জালাল উদ্দিন আহমেদ
নিষেধাজ্ঞার ধনবাদী আগ্রাসন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৭ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:০১ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
“নিষেধাজ্ঞা” (SANCTIONS) ছোট্ট একটি শব্দ। অথচ আজকের দিনে এই শব্দটি যেন এক ভয়ঙ্কর হাইড্রোজেন বোমা। বিধি নিষেধ থেকে এসেছে এই শব্দটি। সম্ভবতঃ ব্যবহারের ব্যপকতা প্রকাশের জন্যই sanctions নামক এই শব্দটি চয়ন করা হয়েছে। সামাজিক রাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তঃ রাষ্ট্রীয় কলহ বিবাদের ঘটনাগুলি যখন আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করা যায় না তখন রাষ্ট্র কাঠামোর কার্যক্ষেত্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক গন্ডির সীমাবদ্ধতায় থেকে এই এমবার্গো বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
এই বিধি নিষেধ কিংবা সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিষিদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সৃষ্টির আদিকাল থেকেই ছিল বোধ হয়। সামাজিক মোড়ল মাত্ববরীয় গন্ডি থেকে শুরু করে উপরের স্তরে উঠে এই বিধি নিষেধ বা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যতই আলোচনা করা হয়, সর্বক্ষেত্রেই এই অস্ত্রটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এখনকার দিনের বিধি নিষেধ রাষ্ট্রীয় ঘোষনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হতে দেখি। তবে সব কিছুই হয় রাষ্ট্র ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে। রাষ্ট্রের প্রতি রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব, সমমনা রাষ্ট্রের অপছন্দের কোন বিকাশমান রাষ্ট্রের দ্বারা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নটখটের কিছু ঘটলেই তখন নিষেধাজ্ঞা নামক খড়্গটি ঝুলিয়ে দেয়া হয়। সেটা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক, সামরিক সব রকমেরই হতে পারে।
পৃথিবীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ হওয়াতে আমরা রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরন বেশ ভালভাবেই লক্ষ্য করেছি। মহাযুদ্ধের পূর্ব সময়কালে বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্র পুঞ্জের সমন্বয়ে সামষ্টিকভাবে চলার ধারনাগুলি ছিল না। তখনকার সময়ে রাজা মহারাজা কিংবা শক্তিমত্তার পারিবারিক সামন্ত প্রথায় রাজ্য বা রাষ্ট্রের গতি বিধি পরিচালিত হোত। ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র পুঞ্জের ধারনায় দেশ বা রাষ্ট্রের বিচরন কদাচিত দেখা যেত। তখনকার দিনে রাজা মহারাজাদের সিদ্ধান্তেই রাষ্ট্রের গতিবিধি পরিচালিত হোত। তবে আঞ্চলিক সহাবস্থান তখনও ছিল। তবে সেটাও সম্ভবতঃ গোত্র বর্ণ ও ধর্ম বিবেচনায় মাপা হোত।
আজকের দিনের বিবেচনায় পৃথিবী একটি গ্লোব্যাল ভিলেজ (global village) হিসাবে বিবেচিত হয়। বহু ঘাত প্রতিঘাতের উঠানামার ফলেই এই ধারনাটিকে সামনে রেখে বিশ্ব আজ এক সুতোর বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। দুটি বিশ্বযুদ্ধই তাদেরকে এই আপোষকামিতার সৌষ্ঠবে একত্র করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মুসোলিনি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলার বিশ্ববাসীকে শান্তির ছাতা তৈরীতে একাট্টা করেছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি জাতি রাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিচালনায় আপন বৈশিষ্ঠে স্বাধীনভাবে চলাচল করবে -এই মনোভাব ও চিন্তাধারা নিয়েই সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের ধারনায় লীগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠা করা হয় গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।
