avertisements 2

প্রাণঘাতী নকল মদের ভয়ংকর বাজার

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১:৫৫ এএম, ৫ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৪৭ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪

Text

ওয়্যারহাউস থেকে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে বৈধ মদ অবৈধ প্রক্রিয়ায় বের করে বার, রেস্তোরাঁ ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করে আসছিল। কয়েক মাস ধরে এ প্রক্রিয়ায় বৈধ মদ বাইরে পাচার এক অর্থে বন্ধ রয়েছে। আবার করোনা পরিস্থিতির কারণে বৈধ চ্যানেলে বিদেশ থেকে মদ আসা কিছুটা কমেছে; আবার বিশ্ববাজারে বেড়েছে মদের দামও। এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ে অনেকে বিদেশ থেকে দেশে আসার সময় লাগেজে করে কিছু মদ নিয়ে আসতেন। বিদেশি নাগরিক ছাড়া এখন বিদেশফেরতদের লাগেজে করে মদ আনার ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি চলছে। মূলত এই কয়েকটি কারণেই দেশে সম্প্রতি মদের সংকট তৈরি হয়েছে। এর সুযোগ নিয়েই অসাধু কারবারিরা নকল ও বিষাক্ত মদ তৈরি করছেন। রাজধানীতে এ রকম সিন্ডিকেটে অর্ধশতাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছেন। তারা বাসা-বাড়িতে তৈরি করছেন ভেজাল মদ। 'হোম সার্ভিসে'র মাধ্যমে সাইকেল, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ও প্রাইভেটকারে এসব প্রাণঘাতী মদ তারা ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।

অনুসন্ধানে ঢাকায় নকল মদের একাধিক দুষ্টচক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই চক্রের কাছে গোপনে স্পিরিট, নকল মদের লেবেল, বোতলের কর্ক সরবরাহ করছেন পুরান ঢাকার জনৈক মো. মনির। এ ছাড়া গুলশান, বনানী ও বারিধারার ওয়্যারহাউস থেকে অবৈধ পথে মদ বের করে এরই মধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন জনৈক কবীর গাজী। ভাটারার নূরেরচালা ও গাজীপুরে তার একাধিক বাড়ি রয়েছে। চার ভাগ্নেসহ একাধিক বিশ্বস্ত সহযোগীর মাধ্যমে অভিজাত এলাকায় তিনি দীর্ঘকাল ধরে মদ সরবরাহ করে আসছেন।

যে কারণে সংকট :ঢাকায় ৫টি বৈধ ওয়্যারহাউস থেকে লাইসেন্সধারী ব্যক্তিরা মদ নিতে পারেন। এই ৫টি ওয়্যারহাউস হলো- গুলশান-১-এর এসটিএল সাবের ট্রেডার্স, মহাখালীর এসকে কবীর এন্টারপ্রাইজ, টসবন, ন্যাশনাল ও ঢাকা ওয়্যারহাউস। বিদেশি পাসপোর্টধারী যে কেউ মাসে নির্দিষ্ট সংখ্যক বোতল মদ এসব ওয়্যারহাউস থেকে কিনতে পারেন সস্তা দামে। তবে বহু বছর ধরে ওয়্যারহাউস থেকে এই মদ অবৈধ চ্যানেলে বিভিন্ন বারে চলে আসত। ওয়্যারহাউস থেকে মদ কিনে গাড়িতে লুকিয়ে রেখে এই কবীরচক্র ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়। গুলশান-বনানী এলাকায় বহু বাসাবাড়িতে এভাবে মদ বিক্রি করা হতো। এমনকি গাড়িভর্তি মদ মাসের পর মাস কোনো কোনো বাড়িতে পার্কিংয়ের জায়গায় পড়ে থাকত। যখন প্রয়োজন হতো তখন ওই গাড়ি থেকে মদ বের করে বিক্রি করা হতো। কয়েক মাস ধরে ওয়্যারহাউস থেকে বাইরে মদ যাওয়ার চ্যানেল বন্ধ থাকায় দেখা দেয় সংকট।

প্রভাবশালী সিন্ডিকেট :দীর্ঘদিন ধরে বৈধ মদের অবৈধ কারবারে জড়িত এমন একজন জানান, ওয়্যারহাউস থেকে অবৈধভাবে মদ কেনা চক্রের অন্যতম হোতা কবীর গাজী। সঙ্গে তার ভাগ্নে ইমরান, রানা, রাজীব এবং আপন ভাই মাসুদ গাজী। তিনি মাসে কোটি কোটি টাকার মদ বিক্রি করেন। এর বাইরে আরেকটি চক্র ওয়্যারহাউসকেন্দ্রিক মদের কারবারে সংশ্নিষ্ট। এই চক্রে রয়েছেন জনৈক নকীব, মনোজ ও ফারুক। তারা টসবন ওয়্যারহাউস থেকে অবৈধ চ্যানেলে মদ কিনে বাইরে বিক্রি করেন। মদ নিয়ে চলমান সংকটের পর এই সিন্ডিকেটকে এখন খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

