জালাল উদ্দিন আহমেদ
দিবস নামা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ জুন, বুধবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:১৯ এএম, ২৭ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
"যেখানে যত শান
সেখানে তত ভান
কথাটির উজ্জ্বলতা আছে বৈকি! ইদানীং ফেসবুকের বাহারী ছবির তোড় দেখে এটা যেন অবচেতন মনেই আমাকে জাগিয়ে দিল। অবশ্য এই জাগাজাগির কোন যায় আসে না। যেটা ট্রেন্ড সেটা ট্রেন্ডি হবেই। যেন বন্যার পানির তোড়। এই তোড় বা প্রবাহের শেষ নেই। লাগাম ছাড়া অনন্তের আগমনী বার্তার এক একটি চমক। মনে হয় এটা যেন আগেও ছিল। মনুষ্য স্থিতির আদি হতেই এসব আদব লেহাজ কৃষ্টি কালচার যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্টেই জড়িয়ে ছিল। পুনরুত্থানের নতুন আঙ্গিকে নতুন মোড়ক নিয়ে আমাদের জাগতিক জীবনাচারে এসবের আগমন ঘটছে।
এই দিবসের ট্রেন্ডবাজি বা প্রচলন এর সুত্রপাত ঊনিশ শতকের দিকে। এর আগে ছিল কিনা খোঁজ নিয়ে দেখিনি। তবে যোগসুত্র তো একটা না একটা আছে। নইলে মানুষের আদিম ও নৈতিক চাহিদার অনেক কিছুই আজ আমাদের একবিংশের উঠানে এসে এত সব উৎসাহ উদ্দীপনায় তার স্বতঃসিদ্ধতা পায় কিভাবে! যা কিছু হচ্ছে, সবই কিন্তু বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকেই এসবের উৎপত্তি। বিষয়টি ওভাবে না বলে বলা যায়, মুক্ত অর্থনীতি আজ আমাদের একটি মুক্ত উঠান দিয়েছে। সে উঠানের পরিজন আমরা সবাই। ফলে গতকাল যেটা আমেরিকার কোন প্রত্যন্ত প্রান্তরে অনাড়ম্বর কিংবা আড়ম্বরে পালিত হয় আজ সেটা ভারত জাপান বা বাংলাদেশে পালিত না হওয়ার কোন কারন নেই। এবং এভাবেই ভূমন্ডল একটি গ্লোব্যাল ভিলেজে পরিনত হচ্ছে। অবশ্য বাংলার বাঙালীয়ানায় অনেক কিছুরই আবাহন খুঁজে পাওয়া যাবে না। থাকবেই বা কেন! কাদা মাটি কচু ঘেঁচু মাছে ভাতের বাঙালীর আটপৌঢ়ে শাড়ি ধুতির আঁচল বা কোঁচ সামলাতেই তো দিনমান শেষ হয়ে যায়। জীবন যুদ্ধের কষাঘাতেই তার আমৃত্যু যুদ্ধ করে পার করতে হয়। ফলে আনন্দ অনুভূতি ও স্বকীয়তা কিংবা আত্মানাভূতির ফুরসত তার জীবনে নগন্যই থাকে।
দিবস চরিত বা দিবস নামা নিয়েই কিছু বলার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই আমার এই কালি খরচের এন্তেজাম। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে আমাদের এই দিবস উদযাপন বাহারী পাগলা ঘোড়ার রেসে নেমে পড়েছে। মানুষ যেহেতু সমাজবদ্ধ জীব বিধায় সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের জাগতিক আকাঙ্ক্ষায় তারা নিত্য নতুন ইচ্ছে পুরন কিংবা মানসিক প্রশান্তি ও জাগতিক আকাঙ্ক্ষায় তাদের মতো করে সৃষ্টির তিরিশটি দিনকেই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে স্মরন করে। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপুর্ন ঘটনাপুঞ্জ মানব জীবনের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জনসচেতনতা ও স্মরন করার উপলক্ষ্য তৈরী করে। মানুষের কোন কীর্তি বা সামাজিক কোন আন্দোলন অথবা সমাজ সচেতনতার স্মরনীয় কিছু ঘটনা, মানুষ সমাজ রাষ্ট্র এমনকি গ্লোবাল ভিলেজের মানব জাতি অতি ভক্তি ও কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরন করে থাকেন। এভাবেই কাল্ পরিক্রমায় বছরের প্রতিটি দিনই আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরন, সম্মান, জনসচেতনতা তৈরী এবং ভালবাসা ও গর্বিত বা দুঃখ প্রাকাশ করার উপলক্ষ্য হিসাবে স্মরন বা উদযাপন করি। পৃথিবীর প্রায় দু'শটি দেশে তাদের নিজস্ব চাহিদায় বিভিন্ন স্মরনীয় ও শ্রদ্ধার দিন পালন করা হয়। তবে যেহেতু আমরা এখন প্রযুক্তি নির্ভর গ্লোব্যাল ভিলেজের জনপদে পরিনত হয়েছি, সুতরাং আন্তর্জাতিকতা বাদকে এড়িয়ে চলার সুযোগ খুব কম। ফলে বছরের প্রতিটি দিনই কোন না কোন স্মরনীয় বা সচেতনতা দিবসের উদযাপন আমাদের লেগেই থাকে। কোনটা সরকারী পর্যায়ে, কোনটা বেসরকারী বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে পড়ে।
ক'দিন আগে অর্থাৎ গত ১৯ জুন "বাবা দিবস" নামক একটি চমৎকার দিন চলে গেল। আমি একজন বাবা। আমার বর্তমান পর্যায়টি অবশ্য দাদা-নানার পর্যায়ে এসে গেছে। অবসরে আছি। সেটাও তো এক দশক পেরিয়ে গেল। আমার ছেলে মেয়েরা এটাকে নিয়ে বেশ উদযাপনের মতই করে ফেলে। কেউ একটা ঘড়ি দিল, আবার কেউ একটা সুন্দর ডাইরি সঙ্গে একটি দামি কলম, আবার অন্যজন একটি নক্সা করা সুতির ফতুয়া। বৌমার বাহারী আয়োজনে রাত্রের ডিনার। বেশ উপভোগ করি এসব। খাওয়া দাওয়া ফটো সেশন সবই চলে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় বাহারী ছবির ছড়াছড়ি। বেশ একটা দিন গেল বটে। আমার স্ত্রীর জন্যও ৮ মার্চটাও বেশ আনন্দ দায়ক হয়। কারন সেদিন আবার মা দিবস। মাকে নিয়ে ছেলে মেয়েদের উচ্ছ্বাস একটু বেশীই। মাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে। দামি শাড়ি কিনে দেবে। দামি রেস্টুরেন্টে ফ্যামিলি গেট টুগেদার হবে। ভালই উপভোগ করি। প্রান খুলে ওদের ভবিষ্যত কল্যানের জন্য দোয়া করি। দুনিয়ার প্রতিটি সন্তান যেন এভাবে তাদের বাবা-মাকে সম্মানিত করার মানসিকতায় এগিয়ে চলে এই দোয়াই করি কায়মনোবাক্যে। তবে এসব দিবসগুলি এখন বিশেষভাবে বিশেষায়িত হয়ে বিশ্বজনীন হয়েছে। যেমন বিশ্ব বাবা দিবস, বিশ্ব মা দিবস ইত্যাদি। শুধু কি মা আর বাবা দিবস নিয়েই মানব জনপদের বর্তমান সময়টা ক্ষান্ত আছে! তা কি করে হয়! দাদা-দাদি, নানা-নানি, ভাই-বোন, নাতি-পুতি; সবখানেই একটা না একটা উপলক্ষ্য আছে। অর্থাৎ এই "দিবস" নামক উপলক্ষ্যটি সবার ললাটেই স্ট্যাম্প লাগিয়ে রেখেছে।