তারপরেও মনুষ্য বসতির এই বিশ্বে ক্ষমতার গোষ্ঠি কেন্দ্রিকতায় দুটি বলয় সৃষ্টি হতে আমরা দেখেছি। ধনবাদী গোষ্ঠী ও সমাজবাদী গোষ্ঠী বলয়ে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীতে দুটি শক্তির বলয় সুস্পষ্ট মেরুকরনে নিজেদের শক্তি সামর্থ নিয়ে এগিয়ে গেছে। অর্থাৎ ধনবাদী গোষ্ঠী তাদের সমমনা রাজনীতির মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্র সমূহকে নিয়ে ন্যাটো নামক এক সামরিক জোট গঠন করে তাদের অস্তিত্ত্বের গোড়পত্তন করে এগিয়ে গেছে। পাশাপাশি সমাজবাদী রাষ্ট্র সমূহ তাদের সমমনা রাজনৈতিক কাঠামোর রাষ্ট্রপুঞ্জ সমন্বয়ে গঠন করেছে ওয়ারশ নামক এক সামরিক জোট। পৃথিবীর শান্তি শৃংখলা ও সামরিক ভারসাম্যতায় এই দুটি জোট মূলতঃ পৃথিবীকে দুই মেরুতে আবদ্ধ রেখে লীগ অব নেশন্স পরবর্তী জাতিসংঘ সৃষ্টির পরেও একটি অলিখিত স্নায়ু যুদ্ধের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছে। ফলে শান্তি ও শৃংখলার ভারসাম্যে পৃথবীর রাষ্ট্র সমূহ স্বস্তির মধ্যে দিন কাটিয়েছে। এভাবেই রাষ্ট্রসংঘ সৃষ্টি হওয়ার পরেও পরবর্তী তিরিশটি বছর বিশ্ব ভূখন্ডের দেশ সমূহ একটি চেক এন্ড ব্যালেন্সের মধ্যে তাদের দেশ ও জাতি গঠনে এগিয়ে গেছে।
পুঁজি গঠন ও পুঁজির উৎকর্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ধনবাদী ডানপন্থি রাজনীতি সব সময় সাধারন জনগোষ্ঠী ও রাষ্ট্র সমূহকে কয়েকটি ক্ষেত্রের মানোন্নয়নে একটি আলাদা উৎকর্ষতায় পৌঁছে দেয় যদিও তা সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক মানোন্নয়নের ভিতকে কখনোই উচ্চকিত করতে পারে না। তারপরেও ধনবাদী রাজনীতি ও রাষ্ট্র সমূহ তাদের শক্তিমত্তা ও কুট কৌশলে সব সময় বাহ্যিক চাকচিক্য ও অর্থবিত্তের শক্তিবলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে এগিয়ে যেতে পছন্দ করে। এক্ষেত্রে সমাজবাদী রাষ্ট্র সমূহ তাদের দেশীয় জনশক্তির যুথবদ্ধতা ও আর্থ সামাজিক সামগ্রিকতার যুগপৎ উন্নয়নে সামাজিক সাম্যতা ও সমবন্টনের সূত্রে দেশ গড়ায় মনোযোগী হয়। ফলে বহিঃ স্বার্থ ও সামগ্রিকতায় তারা পিছিয়ে পড়ে। এটা ঘটে সাধারনতঃ ব্যবসা বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে।
সুযোগটা নিতে ভুল করেনি ধনবাদী রাষ্ট্র গোষ্ঠির মোড়ল বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক শক্তিধর রাষ্ট্রটি। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামরিক শক্তিমত্তায় শক্তিধর আমেরিকা তাদের সর্ব কৌশল অবলম্বন করে বহুজাতিক সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক সামাজবাদী রাষ্ট্রটির ক্ষয়িষ্ণু একাত্মতার ভষ্মে ঘি ঢালা শুরু করে। ফলে রাশিয়ার চারপাশে বলশেভিক মন্ত্রগাঁথায় একাট্টা হওয়া রাষ্ট্র সমূহ নিজ স্বকীয়তায় ফিরে আপন আপন রাষ্ট্র গঠনে মনোযোগী হয়। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে সংযুক্ত সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে জাতিগত রাষ্ট্র বিনির্মানে স্ব স্ব স্বাধীন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফলে রাশিয়া তার আপন অস্তিত্ত্বে ফিরে যায়। আর এর ফলে সমাজতন্ত্রের আদলে গঠিত সমমনা রাষ্ট্রের ওয়ারশ সামরিক জোটের পতন ঘটে। ফলশ্রুতিতে এর পরবর্তী সময়ের আজ অবধি ধনবাদী রাষ্ট্র সমূহের মোড়ল হিসাবে পরিচিত মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্র সারা দুনিয়ার একছত্র অভিভাবক রূপে অবির্ভূত হয়। ন্যাটো নামক সামরিক জোটের উৎকর্ষতা ও কলেবর বাড়াতে মনোযোগী হয় তারা। এমনকি রাষ্ট্র সংঘ নামক সর্ব রাষ্ট্রীয় প্ল্যাটফরমটিও তারা নিজেদের মত করে পরিচালনার আদল তৈরীতে এগিয়ে যায়। এক্ষেত্রে যদিও গঠন কাঠামোর “ভেটো” নামক একটা বিষ্ফোড় তাদের শৈরাচারী আচরনে কিছুটা হলেও প্রতিবন্ধকায় ফেলে দেয়।
