ও মর্জিনা বেগমের দুটি প্লট জোরপূর্বক দখল করেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, নগরের কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জে একটি বাসায় ২০০৬ সালের মে মাসে মোবাইলে কথা বলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গৃহকর্মী কোহিনুর আক্তারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহ একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কোহিনুর আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেন পোশাককর্মী কুলসুম আক্তার কুলসুমী। এরপর থানায় অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়।
কিন্তু মামলার তদন্তে এটি হত্যাকাণ্ড বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হলে একই বছরের জুলাই মাসে কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু হয়। সেই মামলায় দুই বছর তদন্ত শেষে কোহিনুরকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এর মধ্যে এক বছর চার মাস জেল খেটে জামিনে মুক্তি পান কুলসুমী।
মামলার বিচার শেষে ২০১৭ সালের নভেম্বরে তৎকালীন অতিরিক্ত চতুর্থ মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম ওই হত্যা মামলায় আসামি কুলসুম আক্তার কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন। ওই সাজার পরোয়ানামূলে ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুম আক্তার কুলসুমীর বদলি হয়ে কারাগারে যান মিনু।
২০২১ সালে এসে অ্যাডভোকেট গোলাম মওলা মুরাদ নামে এক আইনজীবী মিনুর বিনা দোষে কারাবাসের বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। আর এতে করে নানা আইনি প্রক্রিয়া শেষে ১৬ জুন মিনু কারাগার থেকে মুক্ত হন। তবে মুক্ত হওয়ার পর ২৮ জুন রাতে বায়েজিদ সংযোগ সড়কে তিনি দুর্ঘটনায় নিহত হন।
মিনুকে বিনা খরচে মুক্ত করা আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম মওলা মুরাদ বলেন, ‘মিনুর বিনা দোষে জেল খাটার বিষয়টি জেনে আইনগত প্রক্রিয়ায় মুক্ত করি। মানবিক কারণে এ কাজ করেছি। তবে তিন বছরের বেশি সময় কারাভোগ করে মিনু মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। বের হয়ে দেখেন তার বড় ছেলে নিখোঁজ। নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজতে বের হয়ে ২৮ জুন দিবাগত রাতে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন বলে পুলিশের বরাতে জেনেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি ভুলে মিনুর সব শেষ হয়ে গেল। খুব খুশি হবো, যদি মিনুর সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত হয় এবং তার নিহত হওয়ার পেছনে তাকে জেলে পাঠানোর চক্রটি জড়িত আছে কি-না সেটা দেখতে হবে। আশা করবো- মিনুর মতো পরিণতি যাতে কাউকে ভোগ করতে না হয়।’