জালাল উদ্দিন আহমেদ
২
মুক্তিযুদ্ধঃ খন্ডিত চেতনা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৩ জুন,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:০৫ এএম, ২৭ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
পুর্ব প্রকাশের পর....
একদল বলছেন তারা বাঙালী। অন্যরা বলছেন তারা বাংলাদেশী। বাঙালী ওয়ালারা বলছেন তারা এই ভূখন্ডের মানুষকে এক চেতনায় উদবুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে এক স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জন্ম দিয়েছেন। আবার বাংলাদেশী ওয়ালারা বলছেন পাকিস্থানী বর্বরতায় এই জনপদের বাঙালী যখন উদ্ভ্রান্ত ও দিশেহারা, তখন একাত্তরের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার হতে ইথারে ভেসে আসা সেই দীপ্রময় "আমি মেজর জিয়া বলছি" র ঘোষনায়(বঙ্গবন্ধুর নামে সেই 'ঘোষনা পাঠ'কে তারা সরাসরি ঘোষনা বলেই চালিয়ে নিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে) বাঙালী আপন চেতনায় সম্বিত ফিরে পায়। লক্ষ্য করুন, দ্বিতীয় গোষ্ঠী এখানে একান্তভাবেই প্রথম গোষ্ঠীর সম্পুরক। কখনোই একটি আলাদা পক্ষ নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনার পরম্পরা মাত্র। তৈরী হয়ে থাকা কোন একটি নতুন পক্ষ নয় এটি। সময়ের দাবিতে এই ঘোষনা পাঠের ঘটনাটি ঘটেছিল। তাও সেটা প্রথম পক্ষের নেতৃত্ত্ব ও রাজনীতির ছায়াতলে। মোদ্দাকথা, বাঙালী জাতি তাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একছত্র নেতৃত্ত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের কাংখিত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এটাই সত্য। তারপরেও তাদের ক্ষমতাকে নিটোল করার অপচেষ্টায় একটি পক্ষ নিজেদেরকে স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি হিসাবে উপস্থাপনের হীনমন্যতায় গোটা বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতাকে তাদের রাজনীতির বড়ি হিসাবে ব্যবহার করতে কুন্ঠিত হচ্ছে না। ফলে মুক্তিযুদ্ধকালীন তৎসময়ের বাংলাদেশ বিদ্বেষী শত্রুরা দাবার ঘুঁটি হিসাবে অন্য পক্ষ্যকে ব্যবহার করতে পিছপা হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিটোল ব্যবচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত এই বিবাদ কি চলতেই থাকবে?
প্রশ্ন উঠবে চেতনাটি কি? কোন্ চেতনায় উদবুদ্ধ হয়ে বাঙালী তার স্বাধিকার আন্দোলনকে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত করে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজ ভূখন্ডকে মুক্ত করার পূর্ব পরিকল্পনায় কি সেই সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কি ছকে বাঁধা কোন পরিকল্পিত এক অবশ্যম্ভাবী ঘটনা ছিল? যারা এই মুক্তিযুদ্ধকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচীর ফসল হিসাবে স্টেজ মাত করছেন তারা কি মুক্তিযুদ্ধের জন্য পরিকল্পিত কোন ছক বাঙালী জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিলেন? রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কোন কাঠামোতেই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার কোন অনুশীলন তাদের কর্মসূচি ও কর্মধারায় দেখা গেছে কি? সত্যি বলতে কি, পাকিস্থান রাষ্ট্রের গদবাঁধা কাঠামোয় থেকে ক্ষমতা লাভের মোক্ষ হিসাবে তারা গোটা বাঙালী জাতিকে একাট্টা করে তাদের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি গেঁথেছিলেন। সেটা কখনোয় মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ম্যান্ডেট ছিল বলে জোর করে কেউ চাপিয়ে দিলে তা হবে বিচ্ছিন্ন প্রলাপ। প্রকৃতপক্ষে ওটা ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার পক্ষ শক্তির সম অধিকারের ভিত্তিতে বেঁচে থাকা ও সামাজিক বৈষম্য নিরসনের একটি গন জাগরনের চিত্র। সামাজিক ন্যায় বিচার, বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতি তথা পুর্ব ও পশ্চিমের সম বন্টনের ভিত্তিতে পাকিস্থান রাষ্ট্রের কাঠামো মজবুত করার অঙ্গীকার এবং একটি দৃঢ় গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর পাকিস্তান রাষ্ট্রকে দাঁড় করানোই ছিল ওই নির্বাচনের মূল প্রতিপাদ্য। রাজনীতির মূল আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক দফাগুলি বিশ্লেষন করলে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা কি সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে? যদি পাওয়াও যায় তবে তার অনুশীলন কি নিবিড়ভাবে করা হয়েছিল? নেতৃত্ত্ব দানকারী রাজনীতির ৬ দফার কোথাও কি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামক এই ভূখন্ড স্বাধীন করার ঘোষনা ছিল? তবে একথা বলতে দ্বিধা নাই যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে মুসলিম লীগ সরকার বা তাদের রাজনীতির দোসররা যেভাবে কোঠারী রাজনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল তাতে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রগতিমনা নেতা কর্মীরা পাকিস্তানী ফ্রেমের মধ্যেই পুর্ব বাংলার স্বায়ত্ব শাসনের অনুশীলন শুরু করে দিয়েছিলেন যা বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাতেই স্পষ্টীকরন স্পষ্টীকরন করা হয়।
পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা কর্মী বলতে সেইসব নমস্য ব্যক্তিদেরকে মনে করা হয় যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও চিন্তার ফসল হয়ে পাকিস্তান নামের এই নতুন রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম পরবর্তী সময় থেকেই জন বিচ্ছিন্ন উপর তলার একটি গোষ্ঠীর কাছে দেশটির ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির মূল রূপকার হিসাবে যাদের নামটি প্রথমেই আসে সেই শ্রদ্ধেয় শের-ই- বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশেম সাহেবেরা মুসলিম লীগের নবাব আমত্যের দাপটে অপাংতেয় হয়ে পড়েন। আর পাকিস্তান আন্দোলনের ডাকসাইটে তুখোড় যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হকরা সেই সুত্রের জেরে পাকিস্তানী শাসকদের কাছে মুর্তমান আতংক হয়ে সামনের সারিতে চলে আসেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ (১) হওয়ায় তারা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। কেননা পাকিস্তান আন্দোলনের এসব নেতা কর্মীরাই সম বন্টন ও সম অধিকারের ঝান্ডা হাতে মুসলমান রাষ্ট্রটিকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র জনতা তথা অপামর জনসাধারনকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। লক্ষ্য করা যায়, পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিশেষ করে জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুর পর মুসলিম লীগের শাসকেরা বিরোধী দমনে গোটা পুর্ব বাংলা জুড়ে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। শোষন বঞ্চনা ও বৈষম্যের তীব্রতা এত প্রকটভাবে দৃশ্যমান হচ্ছিল যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় এতদাঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলন যে খুব শীঘ্র স্বাধীনতার আন্দোলনের রূপ নেবে তা বেশ আঁচ করা যাচ্ছিল। ফলশ্রুতিতে সত্তরের নির্বাচনোত্তর অত্যাচার নিপীড়ন ও বর্বরতার চরম নিগ্রহের জেরে বাঙালী তার অস্তিত্ব রক্ষায় সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে নিজেদের অধিকারের আন্দোলনকে স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপান্তর করেছে। মুক্তিযুদ্ধ করে বাঙালী দেশ স্বাধীন করেছে। এটাই ধ্রুব সত্য এবং শেষ কথা।
(১) বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর স্বপ্ন ভঙ্গের এধরনের ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশেও ঘটেছিল এবং রক্ষী বাহিনী নামক এক প্রশিক্ষিত বর্বর বাহিনীর বর্বরতার শিকার কমবেশী বাংলার প্রতি ঘরেই তার স্বাক্ষর রেখে গেছে। যে ছাত্র নেতৃত্ত্বের অদম্য যুথবদ্ধতায় বাংলার অপামর জনগন তাদের কাংখিত স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ শত্রুমুক্ত করেছিল সেই ছাত্র নেতৃত্ত্বের সিংহভাগ অংশ যখন দেখলো যে, সেই পুরনো বৃটিশ বা পাকিস্তানী কায়দায় দেশ চালানোতেই ক্ষমতা আরোহনকারীরা স্বাচ্ছন্দবোধ করছেন তখন তারা এর বিরোধিতা করে বসেন। ফলে ক্ষমতার দাম্ভিকতায় নতুন সরকার পাকিস্তানী কায়দায় পেশী শক্তির উপর নির্ভর করে। স্বাধীনতার সুর্য উদয়ের সরকার সারা দেশে এক ভয়ংকর ভীতি ও আহাজারির সুত্রপাত ঘটায়। (চলমান........)