বিরতি দিয়ে আবার তৎপর রওশনপন্থিরা, লক্ষ্য নির্বাচন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ মার্চ,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ১২:৪৩ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
মাঝখানে মাস দুয়েক বিরতি দিয়ে আবারও তৎপর হয়ে উঠেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের অনুসারীরা। দলীয় রাজনীতিতে রওশন প্রায় পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ও চুপচাপ থাকলেও তার অনুসারীরা নিয়মিতই বৈঠক করছেন। নিচ্ছেন দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও। তাদের এই তৎপরতার মূল টার্গেট আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রওশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নির্বাচনে সরকারের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে দলের মনোনয়ন প্রদানের কর্তৃত্ব নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়াই তাদের প্রধান লক্ষ্য বলে জানা গেছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার মূল ধারাকে পাশ কাটিয়ে আজ সোমবার রওশনের অনুসারীরা ইফতার পার্টির আয়োজন করছেন। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর গুলশানে ইমান্যুয়েলস কনভেনশন হলে আয়োজন করা হচ্ছে এই ইফতার মাহফিল ও আলোচনা সভার। বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্’র পাঠানো আমন্ত্রণপত্রে জানানো হয়েছে, আজকের এই অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানিয়েছেন, আজকের এই আলোচনা সভা ও ইফতার মাহফিলের সঙ্গে জাপার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, ‘দল থেকে বিচ্যুত কতিপয় ব্যক্তি রওশনকে ব্যবহার করে জাপায় বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব করছেন।’
রওশনপন্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পৃথক এই বলয়ের প্রতিটি সভা ও অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদের নাম ব্যবহার করা হলেও মূলত এর নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন জাপার যুগ্ম-মহাসচিব ও রওশনপুত্র সাদ এরশাদ এমপি। কার্যত সাদকে ঘিরেই জাপার নামে পৃথক এই বলয়টি তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে দল থেকে বহিষ্কৃত ও পদ-পদবি হারানো নেতারা সাদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন। রওশনপন্থী নেতাদের দাবি, বিগত তিনটি নির্বাচনের মত আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার আসন সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দল যেন এই মেরুকরণে ভূমিকা রাখতে না পারে- সেকারণেই রওশনের নামে সাদকে সামনে আনা হয়েছে। মূল লক্ষ্য, রওশনের নাম ব্যবহার করে সাদের নেতৃত্বে দলের মনোনয়ন প্রদানের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণে নেওয়া।
টানা সোয়া তিন মাস দলের অভ্যন্তরে চলা বিবাদের পর গত ৯ জানুয়ারি যুক্ত বিবৃতি দিয়ে ‘ঐক্যের বার্তা’ দিয়েছিলেন রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের। জাপার প্যাডে রওশন ও জিএম কাদেরের যৌথ স্বাক্ষরিত যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘জাপায় কোনো বিভক্তির প্রশ্নই ওঠে না। বরং আমরা দুজনই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের প্রয়াত নেতা এইচএম এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাপাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বদ্ধপরিকর।’ বিবৃতিতে তারা এ-ও বলেন, ‘কিছুদিন ধরে গণমাধ্যমে জাপার বিভক্তি সম্পর্কিত বিভ্রান্তিকর কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আমি জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ ও আমি জাপার চেয়ারম্যান জিএম কাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, জাপায় বিভক্তির প্রশ্নই ওঠে না। আমরা দুজনই পার্টিকে শক্তিশালী বিরোধীদল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিতব্য আগামী সংসদ নির্বাচনে জাপা অংশ নেবে এবং সেলক্ষ্যে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে পার্টিকে সুসংগঠিত করার প্রত্যয় ঘোষণা করছি। আমরা পার্টির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে পার্টিকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় রওশন এরশাদ হঠাৎ গতবছরের ৩০ সেপ্টেম্বর এক চিঠির মাধ্যমে জাপার দশম জাতীয় কাউন্সিল ডাকেন। গতবছরের ২৬ নভেম্বর এই কাউন্সিল হওয়ার কথা ছিল। পরদিনই (১ অক্টোবর) ‘দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না’- এমন কারণ দেখিয়ে তার পরিবর্তে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার জন্য সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দেয় দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি। এনিয়ে জাপায় বিবাদ দেখা দেয়। এ অবস্থায় জিএম কাদেরকে ‘সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা’ হিসেবে স্পিকার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ না করা পর্যন্ত গত ৩১ অক্টোবর থেকে সংসদ বর্জনেরও ঘোষণা দেয় দলটির পার্লামেন্টারি পার্টি। আগেরদিন রাতে এই ঘোষণা দিলেও ‘স্পিকারের আশ্বাসে’ পরদিনই জিএম কাদেরের নেতৃত্বে সংসদে ফিরেন জাপার এমপিরা। অন্যদিকে, আগেরদিন রাতে রওশন এরশাদও তার ডাকা কাউন্সিল স্থগিত করেন। পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ও সিদ্ধান্তে এভাবে বিবাদ বাড়তে থাকে দলটিতে। বিবাদের জেরে দল থেকে বহিষ্কার হন সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা ও সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা।
বিবাদের মধ্যেই চিকিত্সা শেষে গতবছরের ২৭ নভেম্বর রওশন দেশে ফেরার পর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করেন জিএম কাদের। এরপর রওশনের সঙ্গে গণভবনে গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও বৈঠক করেন। গত ১ জানুয়ারি জাপার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশেও একমঞ্চে পাশাপাশি বসেন রওশন-জিএম কাদের। সেদিনের বক্তব্যে রওশন বলেছিলেন, ‘চলার পথে মান-অভিমান হতেই পারে, সেটা ভুলে যেতে হবে।’ তবে পার্টি চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনায় আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা থাকায় সেদিন মঞ্চে থাকলেও বক্তব্য দেননি জিএম কাদের। এরপর গত ৫ জানুয়ারি এবছরের প্রথম সংসদ অধিবেশন শুরুর আগে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদের কার্যউপদেষ্টা কমিটির বৈঠকেও কমিটির সদস্য হিসেবে রওশন ও জিএম কাদের উপস্থিত ছিলেন।
গতবছরের ৩০ অক্টোবর রওশন তার ডাকা কাউন্সিল স্থগিত ঘোষণা করার পর এনিয়ে তত্পরতা থেকে বিরত হয়ে যান তার অনুসারীরাও। পরবর্তীতে জাপার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রওশনের যোগদান এবং রওশন ও জিএম কাদেরের যৌথ বিবৃতি দিয়ে ঐক্যের বার্তা দেওয়ার পর রওশনপন্থীরাও ছন্নছাড়া হয়ে যান। গুলশানের যেই কার্যালয় থেকে তারা কাউন্সিলের তত্পরতা শুরু করেছিলেন, সেটিও গুটিয়ে নেওয়া শুরু করেন। তবে সমপ্রতি আবারও অফিস খুলে তারা তত্পর হয়ে উঠেছেন। আজকের ইফতার মাহফিলের যে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন গোলাম মসীহ্, সেই আমন্ত্রণপত্রেও তিনি নিজেকে ‘জাপার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও মসীহ্ জাপার প্রাথমিক সদস্যও নন।
আজকের ইফতার পার্টির আগে গত ২০ মার্চ এরশাদের জন্মদিনও পৃথকভাবে উদ্যাপন করেন রওশনপন্থীরা। জাপার প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের জন্মদিন উপলক্ষে এবার চারটি অনুষ্ঠান করেছে জাপা। তবে, এর কোনটিতেই যাননি রওশন। তিনি তার গুলশানের বাসায় পৃথকভাবে কেক কাটার আয়োজন করেন। সেখানে তার অনুসারীরা অংশ নেন। সেই অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রওশন বলেছেন, ‘এরশাদের জন্মদিনে পৃথক অনুষ্ঠান করার মানে দলে বিভক্তি নয়, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আমি পৃথকভাবে আয়োজন করতেই পারি।’
রওশনপন্থীদের আবারও তত্পরতা সম্পর্কে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমার ধারণা এসব তত্পরতার সঙ্গে রওশন এরশাদের সরাসরি যুক্ততা নেই। কতিপয় ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে ওনার নাম ব্যবহার করছেন। এমনও হতে পারে, উনিও (রওশন) হয়তো ব্যবহার হচ্ছেন। তবে, জাপার সকল নেতা-কর্মী আমার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। জাপায় কোনো বিভক্তি নেই।’