avertisements 2

যে কারণে ভাগ্য বিপর্যয় জাহাঙ্গীর ও সাদিকের

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ এপ্রিল,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:৩১ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪

Text

গাজীপুরের বহিষ্কৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আগে থেকেই অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপরও শেষ চেষ্টা ছিল তাঁর। কিন্তু শেষতক তিনি মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। বরিশালের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বিষয়টি ছিল একেবারেই উল্টো। তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন না, এটা কল্পনাতেও আনেননি। কিন্তু তিনি ছিটকে পড়েছেন।

গতকাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে এই দু’জনের মনোনয়ন নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। বরিশালের মেয়রের বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ তাঁর ছেলেকে আরেক দফায় দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার অনুরোধ করে হতাশ হয়েছেন। গাজীপুরের মেয়র দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন বলে তাঁর মনোনয়নের বিষয়টি আলোচনাতেই আসেনি।

জাহাঙ্গীর আলম ও সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ গত নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছিলেন। তারপরও এবার কেন তাঁরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেন না– এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারা সমকালকে জানিয়েছেন, এই দুই মেয়রের বিরুদ্ধে দলের সিনিয়র নেতাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং দলের চেইন অব কমান্ড না মানার পাশাপাশি অহংকারী মনোভাব ও দাম্ভিকতার অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা দলীয় কাঠামোতে বড় পদে থাকলেও কাউকেই তোয়াক্কা করতেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের নেতিবাচক ভূমিকা ছিল রীতিমতো দৃষ্টিকটু। এসব কারণেই তাঁরা দলের মনোনয়ন পাননি।

বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে ঘরোয়া আড্ডায় বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে বহিষ্কৃত হন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে নিজের কক্ষে ধারণ করা জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ১৯ নভেম্বর তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর দুর্নীতির অভিযোগে মেয়রের পদ থেকে বহিষ্কৃত হন ২৫ নভেম্বর।

প্রায় এক বছর পর গত ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হলেও এবার আর দলের মনোনয়ন পাননি। বিতর্কিত বক্তব্য এবং ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকার অনিয়মের ঘটনাই তাঁর জন্য কাল হয়েছে।

জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক প্রশস্তকরণের কাজে নিয়ম অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন না করা, সড়ক প্রশস্ত করার নামে বাড়িঘর ভাঙা, ভাঙা বাড়িঘরের জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম, ভুয়া টেন্ডার, বিভিন্ন পদে অযৌক্তিক লোকবল নিয়োগ, একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং প্রতি বছর হাটবাজার ইজারার অর্থ যথাযথভাবে নির্ধারিত খাতে জমা না রাখা। এসব অনিয়মের সত্যতা তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। অবশ্য এসব অভিযোগকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্র হিসেবে দাবি করেছেন জাহাঙ্গীর আলম।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, বরিশালের মেয়রের বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের এক নম্বর সদস্য। তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বরিশাল-১ আসনের এমপি। তাঁর ছেলে মেয়রের পাশাপাশি বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। দলীয় কাঠামোর বড় দুই পদে বাবা-ছেলের অবস্থানের বিষয়টি স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনীতিতে নানাভাবেই সমালোচিত হয়ে আসছে। অবশ্য এ নিয়ে মুখ খোলার সাহস নেই কারও।

কিন্তু মেয়র মনোনয়নের বেলায় এই বিষয়টি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা মনে করছেন। তাঁদের দৃষ্টিতে, দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বড় ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ উত্তরাধিকার সূত্রে বরিশালের রাজনীতিতে জায়গা করে নেন। তাঁকে কখনোই রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে হয়নি। দলে এসেই মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে বেপরোয়া হয়ে পড়েন তিনি। একে একে সবই কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন।

সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনের সম্পর্ক খুব একটা সুখকর নয়। একাধিকবার তিনি প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। তা ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতার গায়ে হাত তোলার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ফলে দলের সিনিয়র ও ত্যাগী নেতারা কখনোই তাঁর একক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পেতেন না। বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ মেয়র পদে শুধু তাঁর নামই কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। বিকল্প প্রার্থী থাকলেও তাঁর নাম প্রস্তাব আকারে পাঠাতেই পারেনি।

সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে যান। তিনি বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর কালিবাড়ি সড়কের বাসভবনে বসিয়ে রাখতেন। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যখন-তখন বাসায় ডেকে পাঠাতেন। কোনো কর্মকর্তা তাঁর ডাকে সাড়া না দিলে অপমান-অপদস্থ হতে হতো। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীমের সঙ্গে তাঁর বনিবনা নেই।

২০২১ সালের ১৮ আগস্ট রাতে সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে ইউএনওর বাসভবনে হামলা ছিল তখনকার সময়ে দেশব্যাপী আলোচিত ঘটনা। মেয়র অনুসারীরা জাহিদ ফারুক শামীম এমপির ব্যানার অপসারণ করতে গেলে বাধা দেওয়ায় ওই হামলার ঘটনা ঘটে। আরেকটি আলোচিত ঘটনা ছিল গত ডিসেম্বরে জেলা পরিষদ নির্বাচনের দিন। জিলা স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়েছিলেন মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তাঁকে দলবলসহ কেন্দ্রে না ঢোকার জন্য অনুরোধ করলে সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ‘স্টুপিড’ বলে গালমন্দ করেন মেয়র।

দায়িত্ব গ্রহণের পরই সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ কাঁচা বালু পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে নগরবাসীকে ফেলেন দুর্ভোগে। তিনি নগরের বাড়ি তৈরির নকশা অনুমোদন বন্ধ করে দেন। হোল্ডিং ট্যাক্স কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেন। এতে নগরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নামে। নানা অভিযোগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। 

এমনকি নগরের দুটি বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট ও হাটবাজারসহ নগদ আয়ের অনেকগুলো খাত দখলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তা ছাড়া প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পরিবহন সেক্টরকে ব্যবহার করার অভিযোগও আছে। সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সময়কালে সড়কের ওপর সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনাও ঘটেছে। 

৩০ জন সাধারণ এবং ১০ সংরক্ষিত কাউন্সিলরের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে। সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরদের অভিযোগ, মেয়র তাঁর একক সিদ্ধান্তে সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালের আগস্টে। ১০ জন কাউন্সিলর একযোগে মেয়রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের পক্ষে অবস্থান নেন।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2