পাঁচ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী থেকে শতকোটি টাকার মালিক কাজী আনিছ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৭:১৪ পিএম, ১৬ নভেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ০৭:০৭ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
এক সময় পোশাক কারখানায় ৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করতেন কাজী আনিছুর রহমান। হঠাৎ করেই যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে শতকোটি টাকার মালিক হয়ে গিয়েছেন তিনি। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, আলাদিনের চেরাগ নয়; ক্যাসিনো কারবার, চাঁদাবাজিসহ নানাবিধ অবৈধ উৎস থেকে আয়ের মাধ্যমেই হঠাৎ ধনাঢ্য হয়ে উঠেছেন যুবলীগ নেতা কাজী আনিছুর রহমান।
গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুরের এক নিভৃত গ্রাম বাউলিয়া। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন কাজী আনিছুর রহমান। বাবা সশস্ত্র বাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেন ১৯৯২ সালে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনের উৎস ছিল বাবার পেনশন। তা দিয়েই কষ্ট করে চালিয়ে নিতে হতো তাদের সংসার। বোনদের বিয়েও হয় সে সময়। অভাবের তাড়নায় এক সময় কাজী আনিছ ঢাকায় চলে আসেন। চাকরি নেন একটি পোশাক কারখানায়। শুরুতে সেখানে তার বেতন ছিল ৫ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, কাজী আনিছের ভাগ্যে রূপকথার জাদুর কাঠির ছোঁয়া লাগে ২০১০ সালের পর। প্রভাবশালী এক নেতার স্নেহধন্য হয়ে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান তিনি। ক্যাসিনো কারবার, চাঁদাবাজিসহ নানাবিধ অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে এ অর্থের মালিক হয়েছেন তিনি।
গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে কাজী আনিছুর রহমানের নাম এলে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে গত বছরের ২৯ অক্টোবর জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ১২ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকার সম্পদের মালিকানার অভিযোগে তার নামে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।
মামলা দায়েরের পর কাজী আনিছের সম্পদের বিষয়ে বিশদ তদন্ত চালান দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্তে কাজী আনিসের প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। এরই মধ্যে তার গ্রামের বাড়ি বাউলিয়া ও মুকসুদপুরে প্রায় কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ২৫টি জমির দলিল জব্দ করা হয়েছে, যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকার বেশি।
জানা গিয়েছে, ২০০৫ সালের আগেও আনিছ মাত্র ৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে পোশাক কারখানায় চাকরি করেছেন। এর কয়েক বছরের মধ্যেই নিজ গ্রামে পুুকুর ভরাট করে দৃষ্টিনন্দন রাজকীয় বাড়ি নির্মাণ করান তিনি, যাতে ব্যয় হয়েছে অন্তত কয়েক কোটি টাকা।
বাড়িটির কিছু অংশ পৈত্রিক ভিটায় তৈরি করা হলেও তার বাবা নিজেই জানিয়েছেন, তার কাছে বাড়ি করার মতো কোনো টাকা-পয়সা নেই। তার ছেলে কাজী আনিছই বাবার নামে অগ্রণী ব্যাংকের মুকসুদপুর শাখায় টাকা পাঠাতেন। তার পাঠানো টাকা দিয়েই তৈরি করা হয়েছে বাড়িটি।
এছাড়া বাবার নামে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে মুকসুদপুরের দাসেরহাটে একটি পেট্রল পাম্প ক্রয় করেন কাজী আনিছ। পেট্রল পাম্পটি প্রথমে ফায়েক কাজীর নামে ক্রয় করা হয়েছিল। বছর দুয়েক পর ফায়েক কাজী আবার কাজী আনিছকে হেবা করে দেন। এ ব্যাপারে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে ফায়েক কাজী জানান, টাকা তো আনিছেরই ছিল, তাই তাকে হেবা দিয়েছি, দোষ কোথায়।
আনিস কেবল গ্রামের বাড়িতেই সম্পদ গড়ে তুলেছেন তা নয়। দুদকের অনুসন্ধানে ঢাকার কেরানীগঞ্জে তার ক্রয়কৃত জমির সাত-আটটি দলিলেরও হদিস পাওয়া যায়, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১২-১৩ কোটি টাকা। পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা এ দলিলগুলোও জব্দ করেন।
ধানমন্ডি ১০/এ-তে কয়েক কোটি টাকার ৪ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটসহ তিনটি গ্যারেজ রয়েছে কাজী আনিছের। ঢাকার ওয়ারীতে কয়েকটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন, যার রেজিস্ট্রেশন মূল্য থেকে প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। নিউ এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে তিনটি দোকান এবং সামনের অংশে ১ হাজার ৩০০ বর্গফুটের জায়গা ক্রয় করেছেন তিনি, যার বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা।
দুদকের তদন্তে আরো উঠে আসে, গুলশান উত্তর বাণিজ্যিক এলাকার ল্যান্ডভিউ কমার্শিয়াল সেন্টার ভবনের দ্বিতীয় তলায় দুটি সুপরিসর দোকান ক্রয় করেছেন আনিছ, যার বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। এছাড়া তার স্ত্রী সুমি রহমানের নামে ধানমন্ডির শুক্রাবাদে ৫ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বিলাসবহুল অট্টালিকা ক্রয় করেছেন তিনি।
দুদকের তদন্তকালে কাজী আনিছুর রহমানের নামে অর্ধশত ব্যাংক হিসাবের হদিস পাওয়া যায়, যেগুলোয় কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এসব হিসাবে বর্তমানে জমা রয়েছে ৬ কোটি টাকার মতো, যা আদালতের আদেশে ফ্রিজ করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে তার স্ত্রীর নামে খোলা ২০টিরও বেশি ব্যাংক হিসাব।
কমিশন সূত্র জানায়, তদন্তকালে ৭৬ জায়গায় চিঠি দিয়ে কাজী আনিছুর রহমানের সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সেসবের ভিত্তিতে বেশকিছু সম্পদ জব্দের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আয়কর নথিগুলোও জব্দ করা হয়েছে ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কাজী আনিছ ও তার স্ত্রী সুমি রহমান বর্তমানে বিদেশে পলাতক রয়েছেন। দেশের বাইরেও ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় তাদের বাড়ি-গাড়ির তথ্য পেয়েছে দুদক।
এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, যুবলীগ নেতা কাজী আনিছের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলার তদন্তে নেমে তার আরো সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব বিষয়ে নথিপত্র ও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শিগগিরই এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে।