জালাল উদ্দিন আহমেদ
একজন আমির হামজা এবং স্বাধীনতা পদক
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৬ মার্চ,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
এ এক আজব বসবাস আমাদের। সবই যেন উল্টো রথের যাত্রী। সংসার সমাজ রাষ্ট্রে যা কিছু ঘটছে, সবই যেন অনীহা অনিচ্ছায় – ঘটার জন্যই ঘটছে। মানুষ বা জনপদের স্বতঃস্ফুর্ততা, সর্বক্ষেত্রেই যেন মৃতপ্রায় ম্রীয়মান। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্বাধীন স্বত্ত্বা নিয়ে চলার ক্ষেত্রে দেশের শিল্প সাহিত্য ক্রীড়া এবং সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে নিজেদের উৎকর্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারী কিংবা বেসরকারী উদ্যোগে পুরস্কার বা সম্মামনা প্রবর্তনের প্রচলন একটি চলমান ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হয়। সেক্ষেত্রে বেসামরিক পর্যায়ের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক বা পুরস্কার হিসাবে আমরা স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমী পুরস্কারকে সামনের সারিতে রেখেছি। জাতীয় পর্যায়ে এসব পুরস্কার বা পদক প্রাপ্তি সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি বিশেষ সাম্মানের ধারকও বটে। যাঁরা বা যেসব প্রতিষ্ঠান এসব পদক বা পুরস্কারে অলংকৃত হন তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি বিশেষ সম্মান ও সমীহের স্থানে উচ্চকিত হন। শিক্ষা স্বাস্থ্য অর্থ সমাজ সেবা দেশপ্রেম ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপুর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে এসব পুরস্কার বা সনদ কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবি বা গুনীজনদের দেয়া হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে তাঁরা সম্মানিত গুনীজন হিসাবে বিবেচিত হন। তাদের কাজের সুনামে তারা যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত হন তেমনি সমাজেও তারা সম্মানের সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা পদক হচ্ছে বেসামরিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ সম্মানের পদক। এই পদকটি এমন এক উচ্চ মর্যাদার সম্মান যা দেশীয় গন্ডির বাইরেও আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক প্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে মাপা হয়। এধরনের পদক প্রাপ্ত মনীষীগন যেমন দেশের সম্মানিত সম্পদ, পাশাপাশি তারা বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশকে তাদের মান মর্যাদা নিয়ে সম্মানিত করেন এবং সম্মানিত হন। বাংলাদেশ তার নিজস্ব উঠানে পা রাখার পর বিগত পঞ্চাশ বছরে এদেশের প্রথিতযশা বহু জ্ঞানীগুনি ও মহান মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও শিক্ষাবিদ সাহিত্যিক ব্যবস্থাপক বিজ্ঞানী সমাজসেবক এবং রাজনীতিবিদ তাদের দেশ সেবা এবং দেশ প্রেমের অসামান্য অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। তারা আমাদের জাতির নমস্য ব্যক্তিত্ব। আমরা যখন কৈশর পেরিয়ে যৌবনের সিঁড়িতে পা রেখে দেশ মার্তৃকার সেবায় পদার্পন করলাম, তখনকার সদ্য স্বাধীন দেশের সেইসব দিনে এসব পদকের ঘোষনা, পদক প্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবস্থান এবং পরবর্তীতে তাদের জীবনী ও কর্ম সাধনার বিষয়গুলি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। তাদেরকে সম্মামনা জানানোর জন্য বিভিন্ন ক্লাব অফিস এমনকি মহল্লায় সূধী সমাবেশের আয়োজনে সমাজ সচেতনেতার কাজগুলো চলতো। অর্থাৎ মানুষ ও সমাজের মধ্যে একটি সমীহ জাগানোর সাড়া পড়ে যেত। সমাজ এবং মিডিয়ায় তাদের সৃষ্টিকে নিয়ে আলোচনার ফুলঝুরি উড়তো। দেশ তাদের সৃষ্টি ও জীবনধারাকে পরবর্তী প্রজন্মের দীপশিখা হিসাবে উপস্থাপন করতো।
বাংলাদেশ নামক স্বাধীন স্বত্বার এই ভূখন্ডে আজকের দিনে আমরা যেমন আমাদের জাতির স্থপতির জন্ম শতবর্ষ উদযাপন করছি পাশাপাশি আমরা আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বা সুবর্ণ জয়ন্তীও পালন করছি। কিন্তু এই পঞ্চাশ বছরে আমাদেরকে বহু চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে অতিক্রম করতে হয়েছে। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরে আমরা আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে হারিয়ে পথভ্রষ্ট পথিকের মত পনেরটি বছর দেশের রাজনীতি ও বাঙালীয়ানার ভষ্মে ঘি ঢেলেছি। পরবর্তী সময় হতে অদ্যাবধি বাংলার রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি, ফ্যামিলি ডাইন্যাস্টির পুষ্টতায় সিদ্ধ হয়ে দেশকে গণতন্ত্রের নামে এক অলিখিত পারিবারিক রাজতন্ত্রে বলীয়ান করেছে। উত্তরাধিকারের দুটি পক্ষ দেশকে গণতন্ত্রের নামে পারিবারিক আবক্ষ স্থাপনের ঘুঁটি হয়ে বাংলার গণতন্ত্র ও রাজনীতিকে ব্যক্তি স্তুতির সুলতানিয়াত সৃষ্টিতে মগ্ন রয়েছে। এমনকি দেশের স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ সুত্র বানিয়ে তারা ক্ষমতার দন্ডটিকে দুটি জাতিস্বত্ত্বা তৈরীতেও পিছপা হচ্ছে না। ফলে এই দ্বিচারনীয় চলনে আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি ও অন্যান্য জাতীয় ও সামাজিক বিবর্তনে আমরা খন্ডিত অবয়বে অনুশীলনরত রয়েছি। এখনকার দিনে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানের জায়গাগুলিতেও আমাদের দ্বিচারিতার অনুশীলন স্পষ্টতর হচ্ছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার সুমহান ঐতিহ্যকে আমরা খন্ডিত অবয়বে উপস্থাপনেও দ্বিধা করছি না।
সম্ভবতঃ রাজনৈতিক দীনতার আকালের সময়েই ওইসব অযাচিত ঘটনাগুলির সুত্রপাত হয়। রাজনীতির অনৈতিক আচরনের বিষাক্ত প্রবাহ তখন তরঙ্গাকারে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে কলুষিত করে। অনৈতিক আচরনের ক্ষমতা বলয়ের রাজনীতির পাশে গড়ে উঠে অতি উৎসাহী অদম্য শক্তিধর প্রশাসনিক বলয়। পাশাপাশি শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বইতে থাকে একপক্ষীয় স্তুতি বন্দনার মহা সমারোহ। ক্ষমতার দাপটে শাসক হয়ে উঠেন কবি ও সাহিত্যিক। আইন ও শৃংখলার জনতার কর্মচারী হয়ে যান সমাজের মহান দানবীর হাজি মোহাম্মদ মহসিন। জনতার কর্মচারী প্রশাসকরা হয়ে যান গনপ্রজাতন্ত্রের প্রভু। হযবরল এর এই মহা সন্ধিক্ষনে তখন এই আমির হামজা বা রইসুদ্দিনরা বনে যান দেশের শিল্প সংস্কৃতির সম্মানিত মুখ। কিন্তু এই আমির হামজারা যে আজকের দিনের লক্ষ্যভ্রষ্ট গনতান্ত্রিক শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট ওইসব তৈলবাজ প্রশাসনের বাবা চাচা কিংবা মামার পর্যায়ের অখ্যাত কোন গায়েন বা কবিয়াল তার খোঁজ কি আমরা রেখেছি? কবে কোন যাত্রাপালায় কিংবা পথচলায় দু চার লাইন পিতার গুনগানে অখ্যাত জনপদে বিচরন করা এই আমির হামজা বা চাঁন মিয়ারা যদি শিল্প সাহিত্যের স্বনাম ধন্য বনে যান তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে! চাঁন মিয়া নামটা ইচ্ছে করেই বললাম, কারন এক সময়ে কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী চাঁন মিয়া নামক ব্যক্তিটি বেশ ভাল গীতিকাব্য রচনা করতেন। এবং এগুলি নিয়ে তার একটি বইও ছাপা হয়েছিল। তার এই কাব্যকথার দু'একটি গান আকারেও বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হতে দেখেছি। ভাগ্যচক্রে সেই চাঁন মিয়া কিন্তু গোপাল গঞ্জের কোটালী পাড়ারই মানুষ। ভাবি, এই মানুষটাকে কেউ কি দেখতে পাইনি? আমি কাউকে কটাক্ষ করছি না। শুধু বাঙালী হওয়ার আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলতে চাই এই বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভাবে নি বা তাঁকে নিয়ে দু'চার পাতা কবিতা বা সাহিত্য কর্ম করেনি- এমন লোক কি বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে?
আমাদের লোকগানের রমেশ শীল কিংবা বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গান আজ বাংলা ও বাঙালীর মুখে মুখে ঘুরে ফিরে। তাঁদেরকে সম্মানিত হওয়ার জন্য কি আমির হামজাদের মত আমলার সুপারিশ সম্বলিত দরখাস্ত করতে হবে? জানি না কোন উটপাখির সওয়ার হয়ে আমাদের আজকের বাংলাদেশের পথচলা। সামাজিক রাষ্ট্রীয় পথচলায় আমাদের এই অনাকাংখিত হাঁটাচলার গলিপথগুলিকে বন্ধ করতে হবে। না হলে ভবিষ্যতের কন্টকাকীর্ণ পথ প্রতিবন্ধকতায় এক সময় আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য গুমোট অন্ধকারে ছটপট করতে করতে দম বন্ধ হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। বাংলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি তার আপন পথচলায় মহিমান্বিত হোক। আর জ্ঞানী গুনী ও মহান ব্যক্তিরা তাদের কর্ম সাফল্যের চূড়ায় চড়ে বাঙালীর ধন্য সন্তান হয়ে বাঙালীকে উচ্চকিত করুন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মন্ত্রগাঁধায় অটল থেকে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো সরল পথে এগিয়ে চলুক – এই কামনা করি। পাশাপাশি ভবিষ্যতে আমলা কামলা সুপারিশে নতুন কোন আমির হামজা পবিত্র সম্মানের এই জায়গাটিকে কলুষিত না করে, কায়মনবাক্যে এটাই প্রার্থনা করি।