বাল্যবিয়ের অভিশাপে বৃষ্টি এখন প্রতিবন্ধী
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৩:১০ পিএম, ১১ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২০ | আপডেট: ০৬:২৭ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
মেয়েটির নাম মরিয়ম। বয়স ১৪ বছর। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বাল্যবিয়ে হয়। এখন সে গৃহবধূ ও এক শিশু সন্তানের মা। কন্যা সন্তান নিয়ে গ্রামীণ সমাজে নেতিবাচক ধারনা থাকায় তাড়াশ উপজেলায় প্রতিবছর মরিয়মের মতো হাজারো মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন। কেবল কালেমা পড়েই এসব বিয়ে করানো হয়। উপযুক্ত বয়স না হওয়ায় নিবন্ধন করা সম্ভব হয় না।
এদিকে অপরিপক্ক বয়সে বিয়ের কারণে মা ও শিশু উভয়ের মৃত্যু ঝুঁকি বহুলাংশে বেড়ে চলেছে। অনেকে মা হওয়ার আগেই, অথবা পরে অসুস্থতায় ভুগছেন। কেউবা স্বামী, সংসার ও পরিবারের সাথে মানিতে চলতে না পেরে বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছেন।
বাল্যবিয়ে তাৎক্ষণিক বন্ধ করা গেলেও শেষ পর্যন্ত একটি বিয়েও আটকে থাকে না। এটাকেই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন স্থানীয় প্রশাসন, জন প্রতিনিধি, বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও সামাজিক সংগঠনগুলো। তাছাড়া মানুষজনের মধ্যে আইন না মানার সংস্কৃতিও এ ক্ষেত্রে প্রবল।
মরিয়ম জানান, তখন সে বলদিপাড়া দাখিল মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। লেখাপড়ায়ও বেশ মনযোগী ছিলেন। এরই মধ্যে তাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বাইরে তার কিছুই করার ছিলো না। এখনও বয়স পড়ালেখা করে হেসে খেলে বেড়ানোর। কিন্তু সন্তান লালন-পালন ও সংসারের দায়িত্বভার তারই কাঁধে।
মরিয়ম উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের কাটাগাড়ি গ্রামের মজনু সরকারের মেয়ে ও একই গ্রামের খোকন রহমানের স্ত্রী।
উপজেলার দেশীগ্রাম ইউনিয়নের কাটাগাড়ি আদর্শ গ্রামের নুর হোসেনের মেয়ে বৃষ্টি খাতুনের (১৩) জীবনের গল্পটা আরো নির্মম। বাল্যবিয়ের অভিশাপে সে এখন শারীরিক প্রতিবন্ধী। বৃষ্টি জানান, বলদিপাড়া দাখিল মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পাশের দেশিগ্রামের আব্দুল মতিনের ছেলে আব্দুল মমিনের সাথে তার বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু কোনোভাবেই সে স্বামী,
সংসার ও পরিবারের সাথে মানিয়ে চলতে পারছিলো না। স্বামীকে দেখে তার খুবই ভয় লাগতো। এ বিষয়টা না কেউ বুঝতে চাইতো, না কেউ মেনে নিতেন! সে ভেবে নিলো, এত ভয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। তাই কীটনাশক পানে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অনেক চিকিৎসার পর প্রাণে বেঁচে গেলেও দু’পায়ের শক্তি হারিয়ে যায়। সে এখন লাঠিতে ভর করে খুড়িয়ে-খুড়িয়ে হাঁটে।
বৃষ্টির মা বাচা খাতুন বলেন, দেরিতে হলেও তিনি বুঝতে পারেন, মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি। তাইতো জামাই আব্দুল মমিন ও বেয়াই আব্দুল মতিনকে আরো একটু সময় দেওয়ার অনুরোধ করে বৃষ্টিকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তবে মানতে নারাজ। সপ্তাহ পার না হতেই জামাই চলে আসেন শ্বশুর বাড়িতে। আর ভয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করতে চান।
বৃষ্টি মা আরো বলেন, যার কারণে তার মেয়ের জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সে আবারও বিয়ে করে সংসার করছেন। বৃষ্টির কোনো খোঁজ-খবর নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন না। বিয়ে নিবন্ধন করা সম্ভব হয়নি বলে আইনি সহায়তাও নেওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে মরিয়মের বাবা মজনু, বৃষ্টির বাবা নুর হোসেন, সুমাইয়ার বাবা রুহুল আমিন, শাহানার বাবা শহিদ উদ্দিন, আমেনার বাবা আবুল হোসেনের মতো অনেকেই মনে করেন, মেয়েদের বয়স বেশি হলে বিয়ে দিতে সমস্যা হয়। পক্ষান্তরে অল্প বয়সী মেয়েদের কম খরচে সহজেই বিয়ে হয়ে যায়। তাছাড়া কন্যা সন্তান পড়ালেখা শিখিয়ে লাভ নেই, তাদের দিয়ে ভিটে-মাটিতে বাতি জ্বালানোর কোনো নিশ্চয়তা থাকে না!
সরেজমিনে তাড়াশের বারুহাস ইউনিয়নের বস্তুল, তালম ইউনিয়নের চৌড়া, দেশিগ্রাম ইউনিয়নের দেশিগ্রাম, মাধাইনগর ইউনিয়নের সরাপপুর, নওগাঁ ইউনিয়নের কালুপাড়া, মাগুড়া বিনোদ ইউনিয়নের হামকুড়িয়া, সগুনা ইউনিয়নের কুন্দইল ও তাড়াশ সদর ইউনিয়নের মাধপপুর গ্রাম ঘুরে জানা যায়, প্রতিটি গ্রাম থেকেই বছরে ৫/৬ জন মেয়ের অপরিপক্ক বয়সে বিয়ে হয়ে গেছে। অনুরূপভাবে উপজেলার ২শ’ ৫৬ গ্রাম থেকে ৫ জন করে হলেও প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার ২শ ৮০ জন মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছেন।
বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তাড়াশে কাজ করছেন উই ক্যান বাংলাদেশ ও পরিবর্তন নামে দুইটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। ঐ প্রতিষ্ঠান দুইটির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, উপজেলার দেশিগ্রাম ইউনিয়নের দেশিগ্রামের সেই মরিয়ম, বৃষ্টিসহ রুহুল আমিনের মেয়ে সুমাইয়া (১৪), শহিদ উদ্দিনের মেয়ে শাহানা (১৩), আবুল হোসেনের মেয়ে আমেনা (১৪), কালাম মন্ডলের মেয়ে কামনা খাতুনকে (১৪) বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ঐ গ্রামের এমন বাল্যবিয়ের চিত্র। প্রায় একই রকম চিত্র অন্য ২শ ৫৫ গ্রামেরও।
পরিবর্তন সংস্থার পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক রাজু বলেন, স্থানীয় প্রশাসন, জন প্রতিনিধি, বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, সামাজিক সংগঠন ও স্টুডেন্ট ফোরামের সহায়তায় বাল্যবিয়েগুলো তাৎক্ষণিক বন্ধ করা সম্ভব হয়। কিন্তু ফলোআপ দেখা যায়, একটি বিয়েও শেষ পর্যন্ত আটকে নেই। কৌশল অবলম্বন করে প্রতিটি বিয়েই হয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, কাউন্সেলিং, এ্যাডভোকেসি কার্যক্রমকে এখনও সফলভাবে সাধারণ মানুষের দৌড় গোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ জন্য বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭ প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা অতীব জরুরি। অনুরূপ মতামত দিয়েছেন, আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান বাংলাদেশ) সিরাজগঞ্জ নারী অধিকার সুরক্ষা প্রকল্পের মাঠ কর্মকর্তা মাহবুব আলম।
তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন উম্মে হাবিবা রুপা বলেন, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে হলে সাধারণত মা ও শিশু উভয়ের মৃত্যু ঝুকি অনেক বেশি থাকে। সর্বোপরি অপরিপক্ব বয়সে বিয়ের কারণে শারীরিক ও মানসিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবাউল করিম ইত্তেফাককে বলেন, বাল্যবিয়েগুলো সাময়িক বন্ধ করা গেলেও আটকে থাকছে না। মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দোষীদের জেল-জরিমানাও করা হয়। সর্বোপরি বাল্যবিয়ে থেকে অভিভাবকদের নিরুৎসাহিত করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।