যেভাবে স্পিরিট সরবরাহ :জানা গেছে, ঢাকাকেন্দ্রিক অবৈধ মদের কারখানায় গোপনে স্পিরিট সরবরাহ করছেন পুরান ঢাকার জনৈক মো. মনির। কারও স্পিরিট দরকার হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর নিজেই গাড়িতে তা ক্রেতার কাছে ড্রামে করে পৌঁছে দেন। এক ড্রাম (২৭ লিটার) স্পিরিটের দাম রাখছেন ১০-১১ হাজার টাকা। অধিকাংশ চালান তিনি মিটফোর্ড এলাকায় হাতবদল করেছেন। ভাটারা এলাকার নকল মদের কারবারি নাসির আহমেদ রুহুলের কাছে গত দুই মাসে পাঁচ ড্রাম স্পিরিট বিক্রি করেন মনির। আর প্রতিবার নাসিরের বিশ্বস্ত কর্মচারী জাহাঙ্গীর এই চালান নিয়ে যান। একসময় ওয়্যারহাউসের সামান্য কর্মচারী ছিলেন নাসির। বৈধ মদ সংকটের সুযোগ নিয়ে তিনি দুই মাস আগে ভাটারা এলাকায় নকল মদের কারখানা করেছেন। এরই মধ্যে নাসির ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পাঁচ দিনের রিমান্ডে নাসির স্বীকার করেছেন, শুধু স্পিরিট নয়, দামি ব্র্যান্ডের মদের নকল স্টিকার প্রতি পিস ১৫-২০ টাকা ও বোতলের কর্ক প্রতিটি ৩০-৪০ টাকা দরে সরবরাহ করতেন তিনি। স্পিরিট সরবরাহকারী মনিরকে পুলিশ এখন খুঁজছে।

এক কারখানা থেকেই গেছে ২৩৩ বোতল :নাসিরের অবৈধ মদের কারখানার একটি রেজিস্ট্রার খাতা সমকালের হাতে এসেছে। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা হিসেবে প্রতিদিন কে কত বোতল কোন ব্র্যান্ডের মদ নিয়ে গেছেন, তার হিসাব ওই রেজিস্ট্রারে রয়েছে। ওই রেজিস্ট্রার দেখভাল করতেন নাসিরের ম্যানেজার আলামিন। সেখানে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত ২৩৩ বোতল নকল মদ তারা বিক্রি করেছেন। স্পিরিটের সঙ্গে পোড়া চিনি, মিনারেল ওয়াটার, রং মিশিয়ে এসব মদ তৈরি করা হয়েছিল। নাসিরের বেতনভোগী কর্মচারীরা এসব নকল মদ ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতেন। যারা নাসিরের সিন্ডিকেটে ছিলেন তাদের মধ্যে আছেন মনির, তাহের, রিয়াজ, মামুন, সফিক, আনোয়ার, তপু, মোক্তার, বাদশা, জাহাঙ্গীর, নাসির প্রমুখ। প্রতি ২৭ লিটার স্পিরিট দিয়ে কমপক্ষে ৫২ বোতল নকল মদ তৈরি করেন নাসির ও তার চক্র।

এক জায়গার মদপানেই এত মৃত্যু :গত শুক্রবার রাতে উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের 'ব্যাম্বু শট' নামের রেস্তোরাঁয় একটি পার্টিতে অংশ নেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, বাইরে থেকে নকল ও বিষাক্ত মদ কিনে ওই রেস্তোরাঁয় বসে পান করেন পাঁচ শিক্ষার্থী। মদ পান করার পর আরাফাত ও তার এক বান্ধবী মারা যান। এর মধ্যে ছাত্রীর বাবার অভিযোগ, তার মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। জানা গেছে, ভাটারার নাসিরের অবৈধ মদের কারখানা থেকে পাওয়া মদ খেয়েই ওই দুই শিক্ষার্থী মারা গেছেন। নাসিরের ম্যানেজারের কাছ থেকে পাওয়া রেজিস্ট্রারে রয়েছে- ২৯ জানুয়ারি দুই বোতল মদ মোহাম্মদপুরে আরাফাতের কাছে সরবরাহ করা হয়েছিল। আরাফাত ওই মদ নিয়ে উত্তরার ওই রেস্তোরাঁয় পার্টির আয়োজন করে। নকল মদের কারবারি নাসিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মনির ও রিয়াজের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে আলামিন ওই মদ আরাফাতের কাছে পৌঁছে দেন। দুই বোতল মদ ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছিল। ভাটারা থেকে উবারে চড়ে ওই মদ সরবরাহ করেন আলামিন। এ ছাড়া গত ১৮ জানুয়ারি ভাটারার বাসায় নকল মদ খেয়ে স্বর্ণালী বাগচী তন্বী ও তার দুই বন্ধু শরীফুল ইসলাম নাঈম ও সারোয়ার হোসেন অভি মারা যান। তারাও মারা যান জাহাঙ্গীরের কারখানার মদ পান করে।

