জালাল উদ্দিন আহমেদ
পুরনো চাল ভাতে বাড়ে
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ এপ্রিল,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩৭ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
এগার বছরের অবসর জীবন। সেই যে ২০১১তে বসে গেলাম। আর দাঁড়ানো হয় নি। দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল, অনুরোধও ছিল। কিন্তু মনটা যে সায় দেয় না। তাই নিজের মত করে কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসলাম। আর মাঝে মধ্যে নিজের পেশাজীবি কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে টিভি টক-শোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অবশ্য মাঝে মধ্যে ধর্তব্যের কাজগুলো করতে হয়। দু'একটি প্রাতিষ্ঠানিক বা একাডেমিক কাজ কম্মে এখনও ডাক পড়ে। না করতে পারি না। অনুরোধে ঢেকি গেলার মত। এটা প্রাপ্তির আশায় নয়। এটাকে পরিনতের আলোকছটা বলা যেতে পারে। এই যেমন ধরুন, সম্প্রতি আমার এক স্নেহাস্পদ অনুজকে সূদুর অস্ট্রেলিয়ার সিডনী থেকে অনুরোধ বা নিদুকের ভাষায় নির্দেশের মাধ্যমে বাংলায় আনা হলো। বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসাবে কুমিরের একটি প্রজনন কারখানা ময়মনসিংহের ভালুকায় স্থাপন করা হয়। কিন্তু অনভিজ্ঞ উদ্যোক্তা ও সঠিক পরিচর্যার অভাবে ব্যাংক ঋনে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটি রুগ্ন হয়ে পড়ে এবং প্রকল্পে পালিত কুমীরগুলি অবহেলা ও অযত্নে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। শোনা যায় ইতোমধ্যে পরিবেশ প্রতিকুলতায় বেশ কিছু কুমিরের মৃত্যুও হয়। বাংলাদেশে প্রথম এবং একমাত্র এই কুমির প্রজনন কারখানাটিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনা ও লাভজনক পর্যায়ে আনার লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কুমির বিশেষজ্ঞ এবং সিডনীতে একটি সফল ও লাভজনক কুমির প্রজনন কারখানাসহ কুমিরের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করনের স্পেশালাইজড টেনারীর মালিক জনাব এনাম হককে পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। স্নেহাস্পদ অনুজ এনাম বাংলাদেশ কলেজ অব লেদার টেকনোলজির একজন কৃতি গ্র্যাজুয়েট। বর্তমানে সে সিডনিতে বাংলাদেশ কমিউনিটির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও বটে। এটা কিন্তু জাতির প্রতি কর্তব্য পর্যায়ে পড়ে বলেই. সূদুর অস্ট্রেলিয়া থেকে দায়িত্ব নিতে তাকে ঢাকায় আসতে হয়েছে। তার প্রবাসী জীবনের ব্যস্ততা ও নিজের ব্যবসা বানিজ্যের সময় থেকে কিছুটা সময় নিজ জন্মভূমির একটি সম্ভাবনাময় প্রকল্পের জন্য ব্যয় করাকে সে দায়িত্ববোধ হিসাবে গ্রহন করেছে। ষাটোর্ধ অবসরের এনাম এজন্য তোমাকে স্যালুট।
যদিও আমরা সিনিয়র সিটিজেনের খাতায় নাম লিখিয়েছি তথাপি জাতির বা সমাজের ভালমন্দের পথচলায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ ও কর্মদক্ষতার কদর ফুরিয়ে যায়নি। বিশেষ করে আমরা যারা পেশাজীবি তাদের তো নয়ই। কর্মক্ষম জীবনের সময়কালে বিভিন্ন ট্রেনিং সেমিনার বা স্টাডি ট্যুরে বিদেশ বিভুইয়ে যেতে হয়েছে। এমনি একটি ট্রেনিং এর কথা বেশ মনে পড়ে। জাপান ভিত্তিক এপিও বা এশিয়ান প্রডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের আমন্ত্রনে গত শতাব্দীর শেষদিকে একটি ম্যানেজেরিয়াল ট্রেনিং কোর্স