মিত্র ঠেকাতে কৌশলী বিএনপি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৬ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৫ | আপডেট: ০৩:১১ পিএম, ২৬ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৫
বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, জামায়াতে ইসলামী ভোটের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করছে। একাত্তর প্রশ্নে জামায়াতকে কাবু করার চেষ্টায় বিএনপি। নতুন কৌশল ঠিক করে লিফলেট বিতরণ করার পরিকল্পনা করেছ বিএনপি।
দুই-আড়াই দশক ধরে একে অপরের মিত্র ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। রাজপথের লড়াই আর ভোটের হিসাব মিলিয়েছে তারা একসঙ্গে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান ও তার পরের পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে সব হিসাব। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই দল দুটিই এখন পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই ভোটের মাঠে এত দিন যারা একসুরে কথা বলেছে, এখন তারাই আক্রমণের তির ছুড়ছে একে-অপরকে লক্ষ্য করে। এ সবকিছু মাথায় রেখেই ভোটের প্রচারে কৌশল ঠিক করছে বিএনপি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স গতকাল মঙ্গলবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ভোটযুদ্ধে পারবে না জেনে জামায়াত বিএনপিকে নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আবার দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলে নাকি জান্নাতে যাওয়া যাবে—এমন কথা বলেও ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে তারা।’
এই প্রচার ঠেকাতে বিএনপি কী কৌশল আঁটছে জানতে চাইলে এমরান সালেহ বলেন, ‘আমাদের সবকিছুই উন্মুক্ত, কোনো গুপ্ত মিশন নেই। আমাদের কৌশল একটাই—আমরা ভোটারদের কাছে যাচ্ছি, তাদের কাছে পরিকল্পনার কথা বলছি। আশা করছি জনগণ বিএনপিকেই বেছে নেবে।’
বিএনপি ও জামায়াতের আনুষ্ঠানিক গাঁটছড়ার শুরু মূলত ২০০১ সালের নির্বাচন সামনে রেখে চারদলীয় জোট গঠনের পর থেকে। সেই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যায় এই জোট। বিএনপির সঙ্গে মন্ত্রিসভায় স্থানও পায় জামায়াত। এরপর থেকে দল দুটি জোট ও সমঝোতার ভিত্তিতে যৌথভাবে পার করেছে নির্বাচনী বৈতরণী। যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে নানা কারণে দল দুটির সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। আর চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাজনীতির মাঠে দল দুটির অবস্থান এখন সরাসরি মুখোমুখি। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারছে না। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে থাকতে পারবে কি না বা কীভাবে থাকবে, তা এখনো পর্যন্ত অস্পষ্ট। আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত তাই এখন পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।
কয়েক মাস ধরে দল দুটির নেতারা তাই পরস্পরকে সমানে আক্রমণ করে যাচ্ছেন। রাজনীতির ময়দানে কে কার কোন দুর্বলতা নিয়ে খোঁচা দেবেন, সেটারই মহড়া চলছে এখন। নির্বাচনের প্রচার যখন শুরু হবে, ভোট টানতে এই আক্রমণ আরও জোরালো হবে।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকে নজর দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের ভোটও ঘরে আনতে চায় দলটি। এই চাওয়া পূরণ করতে ভোটের মাঠে জামায়াতের পক্ষ থেকে যেকোনোভাবে বিএনপিকে কাবু করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এর বিপরীতে একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকাকে সামনে টেনে আনছে বিএনপি।
ভোটের মাঠে পরাজিত করতে জামায়াতের দিক থেকে বিএনপিকে নিয়ে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন দলটির নেতারা। ভোটার আকর্ষণ করতে জামায়াতের বিরুদ্ধে ধর্মকে ব্যবহারেরও অভিযোগ এনেছেন তাঁরা।
তবে অপপ্রচারের এসব কৌশলে বিএনপির জয়রথ ঠেকানো যাবে না বলে আত্মবিশ্বাসী দলের নেতারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জনগণের ফোকাস এবার বিএনপির দিকেই। এর আগেও জনগণ যখন সুযোগ পেয়েছে, বিএনপিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছে। এবার জনগণ সে সুযোগ পেয়েছে, কাজেই এবারও ব্যতিক্রম হবে না বলে আশা করি।’
নির্বাচনী কৌশলে বিএনপি এবার তরুণদের বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তরুণদের আকৃষ্ট করতে সভা-সেমিনার আয়োজনের পাশাপাশি তাদের জন্য বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি এরই মধ্যে দলের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ বড় নেতারা বিভিন্ন সভা ও কর্মসূচিতে তরুণদের উদ্দেশে নানা বক্তব্য দিয়ে তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। নতুন ভোটারদের কথা উল্লেখ করে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান স্লোগান ঠিক করেছেন, ‘তারুণ্যের প্রথম ভোট ধানের শীষের পক্ষে হোক।’ তরুণদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ এবং তাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনার কথা বলছে বিএনপি। একই সঙ্গে নারীদের কর্মপরিবেশ ও নানা সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতিও দিয়ে আসছে দলটি।
নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ অনেক আগেই শুরু করেছে বিএনপি। রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের দেওয়া ৩১ দফাতেই রয়েছে নির্বাচনী ইশতেহারের ইঙ্গিত। ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর এখন ওই ৩১ দফাকে সামনে রেখেই জাতীয় নির্বাচনের ইশতেহার তৈরির কাজ করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। নির্বাচনী প্রচারে সারা দেশে এবার লিফলেট বিতরণ করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে ওই বৈঠকে বিশদ আলোচনা হয় বলে জানা গেছে।
লিফলেট বিতরণের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে দলীয় সূত্র বলছে, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে দেশ পুনর্গঠনে প্রতিটি সেক্টরে কর্মপরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে লিফলেটের মাধ্যমে তুলে ধরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এসব লিফলেটে মোটা দাগে দেশের উন্নয়নে বিএনপির কর্মপরিকল্পনা, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেবে, রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফাসহ নানা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হবে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য খাত, কৃষি ও খাদ্য, শিল্প খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়া, প্রশাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ প্রতিটি সেক্টরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তুলে ধরে আলাদা লিফলেটের মাধ্যমে প্রচার করবে বিএনপি। প্রতিটি এলাকায় সুবিধা-অসুবিধা আর জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হবে লিফলেটে। এ ছাড়া তরুণ প্রজন্ম ও নারী ভোটারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লিফলেটে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। এসব লিফলেট দেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্যও নেতা-কর্মীদের প্রতি বিশেষ নির্দেশ থাকবে।
সূত্র আরও বলছে, লিফলেটে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হবে। সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করার কথা থাকবে।
এ ছাড়াও বিশিষ্ট নাগরিক ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা; স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক বাতিল করা; আগামী দিনে ইভিএম নয়, সব কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট নিশ্চিত করা; বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি ‘জুডিশিয়াল কমিশন’ গঠন এবং বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন করা; দেশের সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নির্যাতনের অবসান ঘটানো; ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’—এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রতিটি ধর্মের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে—লিফলেটে সাধারণ ভোটারদের কাছে এমন প্রতিশ্রুতি তুলে ধরতে পারে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দল এখন থেকেই পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করেছে। বিএনপি প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রথম দিন থেকে আমাদের পারফর্ম করতে হবে। দেশকে নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’