এ ছাড়া গত সোমবার গাজীপুরের একটি রিসোর্টে পার্টির আয়োজন করেছিল ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ওই পার্টিতে অংশ নেওয়া তিনজন এরই মধ্যে বিষাক্ত মদ পান করে মারা গেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আরও অন্তত ১০ জন। একই উৎস থেকে যাওয়া মদ খেয়ে ওই পার্টিতে অংশগ্রহণকারীরা মারা যান।

পুলিশকে নির্দেশনা :গত এক মাসে নকল ও বিষাক্ত মদ খেয়ে অন্তত ৩৫ জন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। একের পর এক এমন মৃত্যুর খবরে উদ্বিগ্ন প্রশাসন। এরই মধ্যে নিজ নিজ এলাকায় ভেজাল মদের কারখানা শনাক্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে গতকাল বুধবার রাজধানীর ৫০টি থানার ওসি ও মাঠপর্যায়ের সব ইউনিটপ্রধানকে লিখিত নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) কৃষ্ণপদ রায় সমকালকে বলেন, আমাদের আশঙ্কা, ভাটারার মতো আরও নকল মদের কারখানা ঢাকায় থাকতে পারে। স্থানীয় বাসিন্দাসহ সবার সহযোগিতায় এ ধরনের কারখানা দ্রুত শনাক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বর্তমান চিত্র :নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মদ্যপানকারী সমকালকে জানান, আগে বিভিন্ন বার, ওয়্যারহাউস থেকে সহজেই মদের বোতল কেনা যেত। এখন দ্বিগুণ দাম দিয়েও মদ মিলছে না। তাই তারা অনেকেই পরিচিত ডিলার বা সরবরাহকারীর কাছ থেকে মদ নিচ্ছেন। কেউ সামাজিক যাগাযোগমাধ্যমের তথ্য পেয়ে মদ কিনছেন। তবে কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনার পর অনেকেই এসব জায়গা থেকে মদ আর কিনছেন না। কেউ কেউ দেশীয় মদের দিকে ঝুঁকছেন।

কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেন, বৈধভাবে দেশে মদ আনতে হলে ৪০০ শতাংশ শুল্ক্ক দিতে হয়। এ কারণে অনেকে অবৈধ পথ বেছে নেয়। নীতিনির্ধারকরা চান, মদের চাহিদা পূরণে বৈধ চ্যানেলই হোক একমাত্র উপায়। এতে এ খাতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।

বারের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈধ মদের সংকট নিরসনে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে নকল মদের কারবারিদের তৎপরতা বাড়তেই থাকবে। সে ক্ষেত্রে আরও অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলেও প্রাণহানি ঠেকানো মুশকিল হবে।

বাংলামটরের বার 'শ্যালের' চিফ ফিন্যান্স অফিসার তন্ময় কর্মকার বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিদেশি মদ আমদানিতে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে চাহিদার তুলনায় বিদেশি মদের সরবরাহও কম। এর সুযোগ কিছু অসাধু লোকজন নকল মদ তৈরি করে বাজারজাত করছে, যার পরিণতি হচ্ছে মারাত্মক।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য :মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার সমকালকে বলেন, যাদের আমরা বৈধভাবে মদ আমদানির লাইসেন্স দিয়েছি, তারা চাহিদা অনুযায়ী বিদেশ থেকে মদ আনার কথা। বৈধ লাইসেন্স থাকার পরও তারা কেন মদ আনছেন না- এটা বোধগম্য নয়। তাহলে কী অবৈধভাবে কেউ মদ আনার চেষ্টা করছে। বৈধ ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী মদ আনলে চলমান সংকটও থাকার কথা নয়। মদপানে যারা মারা গেছে, তারা কোথা থেকে মদ সংগ্রহ করেছিল সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ডিবির গুলশান বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের অনুসারীরা বাংলাদেশে থাকাতে মদ-বিয়ারের ব্যাপারে একমুখী সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব। যেহেতু মদের অধিকাংশ বাইরে থেকে আসে তাই অনেক সময় এর বাজারে সংকটের সুযোগে একটি প্রতারক চক্র নকল মদ বাজারে সরবরাহ করছে। তারা যে মদ ক্রেতাকে দিচ্ছেন সেটা কার্যত বিষ। মদের নামে এই বিষ খেয়েই প্রাণহানি ঘটছে। এই সিন্ডিকেটের সব সদস্যকে খুঁজে বের করা হবে।

গুলশান বিভাগের এডিসি গোলাম সাকলায়েন বলেন, মদপানে মৃত্যুর ঘটনা জানার পরই আমরা এর উৎস খুঁজতে থাকি। এই অনুসন্ধানেই অনেক অজানা তথ্য সামনে আসছে। স্বস্তির তথ্য হলো- একটি চক্রকে দ্রুত শনাক্ত করা গেছে। তা না হলে প্রাণহানির শঙ্কা আরও বাড়ত।

 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2