করেছিলাম। সেটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ফিলিপিন্সের ম্যানিলায়। সেখানে গিয়েই জানলাম প্রবীনদের প্রয়োজনীয়তার আবশ্যকতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবিরা তাদের নিজ নিজ কর্ম অভিজ্ঞিতার চাহিদায় কনসালটেশন গ্রুপ তৈরী করে তার মাধ্যমে তারা শিল্পোন্নয়ন বা সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সম্পুর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে শুধুমাত্র লজিং ও ফুডিং এর বিনিময়ে এসব গ্রুপ বিভিন্ন দেশে তাদের পেশাজীবির সার্ভিস দিয়ে থাকে। মোদ্দা কথা একজন সিনিয়র সিটিজেন তার কর্ম অভিজ্ঞতার নির্যাসে প্রবীন বয়সেও সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাজে লাগতে পারেন। জাতি বা সমাজ তার অভিজ্ঞতার আলোক ছটায় অনেক ক্ষেত্রেই লাভবান হয়। আমরা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবো সরকার ব্যবস্থায় বা অনেক বড় বড় কর্পোরেট হাউজ তাদের সিনিয়র পদ মর্যাদার কর্মকর্তাদের অবসর প্রাপ্তির পরেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে পদায়ন করে। কারন অভিজ্ঞতার পোড় খাওয়া সেই অবসরে যাওয়া মানুষটির যে তখনও কিছু দেয়ার থাকে তা ভেবেই কিন্তু সেইসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অবসরে যাওয়া অনেক বিজ্ঞজনদের বিভিন্ন প্রকল্প বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানেও পদায়ন করা হয়। এটা কিন্তু সেই “মরা হাতি লাখ টাকা” প্রবাদটিকেই স্মরন করিয়ে দেয়।
ডাব্লুটিও(WTO), ইউনিডো(UNIDO), এপিও(APO),ও অন্যান্য অলাভজনক বহু এনজিও(NGO) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পে রিটাইয়ার্ড পেশাজীবিদের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগাচ্ছে। ফলে আজকের দিনে অবসরের বুদ্ধিবৃত্তিক বা পেশাজীবি জনবল সমাজে বোঝা না হয়ে বরং আশীর্বাদ হয়েই ধরা দিচ্ছেন। একজন মাইকেল উডলী। তিনি বৃটিশ নাগরিক। অথচ নব্বই পেরুনো এই ভদ্রলোক এখনো আন্তর্জাতিক লেদার ইন্ডাস্ট্রী ম্যানেজমেন্টে একজন অপরিহার্য নাম। তেমনি ইন্ডাস্ট্রী ম্যানেজমেন্টে একজন সফল ম্যানেজার হিসাবে নব্বই পেরুনো রিটায়ার্ড ভারতীয় আইএএস মি, এ সহস্রনমনের প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরায় নি। নব্বই ছুঁই ছুঁই এরকম মি. জ্যাকব বুলিয়ান, ড. ফ্রাঙ্ক সিমেল সহ বহু সিনিয়র সিটিজেনদের আন্তর্জাতিক দাতা বা পরামর্শক সংস্থায় স্বল্পমেয়াদী প্রকল্পে কনসাল্টেন্ট হিসাবে দুনিয়াজোড়া কাজ করতে দেখি। দেশের দিকে তাকালে দেখি প্রথিতযশা অনেক পেশাজীবি ও বুদ্ধিজীবিগন দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনো তাদের শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। সবাই হয়তো আবুল মাল মুহিত, এস এম কিবরিয়া কিংবা সাইফুর রহমান ও সাইদুজ্জামান হতে পারেন না। কিংবা ইচ্ছে করলেও তো কেউ জামিলুর রেজা বা ডা. ইব্রাহীম হতে পারবেন না। তবুও একজন আইনুন নিশাত কিংবা রেহমান সুবহান হতে বাধা কোথায়? মানব জীবনের অবসর ক্ষন সৃষ্টিশীল কর্ম চাঞ্চল্যে ভরে উঠুক এই কামনাই করি। পাশাপাশি সিনিয়র সিটিজেনরা তাদের অভিজ্ঞতার নির্যাসে সমাজ ও রাষ্ট্রকে আলোকিত করুক এবং তাদের অস্তিত্ত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রে বোঝা বা আপদ না হয়ে আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিক এই কামনা করছি।