এভাবেই একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে বা তারও আগে সোভিয়েত সমাজবাদী জোট ভাঙ্গনের পরবর্তী সময়কাল থেকেই কর্তৃত্ববাদী আচরনের আমেরিকা সর্বক্ষেত্রেই বেপরোয়া রূপ ধারন করে। Check and Balance এর প্রতিপক্ষ সামরিক শক্তি “ওয়ারশ” প্যাক্ট ভেঙ্গে যাওয়ার পর আমেরিকা সর্বক্ষেত্রেই ন্যাটো নামক ধনবাদী গোষ্ঠীর সামরিক জোটের জুজুকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে পছন্দ করেছে। এর ফলে বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি সিংহভাগ শান্তিকামী জনপদকে একটি অলিখিত আপোষকামিতা নিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে চলমান থাকতে হয়েছে। কিন্তু যে সামাজিক মূল্যবোধ ও জাত্যাভিমানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের রাজ্য রাজনীতি বিকাশমান হয়েছে তাতে করে সময়ের চাহিদায় এসব একমুখীতা হয়তোবা কোন কোন রাষ্ট্র বা জাতির মত ও পথের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতেই পারে। সেসব বিষয়গুলিকে ধনবাদী মোড়লদের মনঃপুত না হওয়ার খেসারতেই শুরু হয় sanctions বা embargoes নামক খড়্গগুলির অপপ্রয়োগ।
বিগত শতাব্দীতে কিউবা, ভিয়েতনাম, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফ্রিকার কিছু কিছু দেশ এবং চলমান সময়ে আফগানস্থান, ইরান, উত্তর কোরিয়ার মত তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহে সেইসব মোড়ল মাত্ববরীয় ধনবাদীদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এমনকি সামরিক অভিযানের ধুন্ধুমার আচরনের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দেশ সমূহের অসহায়ত্ব আরো কয়েকগুন বেড়েছে বৈ কমে নি। যেখানেই তাদের স্বার্থের টান পড়েছে সেখানেই তারা মোড়লীয় আচরনে সেইসব মাথা উঁচু করে স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়াতে চাওয়া দেশ সমূহে তাদের পরিকল্পিত sanction বা embargo নামক খড়্গ ঝুলিয়ে দিয়েছে। অথচ শতাব্দী প্রাচীন পালেস্টাইন-ইজরাইল ধংসযজ্ঞ কিংবা মানবতা ধংসকারী কাশ্মিরী ইস্যুকে তারা আমলে না নিয়ে ঐসব অঞ্চলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমূহকে পারমানবিক শক্তি সঞ্চয়ের মরনব্যাধি দুষ্টচক্র বানিয়ে পৃথিবীর বুকে অশান্তির চাদর বিছিয়ে দিতে সহয়তা করছে। আজকের দিনের রাশিয়া- ইউক্রেনীয় সংঘর্ষের ঘটনাটিও সেই একই কায়দায় সৃষ্ট এক বেনিয়া ধনবাদী চক্রের মরন ফাঁদ বলেই মনে হচ্ছে।
যে আদর্শ ও শান্তির মনোভাব নিয়ে ওয়ারশ প্যাক্টের বিলুপ্তি করা হোল সেই আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধে কি ন্যাটোকে বিলুপ্ত করা যেত না? আর কোন্ প্রেক্ষিতেই বা ন্যাটো সম্প্রসারনের প্রয়োজনীয়তা এসে গেল? ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন আছে, আফ্রিকার জন্য আফ্রিকান ইউনিয়ন, এশিয়ার আসিয়ান, সার্ক ইত্যাদি রয়েছে। আমেরিকা মহাদেশের জন্য তাদের সেরকম কান্ট্রিবাউন্ড এসোসিয়েশন আছে। সুতরাং সামরিক জোট বা সমিতি কার স্বার্থে? এক্ষেত্রে আমাদের ভাবতে হবে যে, যুদ্ধ সন্ত্রাস বিচ্ছিন্নতাবাদ কিংবা যুদ্ধ বিগ্রহের ঠুনকো হাইপ তুলে নিজেদের অস্ত্র ভান্ডারের কদর বাড়ানো – এ শুধুমাত্র বেনিয়া রাজনীতির অপকৌশল মাত্র। বিশেষ করে ধনবাদী আচরনের রাষ্ট্র চিন্তার কুশীলবদের মস্তিস্ক প্রসূত ধ্বংস ও সৃষ্টির কুটকৌশল থেকেই এসব সামরিক জোট, সামরিক মহড়া বা শেষমেশ কথা না শোনা অবাধ্যদের বিরুদ্ধে sanctions বা embargoes চাপিয়ে তাদের বানিজ্যের প্রসার ঘটানোর এক দুষ্ট চিন্তা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে। এই মরন খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার আলোকবর্তিকায় শান্তির বাসযোগ্য পৃথিবীর চাহিদা আপনার আমার সকলের। এই মন্ত্রগাঁথায় আসুন আমরা আশরাফুল মোখলুকাত হওয়ার মনোবাসনায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানবিকতাকে উচ্চকিত করি।