যেহেতু সুনির্দিষ্ট একটি দিবসকে উপলক্ষ্য করে আমার এই কলম ধরা বিধায় "বিশ্ব বাবা দিবস" নিয়েই না হয় একটু খোলসা করি। গত শতাব্দীর প্রথম দিকে একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বাবা দিবসের সূচনা। ১৯০৭ সালের ঘটনা এটি। আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়ার একটি কয়লা খনিতে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেদিনের সেই কয়লা খনি দুর্ঘটনায় ৩৬২ জন কয়লা খনি শ্রমিক নিহত হন। ঠিক এক বছর পর ওই হতভাগ্য নিহত শ্রমিকদের সন্তানেরা তাদের পিতাদের স্মরনে সেখানকার এক গির্জায় সমবেত হন। তারা তাদের পিতাদের স্মরনে সেই গির্জায় প্রার্থনা সভার আয়োজন করে তাদের সম্মান জানান। এরই পরম্পরায় ১৯০৯ সালে সনোরা স্মার্ট ডড নামের এক নারী ১৯ জুনকে বাবা দিবসের স্বীকৃতি ও সম্মান দেয়ার জন্য সোচ্চার হন। ১৯১০ সালের ১৯ জুন বিশ্বে প্রথমবার বাবা দিবস পালন করা হয়। আস্তে আস্তে এই দিনটির পরিচিতি ও বিস্তার ঘটে। ১৯৭২ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই দিনটিকে সরকারীভাবে স্বীকৃতি দেন এবং তা আইনে পরিনত করে জাতীয় মর্যাদা দেন। এরপর থেকে এটা "বিশ্ব বাবা দিবসে"র মর্যাদা নিয়ে বিশ্বময়তার আসন গ্রহন করে। তবে প্রতিটি বিষয়ের ব্যতিক্রম থাকে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। বাবা দিবস বিশ্বময়তা পেলেও এর পালনের দিনক্ষন কিন্তু স্থানভেদে ভিন্নভাবে উপস্থাপন হতে দেখি। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলিতে ১৯ জুন বাবা দিবস পালিত হয়। আবার আস্ট্রেলেশিয়া অঞ্চলে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই দিনটিকে বাবা দিবস হিসাবে স্মরন করা হয়। আবার দক্ষিন আমেরিকা অঞ্চলে ১৯ মার্চ বাবা দিবস উদযাপিত হয়। এশীয় অঞ্চল সাধারনতঃ উৎপত্তির নির্ঘন্টটিকেই মেনে নিয়েছে। মজার ব্যাপার হোল এই বাবা দিবসের উদযাপন উপলক্ষ্যে শুধু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর প্রায় এক'শ কোটি ডলারের উপহার সামগ্রী বেচাকেনা হয়। সেজন্যই হয়তো অভিজ্ঞতার অবচেতন মনেই আমার এই প্রবন্ধ শুরুর প্রথমেই "শান এবং ভান" নামক শব্দযুগল উচ্চারিত হয়েছিল। কারন এই দিবস ইত্যাদি শব্দগুলি যেমন তাদের হেঁসেল থেকে এসেছে তেমনি হোম বা কেয়ার শব্দগুলিও ঐ পশ্চিমাদের উঠান থেকেই জন্ম নিয়েছে।
দিবস নামার হাজারো বয়ানে বিশাল ভলিয়্যুমের পুস্তক রচনা করা যাবে। আপাততঃ এটুকু নিয়ে বাবারাই তৃপ্ত থাকুন। সময় ক্ষনে না হয় অন্য আঙ্গিকে এই দিবস চরিত নিয়ে খাতা খুলবো। কারন সুখ দিবস, দুঃখ দিবস, হাসি দিবস, কান্না দিবস, কুষ্ঠ দিবস, ক্যান্সার দিবস, নিদ্রা দিবস, শিশু দিবস, বৃদ্ধ দিবস এমনকি মুরগী দিবস ডিম দিবস নামক কত না বাহারী দিবস আমাদের আছে। আপাততঃ এটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি।