avertisements 2

১৮ রমজান পার, ক্রেতাশূন্য দোকান, হতাশ ব্যবসায়ীরা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৩:৫৫ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪

Text

ঘড়ির কাঁটায় বেলা তিনটা ছুঁই ছুঁই। রাজধানীর মালিবাগের ফরচুন মার্কেটের বেশিরভাগ দোকানই ক্রেতাশূন্য। সেলসম্যানরা অনেকটা অলস সময় পার করছেন। কেউবা মোবাইল ফোনে ইউটিউব, ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে কিংবা গেম খেলে সময় কাটাচ্ছেন। দোকানের কর্মচারীরা অনেকে খোশগল্পে মত্ত। শ'খানেক তরুণ-তরুণী মার্কেটের বিভিন্ন ফ্লোরে ঘোরাঘুরি করলেও দোকানে ঢুঁ মারছেন খুবই কম। ঈদ বাণিজ্যের এ ভর মৌসুমে বেচা-বিক্রির এ দুর্দশা দেখে বেশিরভাগ দোকান মালিক ভীষণ দুশ্চিন্তায়।

দোকানিরা জানান, করোনা মহামারির সময় ছাড়া আর কখনই ঈদের আগে কোনো মার্কেটেই ক্রেতার এতো হাহাকার দেখেননি। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবারও তাদের বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে। ফরচুন মার্কেটের তৈরি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান উইমেন্স ওয়ার্ল্ডের মালিক শবনম রহমান বলেন, 'প্রতি বছর রমজানের শুরুর পর থেকেই ঈদ কেনাকাটা বাড়তে থাকে। ১৫ রোজা পার হতেই রাজধানীর ছোট-বড় প্রতিটি মার্কেট, শপিংমল, বিপণী-বিতানে ক্রেতার ঢল নামে। এবার আগের মতো ঈদ ও বৈশাখকেন্দ্রিক বেচাকেনা জমে না উঠলেও প্রথম রোজার পর থেকে ক্রেতা সমাগম খুব একটা খারাপ ছিল না। ১০ রমজান পর্যন্ত বেচাকেনা মোটামুটি ভালোই হয়েছে। তবে কয়েক দিন ধরে তীব্র গরমের কারণে মার্কেট থেকে ক্রেতারা যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে।'

এদিকে শুধু ফরচুন মার্কেটই নয়, মৌচাক, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, বেনারশি পলস্নী, ধানমন্ডি হকার্স, ইষ্টার্ণ মলিস্নকা, ইষ্টার্ণ পস্নাজা, বসুন্ধরা শপিং কমপেস্নক্স ও যমুনা ফিউচার পার্কসহ রাজধানীর ছোট-বড় প্রায় দুই ডজন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, সব জায়গাতেই ক্রেতার আকাল পড়েছে। ফুটপাতের ক্রেতারাও যেন ধর্মঘট ডেকে বসেছে।

ব্যবসায়ী নেতারা জানান, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের হাত টানাটানি চলছে। এর উপর চৈত্রের খরতাপে রাস্তাঘাটের বাতাসে আগুনের হল্কা বয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ ঈদ কেনাকাটার জন্য ঘর থেকে বের হতে রীতিমত ভয় পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ঈদ ও বৈশাখকেন্দ্রিক বেচাকেনায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।

নূরজাহান মার্কেটে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আইইউটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, নিজ ও পরিবারের জন্য বৈশাখ এবং ঈদের কিছু কেনাকাটার জন্য মার্কেটে এসেছিলেন। তবে দুর্বিষহ গরমে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই কেনাকাটা না করেই বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। আগামী দুই-একদিন পর গরম কমলে মার্কেটে আসবেন।

দুই শিশু সন্তান ও বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে বসুন্ধরা শপিং মলের ঈদ কেনাকাটা করতে আসা এনজিও কর্মকর্তা রওশন আরা রেখা জানান, মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রিকশায় মার্কেট পর্যন্ত আসতে তীব্র গরমে ঘেমে নেয়ে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটে ঢুকে কেনাকাটা করলে ঘামে ভেজা শরীরে ঠান্ডা লেগে জ্বর-কাশি হতে পারে। তাই তারা কেনাকাটা না করেই বাসায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

রেখা জানান, রোববারও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঈদ কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাওয়ার টার্গেট নিয়েছিলেন।

কিন্তু গরমের কারণে বাসা থেকে বের হতে সাহস পাননি। তাপমাত্রা না কমলে আগামী ৩/৪ দিন আর এ ধরনের ঝুঁকি নেবেন না বলে জানান তিনি।

এদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অভিজাত মার্কেটগুলোতে কিছু ক্রেতা থাকলেও যেসব মার্কেটে সে ব্যবস্থা নেই, সেখানকার বেচাকেনায় আরও বড় ধস নেমেছে। দোকানিরা জানান, ফ্যানের বাতাসেও শরীর ঘামছে। দোকানে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করবে কীভাবে?

গাউছিয়া, চাঁদনীচক, নিউ সুপার, নূরজাহান, হক সুপার, আজিজ সুপার, আনারকলি, নাহার পস্নাজা, সোনার বাংলা, শাহআলী ও মৌচাকসহ প্রায় এক ডজন নন-এসি মার্কেটের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চৈত্রের গরম তেতে ওঠার পর থেকেই তাদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। গরমের সঙ্গে পালস্না দিয়ে বেচা-বিক্রিতে ভাটার টান আরও জোরালো হচ্ছে।

এদিকে মিরপুরের বেনারশি পলস্নীর অবস্থা আরও ভয়াবহ। বেনারশি শাড়ির জন্য খ্যাত এ মার্কেটে খুচরা-পাইকারি দুই ধরনের বেচাবিক্রিই অর্ধেকে নেমে এসেছে।

সোমবার দুপুরে গোটা মার্কেট ঘুরে সেখানকার দুইশ' দোকানের মধ্যে ১৫/২০টি দোকান ২/৩ জন করে এবং ১০/১২টি দোকানে একজন করে ক্রেতার উপস্থিতি দেখা গেছে। বাকি দোকানগুলোতে বিক্রেতারা বিরস বদনে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে আছেন। দোকানের সামনে দিয়ে এক ক্রেতা হেঁটে গেলেই ৪/৫ জন দোকানি ডাকাডাকি করছেন।

বেনারসি পলস্নীর পাইকারি শাড়ি বিক্রেতা আমজাদ হোসেন জানান, তার দোকানে নূ্যনতম সেল ৫ লাখ টাকা না হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন, বিদু্যৎ বিল ও দোকান ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচাদি তোলা কঠিন। অথচ কয়েকদিন ধরে তীব্র গরমের কারণে ৫০/৬০ হাজার টাকার শাড়িও বিক্রি হচ্ছে না। ঈদের আগে আর কিছুদিন এ অবস্থা চললে তাদের ব্যবসা শিঁকেয় উঠবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিভিন্ন বিপণী-বিতান ও শপিংমলে কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতারা জানান, তীব্র খরতাপে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটে যেতেও তারা সাহস পাচ্ছেন না। কেননা বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় চড়তে গেলেই আগের চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে। প্রচন্ড গরমে বাসে গাদাগাদি করে মার্কেটে যাওয়া রীতিমত দুঃসাহসিক ব্যাপার। বিশেষ করে যারা শিশু সন্তান ও পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে প্রতি বছর ঈদ কেনাকাটার আনন্দ উপভোগ করেন, এবারের দুর্বিষহ গরম সে আনন্দ মাটি করে দিয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, দিনের রোদের তাপ কমলে সন্ধ্যার পর বেচাকেনা জমবে এ আশায় তারা তীর্থের কাকের মতো ক্রেতার আশায় বসে থাকলেও গত ক'দিন ধরে সে আশায়ও গুড়ে বালি পড়ছে। সারাদিন রোজা রেখে ইফতারির পর কিছু ক্রেতা মার্কেটে ঢুকলেও নন-এসি মার্কেটে গরমের কারণে সামান্য কিছু কেনাকাটা করেই বের হয়ে যাচ্ছেন। তবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অভিজাত মার্কেটগুলোতে রাত কিছুটা বাড়ার পর ক্রেতাদের পদচারণা বাড়ছে।

এদিকে করোনার সময় মার্কেট, বিপণী-বিতান ও শপিংমলগুলোতে বেচাকেনা ততটা না জমলেও অনলাইন কেনাকাটা যথেষ্ট জমেছিল। কিন্তু গত কয়েকদিনের দাবদাহে মার্কেটে বিক্রি যতটা কমেছে, সে তুলনায় অনলাইন শপিং বাড়েনি। বরং এ খাতেও কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গরমের কারণে ডেলিভারিম্যানরাও সময় মত পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে হিমসিম খাচ্ছেন। তবে অনলাইনে বিক্রেতাদের অনেকের ধারণা, যারা মার্কেটে ঘুরে ঈদ কেনাকাটা করেন, তাদের খুবই কমসংখ্যক অনলাইন ক্রেতা। তারা উৎসবকেন্দ্রিক কেনাকাটাতেও ভিন্ন আনন্দ পান। তাই গরমের কারণে মার্কেটে ক্রেতার ভিড় কমলেও অনলাইনে কেনাকাটা বাড়বে- সেটি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

ব্যবসায়ীরা জানান, বুড়িগঙ্গার ওপারে গড়ে ওঠা সর্ববৃহৎ গার্মেন্টসপলস্নী থেকে দেশের মানুষের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ তৈরি পোশাকের চাহিদা মেটে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ডলারের দাম বৃদ্ধি আর এলসি সংকটে বিদেশি পোশাক আমদানি কমে গেছে। এতে দেশীয় পোশাকের চাহিদা বাড়বে এমন স্বপ্ন দেখেছেন গার্মেন্টস মালিক ও ব্যবসায়ীরা। তবে এখনও আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মুসলিম ঢালী বলেন, রোজার ঈদ এখানকার ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে বড় মৌসুম। সারা বছর পোশাক তৈরি করে ঈদের এ মৌসুমে বিক্রি করা হয়। অন্যান্য বছর শবে বরাতের পর থেকে ২০ রমজান পর্যন্ত সব পোশাক বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর এখনও তেমন বিক্রি হয়নি। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের দাম বৃদ্ধি ও এলসি সংকটে বিদেশি পোশাক আমদানি হয়নি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও তাদের ব্যবসা জমবে এমন আশা করেছিলেন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে এখন সংশয় দেখা দিয়েছে। মফস্বল পর্যায়ে খুচরা বিক্রেতারা আর্থিক সংকটে আছেন উলেস্নখ করে ব্যবসায়ীরা বলেন, অনেকেই পুঁজি গুছিয়ে মাল কিনতে পারছেন না। এ বছর অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ঋণ পাননি। ফলে তারা অনেকেই করতে পারছেন ঈদের কেনাকাটা।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2